অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

তাঁর বিক্রমে একদিকে যেমন দেবকুলের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছিল, তেমনই প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল মর্ত্যের মানবকুলও। তাই সেই বীর পরাক্রম মহিষাসুরকে বধ করতে অবশেষে দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হন দেবকুল থেকে মর্ত্যবাসী। অবশেষে সেই মহিষাসুরের বিক্রমকে পরাহত করে পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের শুভ সূচনা হয়। দেবলোকে জন্ম নেন দেবী দূর্গা। সেই সঙ্গে মর্ত্যবাসীর মনেও শান্তি ফেরে। 


কিন্তু, এমন কী কখনও শুনেছেন, দেবী দুর্গার ত্রিশূলের আঘাতে যে মহিষাসুরের মৃত্যু হয়েছিল তাঁর কোনও বংশধর রয়েছে? তাও আবার এই পৃথিবীর বুকে? শুনে অবাক হলেন তো? ভাবছেন কী সব আজগুবি ঘটনা রে বাবা! গোটা ঘটনাটি নিয়ে নানা সময়ে নানা বিতর্ক চলে আসলেও, ভারতবর্ষের কিছু বিশেষ অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলেই মনে করেন। তাই আজও তাদের মধ্যে বেঁচে রয়েছে কিছু অদ্ভূত আচার-আচরণ। আজও তাঁরা হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তিকে পুজো করেন না। বিশেষ করে দেবী দুর্গা তাদের কাছে যমদূতের প্রতিনিধি হিসেবেই পরিগণিত হন। আর তাই আশ্বিনের শারদোত্সবের চারদিন এই 'অসুর বংশের' বংশধররা বাড়ি থেকে বেরোন না। পাছে দেবী দুর্গার কোপে বেঘোরে প্রাণটা হারাতে হয়। 


মা দুর্গার আরাধনার মাঝেই আপনাদের নিয়ে যাব সেই 'অসুরদের' সঙ্গে পরিচয় করাতে। ভারতের প্রাচীনতম উপজাতিদের একটি অংশ এই অসুর সম্প্রদায়। পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে ডুয়ার্সের একটি অংশ এবং ঝাড়খণ্ড ও দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশে বাস এই 'অসুর'দের। ডুয়ার্সের পাহাড়, চা-বাগান ঘেরা অরণ্যভূমিতে বাস এই অসুর সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের। এখনও শিক্ষার আলো সেভাবে তাঁদের কাছে পৌঁছায়নি। সেইসঙ্গে নেই সভ্যতার বিবর্তনও। এখনও তাঁরা নিজেদের আদিম সম্প্রদায়ভূক্ত বলেই মনে করেন। উপার্জন বলতে বন সংলগ্ন এলাকায় সামান্য চাষাবাদ। কেউ কেউ আবার অরণ্যের কাঠ, পাতা সংগ্রহ করে দিন গুজরান করেন। আর এসবের মাঝে তাঁরা যে ধর্মীয় আচার-আচরণ পালন করেন, তা সকলের থেকেই আলাদা। 


একটি দুটি পরিবার নয়, এমন 'অসুর'-এর সংখ্যাটা কয়েক হাজার। ১৯৯১ সালের আদমসুমারি অনুসারে এরাজ্যে অসুর বংশের সদস্যদের সংখ্যা ১০ হাজারের কিছু বেশী। তাদের ধারণা, দুর্গাপুজোর চারদিন দেবী মর্ত্যে আগমন করে অসুর নিধন করেন। সেই ভয় থেকেই আজও তাঁরা নিজেদের ঘরে বন্দি করে রাখেন। দুর্গাপুজোর চারদিন এই সম্প্রদায়ের মানুষরা বাড়ি থেকে বেরোন না। শুধু তাই নয়, দশমীর দিন মা দুর্গার বিসর্জনের পরই তাঁরা বাইরের আলোর মুখোমুখি হন। 


'অসুর' বংশের সদস্য সুষমা অসুরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এক সময় খনি থেকে লোহা তোলার কাজে নিযুক্ত ছিলেন এই অসুর উপজাতির সদস্যরা। তাদের কথায় 'মগধ' সাম্রাজ্যে তারা সেই কাজ করলেও, কালের বিবর্তনে এখন আর তাঁরা তা করেন না। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে বিভিন্ন উপজাতিভুক্ত মানুষদের চা-বাগানের কাজে লাগানো হয়। সেই সময়ই অসুরদের অনেকে সেই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তবে, আগের থেকে পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টেছে। বর্তমানে অসুর বংশের কেউ কেউ নিজেদেরকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসছেন। 


যদিও নিজেদের রীতি, রেওয়াজ সবকিছুই যেমন সেদিন ছিল, তেমনই রয়েছে আজও। ডুয়ার্সের ক্যারন চা-বাগানের বাসিন্দা এতয়ারি অসুরের কথায়, আমরা বছরে দু'বার অসুর পুজো করি। একটি 'ফাগুন' যা ইংরাজীর মার্চ ও এপ্রিল মাসে হয়, আর অন্যটি দুর্গাপুজোর দশমীতে। পুজোয় পরিবারের মহিলাদের কোনও ভূমিকা থাকে না। বরং গোটা পুজোটিই করেন পরিবারের পুরুষরা।



যতই তাদের নিয়ে নানা মত থাকুক, বর্তমান গবেষণা বলছে অসুররা ভারতের আর পাঁচটা উপজাতির মতোই একটি সাধারণ উপজাতি। সরকারি তরফে তাদের উন্নয়নের চেষ্টা করা হলেও, সরকারের প্রতি একরাশ ক্ষোভও রয়েছে সুষমা বা এতয়ারিদের। রীতি, আচার, আচরণ নয়; অসুরদের কাছে এখন প্রধান লড়াই বেঁচে থাকার... মা দুর্গার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলেও সেই লড়াইয়েই যেন এক হয়ে গেছে 'দেবকুল' ও 'অসুরকুল'।