পার্থ প্রতিম চন্দ্র


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ঘটনাটা শোনা আমার জামাইবাবুর মুখ থেকে। বারমুডার এক হোটেলে আমার জামাইবাবু পূর্ণেন্দু দে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। সেটাই হল বারমুডার সবচেয়ে বড় হোটেল। মার্কিন পর্যটকদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গাগুলির তালিকায় উপরের দিকে থাকে বারমুডা। সেই বারমুডায় ঘুরতে গেলেন ক্লিনটন দম্পতি। বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটন। আজ থেকে বছর দশেক কথা। নিখাদ ছুটি কাটাতে বারমুডায় যাওয়া ক্লিনটন যুগল সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তায় মোড়া সেই হোটেলেই উঠলেন। বিল বেশ কয়েকবছর আগে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে গেলেও নিরাপত্তা,খাতির দেখলে তা বোঝার উপায় নেই।  


হোটেলের সবচেয়ে উঁচু তলায় সবচেয়ে দামি ঘরে নির্জনে থাকার ব্যবস্থা হল ক্লিনটনদের। নিরাপত্তার জন্য হোটেলের অনেককে অন্যত্র সরানো হল। বিল ক্লিনটনের অনুরোধে যে ফ্লোরে তাঁরা থাকবেন সেখান থেকে নিরাপত্তাকর্মীদের সরিয়ে দিতে হল। তবে হোটেলের প্রতিনিধি হিসেবে, ভিভিভিআইপি অতিথিদের যত্নআত্তিতে যাতে ত্রুটি না হয়, তাই রাখা হল একজন বিশেষ প্রতিনিধি। আমার জামাইবাবুর ওপর দায়িত্ব বর্তাল ক্লিনটনদের যাবতীয় দেখভালের। মানে সেই বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োজিত হলেন আমার জামাইবাবু। তবে শর্ত একটাই-উনি ছাড়া হোটেলের আর কেউ সেই ফ্লোরে উঠতে পারবে না। কারণ ক্লিনটনরা একেবারে একা সময় কাটাতে চান। নিরাপত্তার স্বার্থে জামাইবাবুর পাসপোর্ট, ওয়ার্ক ভিসা সহ যাবতীয় জিনিস পরীক্ষা হল। তারপরই মিলল ক্লিনটনদের অন্দরমহলে প্রবেশের ছাড়পত্র। ঠিক ছিল ক্লিনটনরা এক রাত কাটিয়েই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অন্য একটা দ্বীপে চলে যাবেন। জামাইবাবুর মুখ থেকে শোনা সেই ক্লিনটনদের এক দিনের কাহিনি। জামাইবাবু দেশে ফিরে আমায় গল্পটা বলেছিলেন। সেটাকেই একটু সাজিয়ে লিখলাম---


ছাদের ওপর চক্কর কাটছে কপ্টার। হোটেলের চারিদিকে গোয়েন্দা। হোটেলের বিভিন্ন জায়গায় বসে আইয়া চেহারার মার্কিন পুলিস। মনে হচ্ছে হোটেলে যেন কোনও যুদ্ধ হচ্ছে। একটা সময় সব চুপচাপ। পিন পড়লেও মনে হবে কারও চায়না ফোনের রিংটোন বাজছে। এসে পড়লেন, বিশ্বের ক্ষমতাশালী দেশের দুই ক্ষমতাবান মানুষ। যারা সম্পর্কে আবার দুজনে দুজনের সবচেয়ে কাছের মানুষ। ক্লিনটনদের আমার দেখা, খবরের কাগজে আর আমার ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভিতে। বাড়িতে যখন কালার টিভি এল, তখন আমি বিদেশে চাকরি করছি। আর বিদেশে কাটানো মানুষদের কাছে সবচেয়ে বড় খবর হল, লড়াই, বেঁচে থাকা, টিকে থাকা আর আরও আরও ডলার রোজগার করা। যাতে গরীব দেশে ফিরে আর কর্মখালি বিজ্ঞাপনে নজর না দিতে হয়। তাই ক্লিনটনদের ভিডিও কখনও রঙিনভাবে দেখার সময় হয়ে ওঠেনি। এই প্রথম রঙিন দেখলাম। রঙীন বলতে যা বোঝায় তার চেয়ে অনেক বেশি রঙীন। কে জানে ক্ষমতাশালী মানুষদের স্বচক্ষে দেখলে হয়তো রঙিন বেশি দেখায়, কিংবা চোখটাই রঙীন হয়ে যায়। ক্লিনটনদের সঙ্গে হোটেলে ঢুকল সাতজন সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী।


হোটেলে ঢুকেই চারিদিকটা দেখলেন বিল। হিলারি একটু দূরে কাকে যেন কী একটা বলতে গেলেন। একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বিল ডেকে নিলেন স্ত্রীকে। দুজনের মুখে মিষ্টি হাসি। তারপর দুজনে গল্প করতে করতে সোজা সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। নিরাপত্তারক্ষীরা তখন কার্যত 'রে রে করে' উঠলেন। কোটিপতি হোটেলের মালিকও যোগ দিলেন সেই 'রে রে' রবে। 'স্যার লিফট আছে, লিফট।' বিল ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, লিফটে নয় হেঁটেই উঠব। একটু নিখাদ ছুটি কাটাতে চাই, তোমরা আমাদের স্বাভাবিক হাঁটা চলায় বাধা দিও না। আর প্লিজ বাকি পথটা আমাদের সিকিউরিটির কোনও দরকার নেই।


শুরু হল ক্লিনটনদের সিঁড়ি ভাঙা। আমারও ডিউটি শুরু হল। নিরাপত্তারক্ষীদের উপরে ওঠার সুযোগ নেই। ক্লিনটনরা হেঁটে চললেন সিঁড়ি দিয়ে, আমি চললাম পিছন পিছন। একা। আমি যেন একটা উন্নয়নশীল দেশ। আমার সামনে আমেরিকা, বিশ্বের সবচেয়ে পাওয়ারফুল দেশ। আমি পাওয়ারকে সম্মান জানিয়ে পিছু পিছু অনুসরণ করছি। যাতে আমিও ওদের মত পেল্লাই প্রাসাদ, ঢেঁকুরতলা অর্থনীতির কাঠামো গড়তে পারি। যেন ওটাই আমার মডেল। মার্কিন মডেল।    


চার তলায় হাঁটতে কত সময় লাগতে পারে? ক্লিনটনরা তার চেয়ে একটু বেশি সময় নিলেন। অসাধারণ সুন্দর হোটেলের দিকে দুজনের নজর নেই। কিছু একটা বিষয়ে দুজনে গভীর আলোচনা করছেন। কেন যেন মনে হল এ আলোচনা আর যাই হোক আফগান যুদ্ধ, মার্কিন প্রশাসন নিয়ে নয়। এ যেন দুই দম্পতির কোনও ব্যক্তিগত টানাপোড়েনের আলোচনা। একেবারে গ্রাউন্ড ফ্লোরে দুজনকে যেভাবে কথা বলতে দেখেছিলাম, তলা বাড়তেই কথার ধরনগুলো কেমন যেন বদলে গেল।


তিন তলায় এসে ওদের খেয়াল হয়েছে, পিছনে কেউ একজন আছে। অবশ্য পাওয়ারফুল দেশরা কোনদিনই বা অন্য দেশেদের অস্তিত্ব খেয়াল করেছে। চার তলায় পা দিয়েই বিল বললেন, হাই ইওর নেম?কানটা একটু বুজে এল বোধহয়। নিজেকে পিঠ চাপড়ে মনে মনে সাধারণ জ্ঞানের স্যারকে বলতে ইচ্ছা করল ১৯৮৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাম বলতে পারিনি বলে দমদমের যে পূর্ণেন্দুকে কান ধরে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিলে, তাকেই কিনা খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ার বসা একটা লোক নাম জানতে চাইছে? এ যেন পর্বতে চড়তে না পেরে ট্রেকারের জ্বালা বুঝে, খোদ পর্বতই পিঠটা একটু নিচু করে বলল, 'নাও এবার আমার ওপর চড়ে জ্বালা জুড়োয় দেখি।'নামটা বলেছিলাম, পদবটি বলতে যাব, ওয়াকিটকিটা বেজে উঠল। কিছু একটা বলতে যাব। হিলারি নিজেই বললেন, অ্যাটেন্ড দ্য কল। হোটেল মালিক ওয়াকিটকিতে বললেন, পূর্ণেন্দু, মেক শিওর, দে গেট বেস্ট হসপিটালিটি, আই নো ইও আর দ্য বেস্ট ইন দিস বিজনেস। আমি সাড়া করতে পারলাম না। ক্ষমতাবানদের কাছে সর্বহারারা একটু কেমন যেন গুম মেরে যায়, আমার বোধহয় সেই দশা।


দু ঘণ্টা হয়ে গেল। ক্লিনটনদের ঘর বন্ধ। ঘরের নম্বরটা ৪০৪। আমি চাতক পাখির মত ডাকের অপেক্ষায়। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা হোটেলের মালিক, নিরাপত্তারক্ষীদের অবস্থা তো চাতক পাখিদের চাওয়ার থেকেও বেশি চড়া। সবার গলাগুলো জিরাফের মত উঁচুর দিকে তাকানো। মাঝেমাঝেই আমার ওয়াকিটকিতে ফোন আসছে। পূর্ণেন্দু, ডু দে ওপেন দেয়ার ডোর? আমি অন্তত বার দশেক বলেছি, স্টিল নট।


সবে একটু জল খেতে যাব, হঠাত্‍ মৃদু স্বরে ডাক। পূরনান্দু...কানটা এবার বর্তে গেল। যে আমেরিকান একটা পুঁচকে কোম্পানি আমায় একটা সামান্য টাকার চাকরি দিতে অস্বীকার করে ছিল, সেই দেশই এখন আমার নাম ধরে ডাকছে! এই না হলে পোয়েটিক জাস্টিস। বলতে ইচ্ছা করল, না পূর্ণেন্দু যাবে না। আমেরিকা তুমি নিজের কাজ নিজে কর, আমি তোমার সঙ্গে নেই। পূর্ণেন্দু হল ব্রিগেডে লাল পতাকার ভিড়ে রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ। মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মিছিলে পূর্ণেন্দুর হাঁটাতে একটুও ক্লান্তি লাগে না। পূর্ণেন্দু চে-এর সুরে সুর মেলায়। মার্ক্সের সঙ্গে স্বপ্নে কথা বলে। পূর্ণেন্দুর ঘরের দেওয়ালে লেখা, 'তোমার নাম, আমার নাম,ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।' পেট বলে জিনিসটা না থাকলে পূর্ণেন্দু এখন আমেরিকাকে থুতু দিত, থুতু। কিন্তু ওই যে পেট। পেটটাই যেন মুখটাকে ঠেলে বলাতে বাধ্য করাল ইয়েস স্যার... ঘরের ভিতর থেকে আওয়াজ এল, 'প্লিজ কাম।'


ঘরে ঢুকে থতমত হলাম বললেও কম বলা হবে। বিলের পোশাক বলতে শুধু একটা টাওয়েল। চোখকে বলতে ইচ্ছা করল, দেখ তোকে কী দেখালাম। গোটা বিশ্ব যে লোকটাকে দেখে কোর্ট টাই প্যান্ট পরা পোশাকে, তাকে তোকে দেখার সুযোগ করে দিলাম একেবারে বাঙালির গামছা পরার স্টাইলে। বিল খুব আস্তে করে বললেন, পূরনান্দু কেন ইউ প্লিজ অ্যারেঞ্জ আ ড্রিংক! আমি পড়া না করে আসা ছাত্র তার স্যারের সামনে যতটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাথা নাড়ে ঠিক ততটা পরিমাণেই ঘাড় নাড়ালাম।


বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। চার তলার ঝুলন্ত বারন্দায় দামি এক অত্যাধুনিক চেয়ারে বসে বিল। হিলারি পুলের সামনে দাঁড়িয়ে। ঝুলন্ত বারান্দার নিচে বারমুডার মন ভোলানো নীল সমুদ্র। দেশটা তো আসলে দ্বীপ। বিশাল জলের মাঝে ছোট একটা স্থলে কিছু মানুষের ক দিন ছুটি কাটানোর জায়গা। বাঙালির যেমন দার্জিলিং, তেমনই মার্কিনী অবস্থাপন্নদের (অবস্থাপন্ন কারণ এ দেশে সব কিছুই আকাশছোঁয়া খরচ) ট্যুর ডেস্টিনেশন হল বারমুডা। বিল, হিলারি এখন অনেকটাই খোলামেলা হয়েছেন। অনেকেই ওপরে উঠে এসেছেন। বিলের ঘরে ঢুকে যাচ্ছেন বেশ কয়েকজন অফিসার। ফোন, ল্যাপটপেও ব্যস্ত থাকতে দেখলাম হিলারিকে। বিল অবশ্য চোখ বন্ধ করে ওয়াকম্যানে ডুবে। সন্ধ্যা নামতেই বিলের নির্দেশে আবার সব ফাঁকা। আমি আবার ক্লিনটন দম্পতির নিখাদ ছুটির মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে। ক্ষমতাবান দেশরা অবশ্য তৃতীয় শব্দটা ডিকশেনারি থেকে তুলে দিয়েছে অনেক আগেই। আমি প্রথম, আমিই দ্বিতীয়, তৃতীয় আবার কী! তাই বোধহয় আমেরিকা যত ফুলছে ফাঁপছে, তৃতীয় বিশ্ব তো বাড়ছে। আরে বাবা তৃতীয় তো ডিকশেনারিতেই নেই। ওরা বাড়ছে বাড়ুক।


সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে। ক্লিনটনদের রুমের ভিতর আবার যেতে হল। এবার বিল আমায় প্রশ্ন করল, তুমি কোথাকার লোক?আমার বলার ইচ্ছা ছিল, যে দেশে তুমি যেবার পা রেখেছিলে, আমি সেদিন গো ব্যাক বলে স্লোগান তুলেছিলাম। কিন্তু ওই যে পেটটা আবার বলিয়ে নিল, ইন্ডিয়া। বিল হেসে উঠল। গ্রেট কান্ট্রি। ম্যাডাম হিলারি আবার আমায় তৃতীয় ব্যক্তি করে দিলেন।


আমি যে কাজটা করছিলাম, তাতে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। বারান্দার দরজাটা খুলে বিল আর হিলারি দাঁড়িয়ে রইলেন ব্যালকনিতে। নিচে সমুদ্র, উপরে পূর্ণিমার চাঁদ (ধরেই নিয়েছিলাম ওটা পূর্ণিমা, চাঁদটা প্রতিপদও হতে পারে)। দুজনের মধ্যে একটা দারুণ নি:স্তব্ধতা। বিল আর হিলারির সম্পর্কে কী কোথাও চিড় আছে?নাকি প্রেমটা এতটাই গভীর। আচ্ছা মনিকা প্রসঙ্গ কী এখনও দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে?


ওদের রুমের নম্বর ৪০৪। এই সুন্দর রাতে দুটো চারের মধ্যে ব্যবধান ঘুঁচে কি শূন্য হবে! জাতে খাঁটি বাঙালি বোলে এখন একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানোর খুব ইচ্ছা হচ্ছে। আচ্ছা ক্লিনটনরা কী রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে আরও একটু কাছে যাবেন!


দৃশ্যটা ভারী অদ্ভুত। ব্যালকনিটা অন্ধকার, একেবারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বিল, হিলারি। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশের অতি প্রভাবশালীদের তালিকায় একেবারে প্রথমের দিকে থাকা দুই মানুষ। আবার রাষ্ট্রের তুলনা চলে এল মনে। আমেরিকা অন্ধকারে মনের আবেগ দেখালেই, তৃতীয় বিশ্ব বোঝার চেষ্টা করে, এটা মেকি নাকি সত্যি। আবেগ নাকি ন্যাকামি। প্রেম নাকি পুঁজি। বিনিয়োগ নাকি বিয়োগ। আমার মনের অবস্থাটা খানিকটা তাই।   


কাজ শেষ হল। ঘর ছাড়তেই হল। ক্লিনটন দম্পতি এখনও ব্যালকনিতে। বলার ইচ্ছা ছিল, 'চললাম আমেরিকা। ভাল থেকো বলব না, বলব ভাল থাকতে দিও।' ১৮ ঘণ্টা ডিউটির পর এবার আমার ছুটি। পরদিন যখন হোটেলে আসব তখন ক্লিনটনরা বারমুডা ছেড়ে যাবেন। এখন আর দেশের তুলনা মনে আসছে না। এখন মনে আসছে প্রেমের কথা। ওদের প্রেম আর আমাদের প্রেম কত এক!