অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সময়টা নেহাতই কম নয়। আজ থেকে প্রায় ৬০০ বছর আগের ঘটনা। তবে, ঘটনাটা তৎকালীন পূর্ববঙ্গের(বর্তমান বংলাদেশের) পাবনা জেলার হরিহরপুরের। সেখানকার রাজা ছিলেন কংসনারায়ণ রায়। একদিন স্বপ্নাদেশ পান তাঁর বাবা। বাবার কথা রাখতেই পুজো শুরু করেন রাজামশাই। প্রতিষ্ঠিত হয় অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তি। অত্যন্ত নিয়ম নিষ্ঠা মেনে বংশের কূলপুরোহিত পুজো শুরু করেন। বছরের ৩৬৫ দিনই চলত সেই পুজো। তবে, দুর্গাপুজোর চারদিন বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা করা হত।


রাজপাটের সঙ্গে পুজোও চলছিল নিয়ম মেনেই। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস! হুসেন শাহের নেতৃত্বে ঠিক সেই সময়ই সুলতান বাংলা আক্রমণ করেন। পাবনার সিংহাসন থেকে ক্ষমতাচ্যুত হন রাজা কংসনারায়ণ রায়। ভিটেমাটি ছেড়ে একপ্রকার কপর্দক শূন্য হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু এতকিছুর মধ্যেও আগলে রেখেছিলেন অষ্টধাতুর মূর্তি। সেই মূর্তি নিয়েই রাজপাট ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েন কংসনারায়ণ।


লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে গিয়ে পৌঁছান টাঙ্গাইলের রাজা শ্রীহট্ট সেনের আশ্রয়ে। তাঁর কাছেই গোটা ঘটনাটা খুলে বলেন কংসনারায়ণ। বন্ধুবর শ্রীহট্ট সেন কংসনারায়ণকে তখন টাঙ্গাইলের একটি অংশে একটুকরো জমিতে জায়গীরদার হিসেবে বসান। সেখানেই তখন প্রতিষ্ঠা করা হয় অষ্টধাতুর দেবী মূর্তিকেও। সেই সময় থেকেই তাঁদের রাজচক্রবর্তী সম্মানে ভূষিত করা হয়।


এরপর থেকে টাঙ্গাইলেই বছরের পর বছর ধরে পুজিতা হয়ে আসছিলেন দেবী। সময় পাল্টেছে। পাল্টেছে একের পর এক বংশধর। সেইসঙ্গে পাল্টেছে পুজোর কিছু আচার-অনুষ্ঠানও। কিন্তু এরপরই ঘটে সেই ঘটনাটি।


বিংশ শতাব্দীর একদম গোড়ার দিকে হঠাত্ই একদিন রাজা কংসনারায়ণের বংশধর দুর্গানাথ চক্রবর্তী স্বপ্নাদেশ পান যে, দেবী এবার থেকে আর ওই অষ্টধাতূর মূর্তিতে নয়, বরং মৃণ্ময়ী মূর্তিতে পূজিতা হতে চান। দিন কয়েকের মধ্যেই সেখানকার প্রধান কারিগরও একই স্বপ্ন দেখেন। আর তারপর থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পুজোর চারদিন অষ্টধাতুর পাশাপাশি সেখানে পুজো করা হবে মায়ের মৃণ্ময়ী মূর্তিকেও। আর তারপর থেকেই চলে আসছে এই পুজো।


এরপর আরও কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে। কালের নিয়মে আজ আর জীবিত নেই দুর্গানাথবাবু। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গোটা পরিবারটিই চলে আসে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলায়। সেখানে পাণ্ডাপাড়ায় ফের প্রতিষ্ঠিত হন দেবী। শুরু হয় পুজো। এক্ষেত্রেও নিয়ম-নিষ্ঠায় কোনও বদল ঘটেনি।


পুজোতে ব্যতিক্রম বলতে শুধুমাত্র মূর্তির ক্ষেত্রে। এখানে দেবীর সঙ্গে থাকেন না লক্ষ্মী ও সরস্বতী। সঙ্গে থাকেন শুধু কার্তিক ও গণেশ। তবে সেখানেও ব্যতিক্রম। দেবী মূর্তির ডানপাশে অধিষ্ঠিত কার্তিক ও বামপাশে গণেশ।


পরিবারের বর্তমান কর্তা তথা বংশের জ্যেষ্ঠ সদস্য মধুসূদন চক্রবর্তী জানিয়েছেন, আজ থেকে ছ’শো বছর আগে যে রীতি মেনে পুজো করা হত, আজও সেই ধার্মিক রীতি মেনেই হয়। তবে, কিছু বিষয়ে বদল এসেছে। ১৯৯৭ সালের পর থেকে পুজোর সময় বলি প্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুজোয় ষষ্ঠী, সপ্তমী ও অষ্টমীতে নিরামিষ রান্না হলেও, নবমীতে কিন্তু মা মাছ খান। সেদিন বোয়াল মাছের ঝোল দিয়ে মাকে ভোগ দেওয়া হয়।


দেবী মাকে একবার দর্শনের আশায় পুজোর দিনগুলোয় বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ভিড় জমান পাণ্ডাপাড়াতে। এদিকে পরিবারের বর্তমান সদস্যদের আশঙ্কা, প্রাচীন এই পুজোর ভবিষ্যত ভালো নয়, অচিরেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।


ইতিহাসের পাতায় রাজা কংসনরায়ণের পুজোই এখনও পর্যন্ত বঙ্গদেশের সবথেকে পুরনো পুজো বলেই পরিগণিত হয়। যদিও, এব্যাপারে আবার দ্বিমতও আছে।


তথ্যসংগ্রহ ও ছবি : নীলেশ্বর স্যান্যাল