অনির্বাণ চৌধুরী


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ভ্যাটিকান সিটির রাস্তায় হঠাত্‍ শোনা গেল রবীন্দ্রসঙ্গীত। সেন্ট পিটার স্কোয়ারে তখন লাখো মানুষের সমাবেশ। সকলে চলেছেন সানডে মাসে অংশগ্রহণ করতে। কলকাতার মা টেরিজা হবেন সন্ত টেরিজা। সারা বিশ্ব থেকে এসেছেন হাজার হাজার, লাখো লাখো লোক। রোমান ক্যাথালিকেদের স্বর্গময় ধর্মযাজক পোপ ফ্রান্সিস সন্ত উপাধিতে ভূষিত করবেন আমাদের মা টেরিজাকে।


চমকে উঠলেন বিদেশ থেকে আসা অনেকেই। দলটা জনা কুড়ির। তাদের মুখে 'আকাশ ভরা সূর্যতারা'। একদম সামনে এক খর্বকায় মহিলা। তাঁর পরনে নীল পেরে সাদা শাড়ি। কলকাতার মানুষরা দেখলেই চিনতে পারতেন মমতা ব্যানার্জিকে। তাঁর পিছনে সরকারী আমলা, সাংসদ, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। অনেকেই কাজ ভুলে গলা মেলালেন কোরাসে। গান গাইতে গাইতেই, সেই ছোট্ট দলটা এগিয়ে চলল সেন্ট পিটার্স প্যাসিলিকা চার্চে, যেখানে হবে মূল অনুষ্ঠান।


গান গাওয়ার সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল, আগের দিন সন্ধ্যায়। মমতা ব্যানার্জি বিকেল পাঁচটাটাতেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, গানের রিহার্সাল শুরু হবে ঠিক রাত আটটায়। সেইমত হাজির হয়ে গিয়েছিলাম সকলেই। সঙ্গে সঙ্গে ফোটোকপি হয়ে গেল যে ,তিন চারটে গান গাওয়া হবে তার। প্রত্যেকেই হাতে হাতে পেয়ে গেলেন এক একটা কপি। শুরু হয়ে গেল রিহার্সাল। ভুলভ্রান্তিগুলো ঠিক করে নেওয়া গেল। সবাইকে বলে দেওয়া হল কোন লাইনগুলো, কতবার গাইতে হবে, কীভাবে। মোবাইলে ভিডিও তোলার ফাঁকে ফাঁকে বেসুরে গলায় গলা মেলালাম আমরাও। রিহার্সাল শেষ, পরের দিনের প্রতীক্ষা শুরু।



পরের দিন সকাল ঠিক ৯টায় হাঁটা শুরু হল হোটেল থেকে। আমাদের ছোট্ট মিছিল গান গাইতে গাইতে এগিয়ে চলল মূল অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে। মিনিট কুড়ির রাস্তা তাতে মুখরিত হল রবীন্দ্রসঙ্গীত ও কিছু বাংলা গানের। তত্‍ক্ষণে ভ্যাটিকান সিটির পুলিস আমাদের এসকর্ট করে নিয়ে গেল বিশিষ্ট অতিথিদের জায়গায়। মমতা ব্যানার্জি আগের দিন থেকেই গোঁ ধরে ছিলেন, তিনি ভিআইপি এনক্লোজারে বসবেন না। বসবেন মিশনারিজ অফ চ্যারিটি এবং কলকাতা থেকে আসা অতিথিদের সঙ্গেই। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়েও কর্তৃপক্ষ রাজি করাতে পারেননি তাঁকে। মূল মঞ্চের কাছে জটলা করেই দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা। অনুরোধ চলল তখনও। হঠাত্‍ দেখলাম ছুটতে ছুটতে আসছেন সিস্টার প্রেমা। মিশনারিজ অফ চ্যারিটির সারা বিশ্বের সর্বময়ী কর্তী। জড়িয়ে ধরলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে, হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন মূল মঞ্চের একেবারে সামনে। যেখানে বসেছেন কলকাতার মিশনারি অফ চ্যারিটির নান ও অন্যানরা। হাসি ফুটল মুখ্যমন্ত্রীর মুখে, আমাদেরও।


কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হয়ে গেল দু ঘণ্টার অনুষ্ঠান। পড়া হল বাইবেলের নির্বাচিত অংশ। গাওয়া হল ক্যারোল থিম সং। সেই প্রাচীন অরগ্যানের আওয়াজে মুখরিত হল সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারের প্রাঙ্গণ। কিছুক্ষণ পরেই চলে এলেন পোপ ফ্রান্সিস। খ্রীস্টধর্মের কিছু আচার পূর্ণ করেই বলতে লাগলেন, মাদার টেরেজার আর্তকে সেবা করার কাহিনি। ঘোষণা করলেন, এবার থেকে মাদার টেরেজা হলেন, 'সেন্ট টেরিজা অফ কলকাতা'। ঘোষণার মুহূর্তেই সারা ভ্যাটিকান প্রাঙ্গন মুখরিত হল লাখো মানুষের করতালিতে। বিভিন্ন দেশের মানুষ, তাঁরা হাত তুলে সাদরে নতুন সন্তকে ডেকে নিলেন হৃদয় মাঝারে।



প্রতি মুহূর্তে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। সাক্ষী হয়ে রইলাম এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের। মাত্র ৫০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছেন পোপ। মাথায় গনগনে আগুন। গলা শুকিয়ে কাঠ। কিন্তু ইতিহাসকে চাক্ষুষ করতে পেরে আর ঐশ্বরিক পরিবেশে সব শারীরিক কষ্টই ম্লান হয়ে গেল।


সাংবাদিক জীবনে অনেক বিরল ঘটনার সাক্ষী হই আমরা। কিছু মনে দাগ কাটে, কিছু ভুলে যাই চিরদিনের জন্য। কিন্তু সেদিন তো বসে আছি এক ইতিহাসের স্তূপের মধ্যে। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রোমান স্থাপত্যের নির্দশন, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মত ব্যক্তির হাতের ছোঁয়া তার ওপরে এক বিশেষ ঘটনার মুখোমুখি আমি। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল হাজার হাজার বছরের ইতিহাস আমাকে জড়িয়ে ধরছে, যখন ফেরার পালা তখন মনে হচ্ছিল একটা বিশাল স্মৃতির বোঝা বয়ে সারা জীবন থাকব। এবং অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে থাকব। সেদিনই হোটেলে ফিরে রাতের ঘুমটা এখনও অবধি জীবনের সেরা ঘুম।