স্বরূপ দত্ত


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

আজ ১৭ অক্টোবর। জন্মদিন এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ এবং প্রাক্তন ভারতীয় দলের ক্রিকেটার এবং অধিনায়ক অনিল কুম্বলের। আজ পড়লেন ৪৬ বছরে বয়সে। শুধু জন্মদিন, তাই কিছু লিখবো বলে লেখা নয়, বেশ কিছু অনুভূতির কথা বলতে লেখাটা লেখা। অথবা বেশ কিছু স্মৃতি, ভালোলাগা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করা। তার আগে পটভূমিটা আরও একটু আপনাদের সঙ্গে বলে নেওয়া। আজ থেকে বছর কয়েক আগের কথা। এই কলকাতা শহরেই একটি বড় সংবাদপত্রের অফিসের ইন্টারভিউ টেবলে বসে আছি।সামনে পরীক্ষক। তিনি বড় নামজাদা মানুষ শুধু তাই নন, আমার বড্ড প্রিয় এবং শ্রদ্ধেও বটে। যাঁকে এত পছন্দ করি, সেই মানুষটাই নিচ্ছেন কিনা আমার ইন্টারভিউ! না, টেনসন বলে কিছুর কথা আমি শুনেছি অনেক। কিন্তু কখনও অনুভব করিনি। সেদিনও না। তবে, একটা উত্তেজনা ছিল।


তা সেই পরীক্ষক আমায় বললেন, এ দেশের সেরা ক্রীড়াবিদের নাম বলো তোমার বিচারে। পাঁচটা নাম পরপর। সেকেণ্ড কয়েক সময় নিয়ে বলেছিলাম যা, সেটাই আবারও বলছি,-১) অনিল কুম্বলে, ২) বিশ্বনাথন আনন্দ, ৩) লিয়েন্ডার পেজ, ৪) গীত শেঠি, ৫) নারায়ন কার্তিকেইন। (তখন সুশীল কুমার আর মেরি কম সেই অর্থে ছিলেন না, তাই নাম বলিনি। আজকের দিনে ওই দুজন আমার বিচারে অটোমেটিক চয়েজ। অভিনব বিন্দ্রা এবং গীত শেঠিকেও রাখবো হয়তো।) যাক সে কথা। আমার উত্তর শুনে, সেই পরীক্ষক অখুশি হলেন না শুধু। রীতিমতো রেগে গিয়ে বললেন, তুমি পাগল! অনিল কুম্বলে? এই লোকটা আমাদের দেশের সেরা ক্রীড়াবিদ? তোমার বিচারে? বললাম হ্যাঁ। তিনি আরও ক্ষেপে গিয়ে বললেন কারণ?


বললাম - ১) কোনও ক্রিকেটারের নাম এই জন্য নেওয়া, যেহেতু এ দেশে ক্রিকেট শুধু খেলা নয়, জাতীয় সংহতির সবথেকে বড় উদাহরণ। তাই। এই খেলায় ভারত জিতেছে তো অনেক। খেলাটা আবার 'টিম গেম' মানে, দলগত। অথচ, ওই দলগত খেলাটায় ভারতকে নিজের পারফরম্যান্সে সবথেকে বেশি ম্যাচ যে মানুষটা জিতিয়েছেন তিনি অনিল কুম্বলে। কপিল দেব আমাদের বিশ্বকাপ দিয়েছেন। গাভাসকর ৩৪ টা সেঞ্চুরি করেছেন। ১০ হাজার রান করেছেন। সচিন তেন্ডুলকর রেকর্ডের রেকর্ড করে বসে আছেন। কিন্তু এগুলো ওই দলগত খেলাটার ব্যক্তিগত কচকচানি। কুম্বলে সবথেকে বেশি ম্যাচ জিতিয়েছেন। এটা জরুরি। কপিল বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। কিন্তু ওটা একটা প্রতিযোগিতার ৬-৭টা ম্যাচ। কুম্বলে তাঁর ১৮ বছরের কেরিয়ারে পুরোটাই ধারাবাহিক ছিলেন প্রায়। ওই ১০ উইকেট কিংবা সেঞ্চুরির কথা বলার দরকার নেই। যে মানুষটা দেশের সবথেকে বেশি জয়ের পিছনের কারিগর, তাঁকে সামনেই বসাবো। তিনি শুনে বললেন আর কিছু?


বললাম - ২) বীর ক্রিকেটার তাই। ক্রিকেট ভালো তো খুব, যাঁরা ভালোবাসে তাঁদের কাছে। কিন্তু বাকিদের কাছে তো বড় আয়েসি খেলা। 'মেয়েলি' খেলা। লোকে দ্যাখে সোয়েটার বুনতে বুনতে। লোকে খেলে টিফিন খেতে খেতে। মাথায় হেলমেট। হাতে গ্লাভস, পায়ে প্যাড। এছাড়াও শরীর প্রায় সবটাই ঢাকা। ওতে আবার পৌরুষ কোথায়! কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাঁর ওই চোয়ালে ব্যান্ডেজ করে বল করার ছবিটা যে চিরকালীন বীরত্বের। ওভাবে ফুটবলারদের দেখা যায়। কিন্তু কোনও ক্রিকেটারকে? না। অনিল কুম্বলে ব্যতিক্রম। ৬ ফুটের বেশি লম্বা মানুষটা চোয়ালে ব্যান্ডেজ বেঁধে লাফাচ্ছেন আরও দু ফুট। তারপর সজোরে তাঁর শরীরটা পড়ছে মাটিতে। চোয়ালটায় কিছু থাকে? হারেননি কুম্বলে। বীরত্বের, পৌরুষের দৃষ্টান্ত হয়ে গেলেন যেন তিনি। তাই পুরুষ হিসেবে পৌরুষকে তো গুরুত্ব দেবই। (পরীক্ষক আগের থেকে অনেক শান্ত। বললেন আর কিছু?)


বললাম - ৩) ছাড়তে জানা। লোকটার থেকেই তো শেখা উচিত। শুধু ক্রিকেট কেন? আমাদের পছন্দের কাজ কোনও একদিন দুম করে ছেড়ে আসা যায় নাকি! তাই তো অবসর নিয়েই সবথেকে বেশি খোঁচা খেতে হয় মানুষকে। কিন্তু অনিল কুম্বলে ছাড়ার উদাহরণ। তিনিই কিনা ক্যাপ্টেন। দল দেশের মাটিতে টেস্ট খেলছে। দুপুরে হাতে চোট পেলেন। সতীর্থদের নিয়ে ড্রেসিংরুমে গেলেন। আর সেখানেই খেলার মাঝপথে সবাইকে বলে দিলেন, বিদায় বন্ধুরা। আর খেলবো না! এত সোজা? সচিন তেন্ডুলকর থেকে কপিল দেব, কাকে অবসরের খোঁচা খেতে হয়নি? কিন্তু কুম্বলের মতো মাত্র ১৫ মিনিটে জীবনের সবথেকে কঠিন সিদ্ধান্তটা এমন হাসিমুখে অবিচল থেকে নিতে দেখিনি। স্যালুট। আসলে ছাড়তে জানাটাই জীবনের সবথেকে বড় শিক্ষা। যেটা ক্রিকেট খেলা দেয়। ওই ছাড়াটা হল সংযম। বীরের কাজ। তাই না ব্যাটসম্যান বিষাক্ত বল না খেলে ছেড়ে দেন। সেই সংযম শেখানো খেলাটার সেরা ছাত্রই তো অনিল কুম্বলে।


আমার বড্ড প্রিয় পরীক্ষক, বললেন কবে থেকে আসতে পারবে? ব্যাস্ হয়ে গেল সব কথা। বুঝলাম চাকরি আমি পাইনি। জিতিনি আমি। সবই জেতালেন আমায় জাম্বো। মানে অনিল কুম্বলে। মাত্র তিন পয়েন্টেই কাজ হয়ে গেল! আমি যে মনে মনে পড়ের তিনটে পয়েন্টের কথা ভাবছিলাম। কিন্তু সেই শ্রদ্ধেয় পরীক্ষক ডেকে শেষবার বললেন, ''শোনো আমি ক্রিকেট খেলাটা পছন্দ করি না। কিন্তু তোমার ওই ছাড়তে জানা আর সংযমটা ভালো লাগলো। আসলে জীবনে সফল হন তাঁরা, যাঁরা না বলতে পারেন, আমিও তেমন। তাই তোমায় নিলাম দলে। আমরা ব্যক্তিগত রেকর্ড করব। ভালো ইনিংস খেলবো। কিন্তু কুম্বলের মতো বেশি ম্যাচ জিতিও তুমিই!'' প্রণাম করলাম। পরের গল্প ব্যক্তিগত। কিন্তু ভালো। ওই যে, তিনি যে না বলতে বলতে বড় হওয়া মানুষ। ছাড়তে জানা মানুষকে আরও বুকে আঁকড়ে রাখবেন না? তাই সবশেষে বলা, শুভ জন্মদিন অনিল ভাই। ভালো থাকুন। হতে পারে, আপনার কোচ হওয়ার পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু বিশ্বাস আজও করি, ভারতীয় ক্রিকেটকে সম্ভাবত সবথেকে বেশি ম্যাচ জেতানো কোচও হবেন আপনি। ভাগ্য যে চিরকাল বীরদেরই সঙ্গে থাকে। আপনি বীরত্বই দেখাতে থাকুন। চোয়াল চাপা লড়াই শেখায় মানুষ। আপনি তো চোয়ালে ব্যান্ডেজ বেঁধে লড়াই করতে শুধু শেখাননি। জিততে শিখিয়েছেন। দেশের সবথেকে শক্তিশালী 'AK-47' তো আপনিই। 


(এই লেখা একেবারেই আমার ব্যক্তিগত মতামত। এর সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা ডট কম একমত হবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।)