সব্যসাচী বাগচী 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ব্রাজিল: ১ ('১০৫ নেইমার) 


ক্রোয়েশিয়া: ১ ('১১৭ ব্রুনো পেটকোভিচ) 


টাইব্রেকার 


ক্রোয়েশিয়া: ৪ 


ব্রাজিল: ২


ফের একবার বিপক্ষের কাছে ত্রাস হয়ে উঠলেন ক্রোয়েশিয়ার (Croatia) গোলকিপার ডমিনিক লিভাকোভিচ (Dominik Livakovic)। জাপানকে (Japan) টাইব্রেকারে রুখে দেওয়ার পর এবার নিজের জোড়া গ্লাভসে ব্রাজিলকে (Brazil) বিশ্বকাপ (FIFA World Cup 2022) থেকে ছিটকে দিলেন। ফলে নেইমারের (Neymar Jr) লড়াই ও গোল জলে গেল। দলের বাকিদের সঙ্গে তিনিও কেঁদে বিদায় নিলেন। আবার লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে ম্যাচের আগে সাংবাদিক বৈঠকে ঘাড় ধাক্কা খাওয়া বিড়ালটাই যেন হট ফেভারিট দলের রাস্তা কেটে দিল! 


২০০২ সালের পর থেকে এই নিয়ে পাঁচবার বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে ইউরোপের একাধিক দলের কাছে হারল ব্রাজিল। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বেলিজিয়ামের তালিকায় নাম লিখিয়ে পরপর দু'বার কাপ যুদ্ধের সেমি ফাইনালে চলে ক্রোয়েশিয়া। বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল ব্রাজিল। ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে ছিটকে গেলেন নেইমাররা। অতিরিক্ত সময়ে নেইমারের গোলেও লাভ হল না। ক্রোয়েশিয়া জিতে গেল ৪-২ ব্যবধানে। আবার টাইব্রেকারে বাজিমাত করল ক্রোয়েশিয়া। পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ফের হার দেখতে হল। ২০ বছর ধরে ঘাড়ে চেপে থাকা 'ভূত' এবারও সেলেকাওদের পিছু ছাড়ল না। 


কোয়ার্টার ফাইনালের থ্রিলার দেখে একটা ব্যাপার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সাংবাদিক বৈঠকে ঘাড় ধাক্কা খাওয়া সেই বিড়াল শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলের রাস্তা কেটে দিল! সেইজন্যই সেই ২০০৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত 'ভূত' ঘাড় থেকে এবারও নামল না। তবে ১০৫ মিনিটে সব হিসেব বদলে দিয়েছিলেন নেইমার জুনিয়র। যে ডমিনিক লিভাকোভিচ বারবার দেওয়াল হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই লিভাকোভিচকে ভেদ করেই গোল করে তিতে-সহ অগণিত সেলেকাওদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন ব্রাজিলের পোস্টার বয়। মাঝমাঠ থেকে খেলা শুরু করেছিলেন নেইমারই। প্রথমে পাস খেলেন পেদ্রোর সঙ্গে। সেখান থেকে নেইমার বল পেয়ে পাকুয়েতাকে। পাকুয়েতার থেকে পাস পেয়ে গোলকিপার লিভাকোভিচকে এক টোকায় কাটিয়ে বল জালে জড়ালেন নেইমার। সঙ্গে সঙ্গে দুলে উঠল এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে হলুদ রঙে রাঙিয়ে ওঠা গ্যালারি। মাঠে ও মাঠের বাইরে সাম্বা নাচে মেতে উঠল অগণিত সেলেকাওরা। ব্রাজিল ভেবেছিল তারা সেমিফাইনালে উঠে গিয়েছে। মুহূর্তের অসাবধানতায় গোল খেয়ে বসে তারা। ১১৭ মিনিটের মাথায় প্রতি আক্রমণে আসে ক্রোয়েশিয়া। সেখান থেকে পেরিসিচের পাসে বাঁ পায়ের শটে গোল করেন ব্রুনো পেটকোভিচ। ফলে ম্যাচ গড়াল টাইব্রেকারে। সেখানে শেষ পর্যন্ত ফের ডমিনিক লিভাকোভিচের সৌজন্যে শেষ চারে চলে গেল ক্রোয়েশিয়া। 




ম্যাচের ৯০ মিনিট পর্যন্ত মোট ন'টি সেভ করেছিলেন ডমিনিক লিভাকোভিচ। অতিরিক্ত সময়েও বারবার দেওয়াল হয়ে ব্রাজিলের সামনে দুই হাতে দিয়ে রুখে দাঁড়াচ্ছিলেন। তাঁকে ভেদ করার কোনও ছকই কাজে লাগছিল না। তাই লিখতে গিয়ে বারবার প্রি কোয়ার্টার ফাইনালের ক্রোয়েশিয়া বনাম জাপান এবং মরক্কো বনাম স্পেন ম্যাচের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেই দুটি ম্যাচেও তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রুখে দাঁড়িয়েছিলেন লিভাকোভিচ ও মরক্কোর ইয়াসিন বুনু। জাপান ম্যাচে লড়াই করার অক্সিজেন এবারও বেশ কাজে লাগালেন লিভাকোভিচ। তবে এবার শেষ হাসি হাসলেন ব্রাজিলের নাম্বার টেন। একইসঙ্গে এই গোল করে ছুঁলেন পেলে-কে। কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। কারণ ক্ষণিকের ভুলে ম্যাচে সমতা ফেরালো ক্রোয়েশিয়া। 



১৬ মে, ১৯৬২। ওয়েলসের বিরুদ্ধে প্রীতি ম্যাচে জোড়া গোল করেন পেলে। সেই জোড়া গোলে পেলে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ড গড়েন। ব্রাজিলের কিংবদন্তি আদেমির মেনেজেসের গোলের রেকর্ড ভেঙে দেন পেলে। ১৯৫০ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা আদেমির মেনেজেস ব্রাজিলের হয়ে গোল করেছিলেন ৩৩টি। ৭৫ গোল নিয়ে বিশ্বকাপে এসেছিলেন ব্রাজিল ফরোয়ার্ড। এই ম্যাচের আগে পর্যন্ত কাপ যুদ্ধে নেইমার গোল করেছিলেন মাত্র ১টি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। এবার ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে জয়সূচক গোল করে 'ফুটবল সম্রাট'-কে ছুঁয়ে ফেললেন নেইমার। যা তাঁর কেরিয়ারের ৭৭তম গোল। তবে নেইমারের গোলের পরেও ব্রাজিলের স্বস্তি কমেনি। কারণ ব্রুনো পেটকোভিচ কাজের কাজটা করে দিয়েছিলেন। 


তবে এই ব্রাজিল দলটা সম্পর্কে তিতে যা বলে ছিলেন তা কি সত্যি ঠিক! 'পেরনিনহাস রাপিদাস'! পর্তুগিজ থেকে তর্জমা করলে বাংলায় মানে দাঁড়ায়, 'টাট্টু ঘোড়ার দল।' কিন্তু এই ব্রাজিল তো টাট্টু ঘোড়া নয়। বরং শেষ আটের ম্যাচে তো ক্রোয়েশিয়া তাদের তারকাখচিত বিপক্ষকে আগাগোড়া চাপে রেখে গেল। নিজেদের হার না মানা মণোভাব, সলিড ডিফেন্স এবং গোলকিপার ডমিনিক লিভাকোভিচের সৌজন্যে। তেকাঠির নিচে থেকে গত ম্যাচে জাপানকে বিদায় করেছিলেন লিভাকোভিচ। টাইব্রেকারে হ্যাটট্রিক সেভ করেছিলেন। স্বভাবতই আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। এবারও যেন সেখান থেকেই শুরু করলেন ২৭ বছরের গোলকিপার। আর ছোট ছোট ত্রিভুজ, চতুভুজ, আকৃতিহীন পাস খেলে একেবারে নাস্তানাবুদ করে দেওয়া দক্ষিণ কোরিয়াকে ফালাফালা করে দেওয়া ব্রাজিল এবার কল্কেই পেল না। তাই কল্পনা করতে পারছিলাম, সুদূর সাওপাওলোর হাসপাতালে বসে ওই সময়ে পেলে কি ভাবতে পারেন। সেই ম্যাচ দেখার পর 'ফুটবল সম্রাট' ভেবেছিলেন আটান্না, বাষট্টি, সত্তরের সেই 'জোগো বোনিতার' দিনগুলো বোধহয় আবার ফিরে এল। কিন্তু না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অসহ্য ফুটবল 'উপহার' দিল সেলেকাওরা! 




আরও পড়ুন: FIFA World Cup 2022: ১৭ হাজারের টিকিট বিক্রি হচ্ছে ৫ লাখে! কোন ম্যাচের জন্য জানেন? চমকে যাবেন


আরও পড়ুন: Kylian Mbappe, FIFA World Cup 2022: হাসপাতাল থেকেই এমবাপেকে ধন্যবাদ জানালেন কিংবদন্তি পেলে


'অতীতের বিশ্বকাপ সংক্রান্ত কোনও পরিসংখ্যানকে মান্যতা দেওয়া উচিত নয়! এই বিশ্বকাপ দেখার পর সেটাই মনে হচ্ছে!' কথাগুলো মজার ছলে বলছিলেন সম্প্রচারকারী চ্যানেলে বসে থাকা লুইস ফিগো। মজার ছলে বললেও খুব ভুল বলেননি পর্তুগিজ তারকা। সেটা এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে প্রথমার্ধের খেলায় বেশ বোঝা যাচ্ছিল। এ কোন ব্রাজিল? তিন দিন আগে অর্থাৎ গত ৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দেওয়া ব্রাজিল এটা? এই ব্রাজিল কি সেই 'ইয়েলো আর্মি' যারা গত ম্যাচে প্রতিটা গোলের পর সাম্বা নাচে মজেছিল? গোটা ফুটবল দুনিয়ার পরোয়া না করে! প্রশ্ন তো উঠবেই। কারণ ক্রোয়েশিয়ার মতো কঠিন প্রতিপক্ষ পেয়ে এই ব্রাজিল তো বেশিরভাগ সময় এলোমেলো ফুটবল খেলে গেল! 


দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ক্রোয়েশিয়া ভুল করবে সেটা কোনও ফুটবল বিশেষজ্ঞ বুকে হাত দিয়েও বলতে পারবেন না। ক্রোয়েটরা খুব ছক কষেই মাঠে নেমেছিল। এই ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে গত চারবারের সাক্ষাতে তিনটি জয় রয়েছে। এরমধ্যে দুটি জয় আবার কাপ যুদ্ধের মঞ্চে। সেই ক্রোয়েটদের বিরুদ্ধে এবার কিন্তু সবচেয়ে হাই প্রোফাইল স্ট্রাইকিং লাইন বারবার আটকে যাচ্ছিল। তাদের বিরুদ্ধে একগাদা স্ট্রাইকার নিয়েও কাজের কাজটা করা যাচ্ছিল না। পরিসংখ্যান বলছে বল পজেশনে ব্রাজিল এগিয়ে। নিজেদের মধ্যে বেশি পাস খেলেছেন নেইমার-ভিনিসিয়াসরা। কিন্তু লাভ হয়নি। 



কারণ প্রথম থেকেই ব্রাজিলকে খেলার জায়গা দিচ্ছিল না ক্রোয়েশিয়া। এরসঙ্গে মাঝেমধ্যে প্রতি আক্রমণেও যাচ্ছিল জাল্টকো দালিচের ছেলেরা। ১৩ মিনিটে প্রায় মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে দৌড়ে বক্সের ঠিক বাইরে জোসিপ জুরানোভিচ ডান দিক থেকে ক্রস তুলেছিলেন। তবে সেই রানিং বলে ঠেকাতে পারেননি গত ম্যাচের গোলদাতা ইভান পেরিসিচ। বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছিল সেলেকাওরা। 


তবে প্রতি আক্রমণ করার নীতি বজায় রাখলেও, এক মুহূর্তের জন্যও ডিফেন্স খালি করেনি ক্রোয়েটরা। বিশেষ করে নেইমার ও ভিনিসিয়ারের উপর ছিল কড়া মার্কিং। দু'জনের পায়ে বল এলেই ছেঁকে ফেলছেন তিন-চার জন। তবুও দুই ব্রাজিলীয় কয়েকবার নিজেদের স্কিল দেখিয়ে গোলের মুখ খোলার চেষ্টা করেছিলেন। তবে লাভ হয়নি। এমনকি ৪২ মিনিটে ফ্রি কিক পেলেও নেইমার কাজে লাগাতে পারলেন না। কারণ তেকাঠির ছিলেন লিভাকোভিচ। 


বিরতির পরে ব্রাজিল ছক বদলে আক্রমণে চলে যায়। কিন্তু ফল সেই এক। বারবার রুখে দাঁড়াচ্ছিলেন সেই গোলকিপার ডমিনিক লিভাকোভিচ। এরমধ্যে আবার ৪৭ মিনিটে নেইমারকে বক্সে ফাউল করলেন ডিফেন্ডার জস্কো গুয়ার্দিওল। সেলেকাওরা হ্যান্ড বলের দাবি তোলার জন্য 'ভার'-এর সাহায্য নিলেন রেফারি। তবে কপালে গোল ছিল না।  



ডানদিকের উইং প্লে একেবারে অচল ছিল। সেইজন্য ৫৭ মিনিটে রাফিনহাকে তুলে ২২ বছরের উইঙ্গার অ্যান্টনিকে নামালেন তিতে। আসল সময় নিজেকে মেলে ধরতে ব্যর্থ ভনিসিয়াস। তাই তাঁকেও তুলে নিলেন তিতে। গোলের খোঁজে ৬৪ মিনিটে মাঠে এলেন আর এক স্ট্রাইকার ২১ বছরের রড্রিগো। ৮৪ মিনিটে ফের বদল করলেন 'ড্যাডি' তিতে। এবার নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে না পারা রিচার্লিসনকে তুলে নিলেন। মাঠে এলেন পেদ্রো। যদিও ব্রাজিল শেষ পর্যন্ত গোলের মুখ খুলতে পারেনি। কারণ প্রতিবারই জোড়া গ্লাভস হাতে নেইমারদের মহড়া নিলেন লিভাকোভিচ। যদিও অতিরিক্ত সময়ের ১০৫ মিনিটে গোল করে ব্রাজিলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন নেইমার। কিন্তু সেই গোলের উৎসব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। কারণ ১১৭ মিনিটে ব্রুনো পেটকোভিচ বিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে ম্যাচকে নিয়ে গেলেন টাইব্রেকারে। 


তবে এতে লাভ হল না। কারণ ফের একবার টাইব্রেকারে দুরন্ত পারফর্ম করলেন লিভাকোভিচ। ফলে নেইমারদের ঘাড় থেকে গত ২০ বছর ধরে বসে থাকা 'ভূত' যেমন নামল না, ঠিক সেই ভাবে ম্যাচের আগে সাংবাদিক বৈঠকে ঘাড় ধাক্কা খাওয়া বিড়ালটাই যেন হট ফেভারিট দলের রাস্তা কেটে দিল! 



(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)