স্মৃতির জলছবি
কুশল মিশ্র
একটা স্কুলের কথা খুব মনে পড়ছে
বৃষ্টিকালে বাতাবি লেবুর গা ভেজা স্কুলে কোমরে ঘুমসি বাঁধা একটা ছেলের স্কুল
সে ছেলের চোখগুলো ডাগর, কাজলকালো...
একটা স্কুলের কথা আজ আমার খুব মনে পড়ছে
অ্যাসবেস্টারের ছাউনি দিয়ে যে স্কুলটায় বৃষ্টিকালে জল গড়াত
খুব বৃষ্টিতে ঝাপসা বাতাবি লেবুর গাছ
সূর্যমুখী বাগান, দূরের পুকুর...
একটা স্কুলের কথা আজ আমার খুব মনে পড়ছে
সেই স্কুল, বৃষ্টিকালে অঝোর বৃষ্টি...ছুটির ঘণ্টা...
ছুটির পরেও অঝোর বৃষ্টি...স্কুল ফাঁকা...
শুধু আমি আর বাতাবি লেবুর গাছ,
বাকি সব ঝাপসা...
তখনও বৃষ্টি পড়ছে।
একটা দিনের কথা খুব মনে পড়ছে
সেদিনও বৃষ্টি দিন
সেদিনও আকাশে নীরবতা
আমার ঘুপচি ঘরের ত্রিকোণ দেওয়ালে
চারকোলের আঁকিবুকি
আমার মোম পেন্সিল- প্যাস্টেল, জলরঙ
আমার প্রেমের জলছবি
বাউল কাগজ রঙ শুষে নিচ্ছে দ্রুত
ওর সারা গায়ে গেরুয়া আগুন
ঘাড়ের কাছে পড়ছে নীল নি:শ্বাস
তারমধ্যে একটা মেটে পথ আঁকছি
মোমের খসখসে রঙে তৈরি হচ্ছে সেই রাস্তার দেহ, শরীরে বাঁক, অলি, গলি
আমি বড্ড আদুরে তখন, বড্ড মেঘলা
ক্যানভাসের মেঘ ভাসছে তখন অন্ধকার ঘরে
সেই মেঘ এখন আমার তাকিয়ায় উঠল
ওমা! মেঘ যে আমার সারা মুখে, শরীরে ভেসে বেড়াচ্ছে...
ঘরের ভেন্টিলেটর দিয়ে একটা গুটিপোকা ঢুকল
সে এসে শুরু করল স্বপ্ন জালের বুনন
সারা ঘর ছেয়ে যাচ্ছে মশলিনি চাঁদোয়ায়
ততক্ষণে ঘরের ছাদটা পুরো খেয়ে ফেলেছে মেঘ বালিকা মেঘনা
গুটিপোকার আলতো লালায় তৈরি হচ্ছে রামধনু
সাত রঙের সাত বাহার
এবার দেখি সেই মেঘ জমতে শুরু করেছে বুকের ওপর
কালো মেঘের রঙ। সমুদ্রের মতো শ্যামাঙ্গী।
তরঙ্গ-বিদ্যুতে ঝলসে যাচ্ছে আমারা দেহাতী শরীর
পোড়া মন
বৃষ্টির মধ্যেও যে বৃষ্টি পড়ে...মেঘের মধ্যে মেঘ
আমার হঠাত্ করে জল তেষ্টা পেল
আমি হাত বাড়ালাম
আমার পা ভাঙা টেবিলটায় দেখলাম টেবিলটা নেই ওখানে
ওখানে মাটি জমে জমে অযোধ্যা পাহাড়
ওর গায়ে কত অপ্সরা নন্দিনী
কত সবুজ গুল্ম
কত হারানো পাখির কলতান
মনে মনে ভাবলাম
যাক টেবিলটার যা হোক একটা সদগতি হল
কতদিন ভাঙা পায়ে দাঁড়িয়ে বয়েছে আমার বইয়ের ব্যাগ,
জলের জগ..রঙের প্যালেট, আর্ট পেপার
ডাঁই কাগজের বোঝা
কত অস্ফুট অচেনা ছবি, যন্ত্রণা।।
অকেজো টেবিলের ছেড়া টেবিল ক্লথে পড়েছে কত বৃষ্টির ফোঁটা
নিরঙ্কুশ এই জীবনের ছলনা কাটিয়ে অবশেষে টেবিল আজ মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলছে
আজ-ও বলিষ্ঠ পাহাড়।।
এমন সময় হঠাত্ করে কড়কড় করে বাজ পড়ল ঘরের ফুলদানিতে
সেই আলোতে দেখলাম টেবিলটা আমার ভেঙচি কেটে ফের পাহাড় ছ্যাঁত্ করে উঠল বুকটা
রথের মেলা থেকে স্কুলের টিফিন বাঁচানো পয়সায় কেনা ফুলদানিটার কথা ভেবে
মনে হল কই কোনওদিন কাগজে তো বেরোয় না বাজ পড়ে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে এক কিশোরী ফুলদানি
যার রুটি-রুজিই ছিল ফুল আঁকড়ে বেচা
এরকমতো কত মৃত্যু হয়,লাশ কাঠা ঘরে জমা হয় দুর্ঘটনাগ্রস্থ হৃদয়
পোস্ট মর্টেমে কোথায় ধরা পড়ে আসল কারণ
হঠাত্ দুষ্টু মেঘ এসে চিমটি কাটায় ঘোর ভাঙল
দেখি ফুলদানিটাও আর নেই
ওটা একটা খরস্রোতা নদী।।
ডুংলী নদীর মতো বুনো ছন্দে তিরচিরিয়ে ঘুঙুর পরে নেচে নেচে নেমে আসছে পাশের পাহাড়টা থেকে
ঘরময় ভাসছে জংলাডুবির গন্ধ
যে ভাঙা টেবিল অশক্ত শরীরে এতদিন এই ফুলদানিকে পিঠে বয়েছে
আজ সেই টেবিলটাই পাহাড়, ফুলদানি এখন নদী
ঘরটা ক্রমশ ভাঙছে
কোনও এক বিনির্মানের জাদুতে ভর করছে
আমার ভাঙা স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল
আমার এবড়ো খেবোড়ো ঘর
ঘরের কুলুঙ্গিতে থাকা প্রাচীন মহাদেবও ম্যাজিক রিয়ালিজমে খাজুরাহোর স্থাপত্য, কিম্বা কালিদাসের উজ্জ্বয়িনী
মেঘদূতের আগমণে আমার ঘর আস্তে আস্তে স্পিরিটের মত উবে যাচ্ছে
উবে যাচ্ছে ঘরের দেওয়াল, ছাদ, ছাউনি, সব সীমান্ত
সেই কোমল, স্নিগ্ধ, জোত্স্না গায়ে মেখে উদ্বাহু নৃত্যরত আমার মেঘনা
ছেলেবেলায় যার চরে আমার রাত কেটেছে কত অবহেলায়
কত স্মৃতির
হাতছানি ছিল সে মেঘনার জলো হাওয়ায়।।
ঘরের দেওয়াল উবে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি চরাচর বিস্তৃত এক আদিগন্ত মাঠ
দ্বিমাত্রিক সে ছবি
সেটাই তখন আমার কাছে এক আস্ত পৃথিবী
যার অর্ধেক আকাশ, অর্ধেক মাটি
সে ছবির দেওয়াল জুড়ে শুধুই অঝোর বৃষ্টি
ক্রমশই ছবিটা ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠল
এবার একই ক্যানভাসে আমি, মাটি আর আকাশ
এখন আর আমার কোনও ঘর নেই, কোনও গন্তব্য নেই
কোনও লক্ষ্য নেই, মোক্ষ নেই, ক্লান্তি নেই, শুধুই আনন্দ
অনাবিল আনন্দ
আমি সর্বজনীন এক মানুষে পরিণত হয়েছি তখন।।