তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে: কান্ত-কবির জন্মদিনে শ্রদ্ধা

Soumitra Sen Mon, 26 Jul 2021-7:50 pm,

পুত্র ও কন্যা মারা গিয়েছে। শোকার্ত পিতা লিখলেন-- তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ, তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব। তোমারি দু'নয়নে তোমারি শোক-বারি, তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব। এ গানে নিবেদনের আর্তি এত গভীর যে তা মনের অতলান্ত শোককে যেন ঈশ্বরের পায়ে পূজা রূপে পৌঁছে দেয়। এ গান রচনা করেছিলেন এই বাংলার এক অনন্য কবি ও সঙ্গীতকার রজনীকান্ত সেন। আজ, ২৬ জুলাই তাঁর জন্মদিন। তাঁর পুত্র ভুপেন্দ্র ও কন্যা শতদলবাসিনী খুব অল্প বয়সেই মারা যায়। রজনীকান্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে এবং ঈশ্বরের উপর অগাধ আস্থা রেখে পর দিনই রচনা করেছিলেন এই গানটি।

 রজনীকান্ত সেন একজন প্রখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার। বাঙালি সংস্কৃতিতে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমসাময়িক এই গীতিকারের গানগুলি আজও জনপ্রিয়। ভক্তিমূলক ও স্বদেশেপ্রেমের গানই তাঁর সৃষ্টির প্রধান বৈশিষ্ট্য।

বাবা গুরুপ্রসাদ সেন ও মাতা মনোমোহিনী দেবীর ৩য় সন্তান রজনীকান্ত। গুরুপ্রসাদও সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন। কাব্য চর্চা করতেন। চারশো বৈষ্ণব ব্রজবুলি কবিতা সঙ্কলন একত্রিত করে 'পদচিন্তামণিমালা' নামক কীর্তনগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। এ ছাড়াও 'অভয়াবিহার' গীতিকাব্যের রচয়িতা ছিলেন তিনি। অন্য দিকে, রজনীকান্তের মা মনোমোহিনী দেবী বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি কিশোর রজনীর সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। বাবা-মায়ের এই সাংস্কৃতিক প্রভাবই তাঁর ভবিষ্যত্‍ জীবনে গড়ে দিয়েছিল।

শৈশবকাল থেকেই তিনি স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল ভঙ্গিমায় বাংলা ও সংস্কৃত দুই ভাষাতেই কবিতা লিখতে পারতেন। পরে তিনি তাঁর রচিত কবিতাগুলিকে গানে রূপ দিতে শুরু করেন। আরও পরে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে গান পরিবেশনও করতেন। ১৫ বছর বয়সে কালীসঙ্গীত রচনার মাধ্যমে তার অপূর্ব কবিত্বশক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।

রজনীকান্ত বোয়ালিয়া জেলা স্কুলে (বর্তমান রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল) ভর্তি হয়েছিলেন। ১৮৮৩ সালে কোচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে ২য় বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। এর ফলে তিনি প্রতি মাসে দশ টাকা বৃত্তি পেতেন। ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে ২য় বিভাগে এফ.এ পাশ করে কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেই ১৮৮৯ সালে বি.এ পাশ করেন।

একটি গান তাঁকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দিল--'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই;/দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই'। এই একটি গানে রজনীকান্ত যেন সমগ্র বঙ্গের জাতীয় কবিতে পরিণত হলেন। জনসমক্ষে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেন।

এ গানটি তত্‍কালীন বাংলায় এক অদ্ভুত গণ-আন্দোলন ও নবজাগরণের পরিবেশ সৃষ্টি করল। গানের কথা, সুর ও মাহাত্ম্য স্বদেশী আন্দোলনকে যেন আরও উজ্জীবিত করল।  ভারতীয় বিপ্লবী নেতারা পরবর্তী বছরগুলিতেও   সোৎসাহে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই গানটিকে মুখে নিয়েই।

 রজনীকান্ত তাঁর জীবদ্দশায় তিনটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন-- 'বাণী' (১৯০২), 'কল্যাণী' (১৯০৫), 'অমৃত' (১৯১০)। এ ছাড়াও ৫টি বই তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী কালে প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলি হল-- 'অভয়া' (১৯১০), 'আনন্দময়ী' (১৯১০), 'বিশ্রাম' (১৯১০), 'সদ্ভাবকুসুম' (১৯১৩), 'শেষদান' (১৯১৬)। 

১৯০৯ সালে রজনীকান্ত কণ্ঠনালীর প্রদাহজনিত সমস্যা ভুগতে শুরু করেন। ১৯১০ সালে ক্যাপ্টেন ডেনহ্যাম হুয়াইটের তত্ত্বাবধানে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ট্রাকিওটোমি অপারেশন করান। তবে এর ফলে কিছুটা আরোগ্য লাভ করলেও তিনি চীর তরে তাঁর বাকশক্তি হারান। অপারেশন-পরবর্তী জীবনের বাকি দিনগুলি হাসপাতালের কটেজ ওয়ার্ডেই কাটিয়ে দেন।

১৯১০ সালের ১১ জুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রজনীকান্ত সেনকে দেখতে হাসপাতাল গিয়েছিলেন। তখন রজনীর লিখিত একটি গান তার পুত্র ক্ষিতীন্দ্রনাথ এবং কন্যা শান্তিবালা হারমোনিয়াম-সহযোগে গাইছিলেন। রজনী বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর তাঁকে ব্যথা-বেদনা দিয়ে তাঁর আত্মাকে শুদ্ধ করছেন। এ বিশ্বাস সমস্ত ব্যথা থেকে তাঁকে মুক্ত রাখত। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি আত্মনিমগ্ন হয়ে ওই গানটি রচনা করেছিলেন। ওই দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে  সাক্ষাতের স্মারক হিসেবে গানটি তিনি পাঠিয়েওছিলেন কবিকে। গানটি হল-- 'আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, গর্ব করিতে চূর,/ তাই যশ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য, সকলি করেছে দূর৷/ ঐ গুলো সব মায়াময় রূপে, ফেলেছিল মোরে অহমিকা-কূপে,/ তাই সব বাধা সরায়ে দয়াল করেছে দীন আতুর;'। 

তার সঙ্গীত-প্রতিভাই তাঁকে অমর করে রেখেছে। সঙ্গীতরচনা তাঁর পক্ষে ছিল জলের মতো সহজ ও স্বাভাবিক। তাঁর আধ্যাত্মিক গানগুলি রচনার মাধ্যমেই রজনীকান্ত অমরত্ব লাভ করে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। গঠনের দিক থেকে তাঁর গান হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ঘরনার। তবে এতে তিনি কীর্তন, বাউল এবং টপ্পার যথাযথ সংমিশ্রণ ঘটিয়ে শ্রোতার মন জয় করেছেন।

সঙ্গীতের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহের কথা ব্যক্ত করে রজনীকান্ত রাজা শরৎকুমার রায়কে চিঠিতে জানিয়েছিলেন--''কুমার, আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসায় করিতে পারি নাই। কোন দুর্লঙ্ঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসায়ের সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল, কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম; কবিতার পূজা করিতাম, কল্পনার আরাধনা করিতাম; আমার চিত্ত তাই লইয়া জীবিত ছিল।-- একান্ত অনুগত শ্রীরজনী কান্ত সেন!''

 

ZEENEWS TRENDING STORIES

By continuing to use the site, you agree to the use of cookies. You can find out more by Tapping this link