হাতে সময় ছিল মাত্র ৩ সপ্তাহ। ঘড়ি ধরে মাত্র ১০ ঘণ্টা সময়ের কিছু বেশি। তারমধ্যেই কিছু করতে হবে। এমন কিছু করতে হবে, যা হবে একটু আলাদা। শুরু হল 'রান্নাঘর'... একদিন স্বামী অগ্নিদেব চ্যাটার্জি যাঁর হাতে 'চিংড়ির রাবড়ি' খেয়ে তারিফ করেছিলেন...আজ ১১ বছর ধরে 'রান্নাঘর' সামলাতে সামলাতে তিনি এখন আম বাঙালির হেঁশেলের মুখ সুদীপা চ্যাটার্জি। পুজো আসছে। 'মা' কে কী খাওয়াবেন, আর অতিথিদেরই বা নতুন কী পদ খাওয়াবেন, সেই এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে তাঁর ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। তারই মাঝে তাঁর 'রান্না জার্নি'র গল্পের ডালি খুলে বসলেন সুদীপা। বাদ গেল না রোমে অক্টোপাস খাওয়ার কথাও। খাওয়ার টেবিলে জমিয়ে আড্ডায় মুখোমুখি সুদেষ্ণা পাল


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING


সুদেষ্ণা : সঞ্চালিকা হওয়ার জন্য আরও অনেক বিষয়ের মধ্যে রান্নাকেই বেছে নিলে কেন?
সুদীপা : সেসময় আমরা স্ট্রাগল করছি। নিউজ রিডার হিসেবে কয়েকদিন কাজও করেছি। নতুন কী করা যায়? বন্ধুরা সবাই মিলে তখন শুধু সেই প্ল্যানিং চলত। এমন সময় ৩ সপ্তাহের জন্য দিনে ৩০ মিনিটের একটা স্লট পেলাম হাতে। এমন কিছু করতে হবে যা মানুষের মনে দাগ কাটে। সেই তাগিদ, ভাবনা থেকেই 'রান্নাঘর'।


সুদেষ্ণা : এর আগে 'বেণুদির রান্নাঘর', নন্দিনী পালের 'ব্যঞ্জনবর্ণ' দারুণভাবে সফল হয়েছে। তারপর এই চ্যালেঞ্জটা?
সুদীপা : প্রথম থেকেই ঠিক করেছিলাম এমন কিছু একটা করব, যেটা বাকি রান্নার অনুষ্ঠানগুলো থেকে আলাদা হবে। সেই ভাবনা থেকেই আসে 'আড্ডাচ্ছলে রান্না'। এই কনসেপ্টটা আমারই। অনেকেরই অনেক প্রতিভা থাকে। কেউ ভালো গান করতেন, কেউ আবৃত্তি। কেউবা হয়তো ভালো আঁকতেন। কিন্তু সংসারের কাজের চাপে সেই গুণগুলো চাপা পড়ে গেছে। একদিনের জন্য হলেও রান্না-আড্ডার মধ্যে দিয়ে তাঁর সেই গুণটাকে সবার কাছে তুলে ধরা। "একদিনের সেলিব্রিটি"। আমি দর্শক থেকে অতিথিদের সেই 'ফিল'টাই দিতে চেয়েছিলাম।


সুদেষ্ণা : প্রথমদিকে 'রান্নাঘর'-এ কেমন ছিল দিনগুলো?
সুদীপা : টাফ টাইম.... (কিছুটা থেমে) হাতে সেভাবে কোনও টাকা নেই। হো-চি-মিন সরণিতে একটা ফ্ল্যাট তখন বিক্রি হচ্ছে। প্রায় সব ঘর বিক্রি হয়ে গেছে, কোনও না কোনও অফিসের জন্য। পড়েছিল শুধু বাথরুমটা। সেই বাথরুমের বাথটাবটা সাজিয়েই শুরু হল শুটিং। ফ্যান বন্ধ করলে কুলকুল করে ঘামছি। মেক-আপ গলে যাচ্ছে। আর ফ্যান চালালে রান্না হবে কী করে? কোনও গিফ্ট নেই! নিজেদের উদ্যোগে বই কিনে গেস্টদের গিফ্ট দিতাম আমরা।


সুদেষ্ণা : রান্না শেখা কার কাছে?
সুদীপা : মা। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। এক্কেবারে খাদ্যরসিক বাঙালি পরিবার বলতে যা বোঝায়। ছোটবেলা থেকে মা, মামণি মানে জ্যেঠিমাকে দেখেছি সারাদিন রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে। ৩২ জনের পরিবার। ৩২ রকম পছন্দ। সবাইকে সবার পছন্দের রান্নাটা খাওয়াতে চেষ্টা করতেন ওঁরা। উত্সব মানেই আমাদের বাড়িতে আগে রান্না। কোন পদ রাঁধা হবে? কী করে রাঁধা হবে? দুর্গাপুজোর সময় জামাকাপড় কেনার আগে প্ল্যানিং হত পুজোর চারদিন কী রান্না হবে! এমন পরিবারে বড় হওয়ায় রান্না করাটাই আমার কাছে সবচেয়ে সহজ ছিল। 


সুদেষ্ণা : রান্না নিয়ে নিরন্তর উত্সাহ কার কাছ থেকে পান?
সুদীপা : আমার শ্বশুরবাড়িও খুব খাদ্যরসিক পরিবার। মনে আছে, বিয়ের পর প্রথমবার 'চিংড়ির মালাইকারি' রান্না করেছি। খেয়ে উঠে অগ্নি বলেছিল, "চিংড়ির রাবড়িটা দারুণ রেঁধেছ!" (বলেই হাসি...) আসলে বাপেরবাড়ি ছিল ঘটি। পুরনো অভ্যাসমতো একটু মিষ্টি দিয়ে ফেলেছিলাম। আর আমার শ্বশুরবাড়ি বাঙাল। এখনও আমার রান্নার সবচেয়ে বড় সমালোচক আমার স্বামী অগ্নিই। পাশাপাশি উত্সাহ-অনুপ্রেরণা তো বটেই। ওর সঙ্গে দেশে-বিদেশে অনেক ঘুরেছি। সেখানকার রান্না টেস্ট করেছি। শেফদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের কাছ থেকে নতুন নতুন আইটেম শিখেছি। মনে আছে, রোমে একবার অক্টোপাসের একটা ডিশ খেয়েছিলাম। 


সুদেষ্ণা : 'রান্নাঘর'-এ নিজের কাজ নিয়ে নিজে কতটা খুশি?
সুদীপা : আমি কখনও আমার কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট হই না। সবসময় মনে হয়.. ইসসস! যদি মীরের মত মজা করতে পারতাম। যদি রচনাদির মত প্রাণ খুলে হাসতে পারতাম। সৌরভ গাঙ্গুলির মত যদি বুদ্ধিদীপ্ত চোখে মিষ্টি হাসিটা দিতে পারতাম। আমরা সবাই তো অভিনেতা-অভিনেত্রী। মনে আছে, জ্যেঠুর মৃত্যুর দিনেও এসে শ্যুট করেছিলাম। কান্না চেপে রেখে হেসেছিলাম। এখন মনে হয়, যদি আরও ভালো করা যেত....(বোঝা গেল নিজের রান্না, কাজ সব নিয়েই বেশ খুঁতখুঁতে সুদীপা)।


সুদেষ্ণা : পুজোয় কোনও স্পেশাল আইটেম?
সুদীপা : চারদিন চারবেলা মায়ের ভোগ রান্না আমি-ই করি। পুজোয় স্পেশাল বলতে... নবমীর দিন আমাদের বাড়িতে একটা স্পেশাল আইটেম হয়, 'নিরামিষ মাটন'। মাকে ভোগ দেওয়া হয়। এটা আমার দিদিমার ময়মনসিংহের রেসিপি। আর দশমীর দিন হয় 'রসুন বাটা দিয়ে ইলিশ ভাপা'। এদুটো আমাদের বাড়ির পুজোর স্পেশাল মেনু।


সুদেষ্ণা : পরবর্তী পরিকল্পনা?
সুদীপা : একবছরের মধ্যে 'সুদীপার রান্নাঘর'-এর ২টো ব্রাঞ্চ খুলেছে। বাংলাদেশ থেকে, বিশেষ করে ঢাকা থেকে অনেক অফার পাচ্ছি। রেস্টুরেন্ট খোলার জন্য। আসানসোল, বর্ধমানে 'সুদীপার রান্নাঘর' খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।


সুদেষ্ণা রান্না নিয়ে বই লেখার প্ল্যান আছে কোনও?
সুদীপা : হমম... আল্টিমেটলি ২০১৭ বইমেলায় আমার রান্না নিয়ে একটা বই বেরোচ্ছে। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম। একটু অন্যরকম একটা রান্নার বইয়ের কথা। কিন্তু কিছুতেই আর সময় হচ্ছিল না। অবশেষে লালমাটি প্রকাশনার তরফে উদ্যোগ নেয়। অন্যরকম একটা রান্নার বই। তবে প্ল্যানটা এখনই বলছি না। আশা করছি, মজা পাবেন বইটা দেখলে। ভালো লাগবে।


সুদেষ্ণা : তোমার নিজের কী খেতে সবচেয়ে ভালো লাগে?
সুদীপা : কোথা থেকে শুরু করি! (বলেই হেসে খুন...) আমি নিম-বেগুন দিয়ে একথালা ভাত খেয়ে নিতে পারি। আবার বিরিয়ানিও ভালো লাগে। চারাপোনা মাছের ঝোল...কন্টিনেন্টাল সেটাও। আসলে আমার খাওয়াটা বেশি মুড আর সময়ের উপর নির্ভর করে। এই যেমন গরমকালে কাঁচা আম দিয়ে কোনও পদ। বর্ষাকাল হলে গন্ধরাজ লেবুর গন্ধটা দারুণ লাগে। শীতকালে যেমন ফুলকপি।    


সুদেষ্ণা : শেষ প্রশ্ন, আজকের দিনে গুগল সার্চ ইঞ্জিনে যখন সব উত্তর পাওয়া যায়, তখন জেন এক্স-ওয়াই এর কাছে পৌঁছানোটা কতটা টাফ?
সুদীপা : ওভাবে ভাবছি না। আমার থিওরি, 'গো উইথ দ্য টাইম'। শুধু রান্না দেখানো নয়। রান্নার পদ্ধতি শেখানোর উপরও এখন আমি জোর দিচ্ছি। যে পদ্ধতিটা নেটে হাতে ধরে কেউ শিখিয়ে দেবে না। বিশ্বের দরবারে ভারতীয় খাবার বলতে শুধু পাঞ্জাবি বা ইউপি-র থালি নয়। বাংলা খাবারে যে এত বৈচিত্র্য আছে, সেটা তুলে ধরাও আমার একটা লক্ষ্য বলতে পারেন। (হাসি...)