স্বরূপ দত্ত


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আরও একটা পুজো এসে গেল। দেখতে দেখতে ১৮ টা A মার্কা পুজো এসে গেল আমার জীবনে। লোকে বলে, জীবনে কতগুলো বসন্ত পেরিয়েছে। আমি বলি, এতগুলো A মার্কা পুজো এসেছে আমার জীবনে। আপনি ভাবছেন, পুজোর আবার A মার্কা কী! বা, এরকম দুটো বিপরীতমুখী শব্দ পাশাপাশি বসানো যায় নাকি! এটা তো পাপেরও হবে। না। হবে না। কারণ, পুজোর মর্ম আমি বুঝি। মা দুগ্গার আশীর্বাদও অনুভব করি। বাবা-মা আর তাঁর শক্তিতেই তো কাটিয়ে দিলেম জীবনের এতগুলো বছর। তাই পুজোর পাশে A বসানোর আগে বারেবারে ভেবে নিয়েছি বইকি। মনে মনে অনুমতিও নিয়েছি মায়ের কাছে থেকে। এবার খুলে বলি, কীভাবে আমি এসে পড়লাম জীবনের ১৮ তম A মার্কা পুজোতে। 



সেই ছেলেবেলার দিনগুলোতে রাস্তায় বেরোতাম যখন বাবা-মায়ের হাত ধরে, তখন দোকানের সাইনবোর্ড আর সিনেমার পোস্টারগুলো দেখে-দেখেই তো কথা বলতে, শিখছিলাম। বড়দের পৃথিবীটার আদব কায়দা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। সিনেমার পোস্টারে ওই গোল করে A মার্কাটা দেখতে যে কী ভালো লাগতো। তখনও বোঝারও বয়স, মন হয়নি যে ওই A মার্কা জিনিসটা হয়টা ঠিক কী! পড়ে একটু বড় হতেই তো বুঝে গেলাম যে, A মানে অ্যাডাল্ট। অর্থাত্‍, আমাকে ওই ধরনের সিনেমা দেখতে গেলে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। এত ছোটদের জন্য ওগুলো নয়। ভালো। বুঝে গেলাম। মানিয়ে নিলাম। 


সেই ছেলেবেলার দিনগুলোতে পুজোটাই তো ছিল জীবনের সবথেকে আনন্দের। গরমের ছুটি পেতাম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ছুটি পেতাম। কখনও কখনও খুব বৃষ্টিতে বর্ষার ছুটিও পেতাম। কিন্তু কোনওটাই যে তুলনায় আসে না পুজোর ওই দিনগুলোর কাছে। এত ফোনাফুনি ছিল না আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে। মাকে তাই রোজ জিজ্ঞেস করতাম - ও মা, দাদু কবে আসবে? মা গো পিসি কবে আসবে? আর কাকুরা? দাদাভাই কি এবার পুজোতে আসবে না? মামার বাড়ি আমরা যাব, নাকি মামা আসবে এরমধ্যে আমাদের বাড়িতে? এছাড়াও ১৪ গুষ্টির আত্মীয়দের পায়ের ধুলো যাতে আমাদের বাড়িতে পড়ে, সেই আশায় হ্যাংলার মতো দিন গুনতাম। ছোট মাথায় আগডু বাগডুম ভাবতাম। কারণ কী? ওঁরা ছিল তো খুব প্রিয়। আর প্রিয় মানুষ যে আমাকে পুজোতে নতুন জামা কাপড় দেবে। আর আমি রোজ একটা, একটা করে গুছিয়ে রাখবো। দেখবো, কটা হল। বন্ধুদের বলব, প্রতিবেশী কাকিমাকে বলব, এবার আমার ১২টা বা ১৫টা কিংবা ১৭টা জামা হয়েছে। চারদিনে প্রতি ঘণ্টায় পারলে নতুন নতুন জামাগুলো পড়তাম। শুধু কী আর মাটিরই সোঁদা গন্ধ হয়? নতুন জামার গন্ধ যে কী ভালো, সেটা বুঝতে গেলে, আপনাকেও আরও একবার সেই ছেলেবেলায় ফিরে যেতে হবে মনে মনে। 


এরপর যত বড় হচ্ছিলাম, পুজোয় পাওয়া জামার সংখ্যা কমতে লাগলো। ডাবল ডিজিটের জামা পাওয়া তো ক্লাস সিক্স-সেভেনের পর থেকেই শেষ হল। তারপর কমতে কমতে একেবারে পাঁচটা, চারটে, তিনটে, কবে যেন বুঝে গেলাম। এবার বাবার চাকরির অবস্থা বেশ খারাপ। তাই বাবা আর দিতে পারবে না কিছু। আত্মীয় স্বজনরাও আর কেন দেবে? আমি যে বড় হয়ে গিয়েছি। খেয়াল করে দেখলাম, শরীরে পরিবর্তন এসেছে। মনে পরিবর্তন এসেছে। আর যে সিনেমাগুলোর পোস্টারে A লেখা থাকতো, সেটা দেখতে সিনেমাহলে ঢুকতে গেলে, টিকিট পরীক্ষকও আটকাচ্ছেন না। পুজো তারপর থেকে অনেক এলো। অনেক সিগারেট। অনেক পানীয় প্যান্ডেলের পিছনে। সামনের ঝলমলে সুন্দরীরা। কিন্তু আমার গায়ের জামাটা আর নতুন হয় না সবসময়। নিজে থেকে না কিনলে। বড় হওয়ার স্বাদ পাওয়া শুরু করলাম। শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘের আলোর নিচে নতুন জামা পড়ে দাড়িয়ে মা আর দূর থেকে আমায় দেখে বলে না, 'লক্ষ্মী সোনা, একেবারে রাজপুত্রর মতো লাগছে।'


যে A মার্কা সিনেমা দেখার জন্য খুব তাড়াতাড়ি বড় হতে চাইতাম, মুখে দেওয়া যায় না, এমন তেতো খেয়েও, বড় হয়ে গিয়ে সেই তেতোর স্বাদ সত্যি সত্যিই পেলাম। জীবনের প্রথম ১৮ বছর ছিল A মার্কা ছাড়া। হয়তো অনেক কিছু পারতাম না করতে নিজের ইচ্ছে মতো। কিন্তু পেতাম সবার কাছ থেকে সবকিছু। পুজো তো শুধু পুজো ছিল না। পুজো ছিল পাওয়ার দিনগুলো। আমি ১৮ - পেরোতেই হয়ে গেলাম দেওয়ার! এবার আমার থেকেও সবাই আশা করে থাকে, কবে আমি কারও বাড়িতে যাব। কবে, সেই মানুষটা নতুন জামার গন্ধ পাবে শরীরে সেটাকে চাপিয়েই। আমার আত্মীয় বাচ্চারা আশা করে থাকে আমার জন্য। ওদের কারও কাছে আমি দাদা। কারও কাছে আমি কাকু। কারও বা মামা। অথবা কারও বাবা। আর কারও বা আমি সন্তান। কারও ভাইপো। কারও ভাগ্নে। বড়রাও আশা করে থাকে এখন, কবে আসবো আমি? সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটা যে আজ অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। তাহলে সে নিশ্চয়ই আসবে হাতে করে নতুন কিছু নিয়ে। A মার্কা পুজো দেখতে দেখতে এভাবেই কাটিয়ে ফেললাম ১৮ টা। বয়স ৩৬ পেরিয়ে গেল। এবারও পুজোর এই চারটে দিন এটুকুই ভাববো। স্মৃতি হাতড়াবো। আজকের সঙ্গে মেলাবো। তুলনা টানবো। কখনও পুরনো কথায় হেসে উঠব। কখনও নতুন দিনে সামর্থ্যর কথা ভেবে কেঁদে উঠব। এভাবেই চারটে দিন চলে যাওয়ার পর অফিসে আসার সময় মানিব্যাগটায় হাত দিয়ে দেখে নেবো, হাতে তাহলে রইলো কী! ওই A মার্কা সিনেমা দেখতে না পাওয়া ১৮টা বছরের পুজোর স্মৃতি। বাকিটা আনন্দের কম। দায়িত্বের বেশি। আর দায়িত্ব বা চাপ কবে আর মন খুলে আনন্দ করে হাসতে দিয়েছে অভাবীকে? পুজোও নয়। এবার অপেক্ষা ১৯ নম্বর A মার্কা পুজোর অপেক্ষায় টাকা জমানো। অনেক দায়িত্ব। মা দুগ্গা - আশীর্বাদ করো, সামনের বার যেন সবার মুখে হাসি ফোটাতে পারি। ঠিক যেমনটা একদিন আমি নিজেও হাসতাম।