নিজস্ব প্রতিবেদন: ভারতী ঘোষ। শিলিগুড়ির এই কোচ বাংলা ও দেশের টেবিল টেনিস ইতিহাসের অনেকটা জায়গা জুড়ে আছেন। একটু বেশি বয়সে অর্থাৎ কলেজে পড়ার সময়ে তাঁর টেবিল টেনিসে হাতেখড়ি। তারপর নিজেকে বুঝতে পেরে, সেই ১৮ বছর বয়স থেকে কোচিং শুরু করেন। যা আজও চলছে... 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় একগাল হাসি ও নিবিড় আন্তরিকতা মিশিয়ে ছোটদের খেলা শিখিয়ে যাচ্ছেন ভারতী। সঙ্গে রয়েছে একদল বিশেষ ভাবে সক্ষম ছেলে-মেয়ে। আগামী ২১ সেপ্টেম্বর ৭৯ বছরে পা দেবেন তিনি। তবুও ভারতী ক্লান্তিহীন ভাবে ছুটে চলেছেন। দিয়ে যাচ্ছেন তালিম। শুধু বাংলা নয়, ভারতেও এমন কোচ বিরল। 


কিন্তু কীভাবে টেবিল টেনিসে এলেন? ভারতী দেবীর প্রতিক্রিয়া, "আমাদের সময় মেয়েদের খেলাধুলোর জন্য এখনকার মতো পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা ছিল না। তাই শৈশবে খেলাধুলো করার সুযোগ পাইনি। কলেজে পড়ার সময় টেবিল টেনিস খেলা শুরু করেছিলাম। সেই সময় আমার কোনও কোচও ছিলেন না। রেলওয়ে ইনস্টিটিউটে খেলতে যেতাম। সেখানে বড়দের খেলা দেখেই শেখার চেষ্টা করতাম। যেটুকু পারতাম শিখতাম। এ ভাবেই আমরা টেবিল টেনিস শিখেছি।"


তিনি ছিলেন '‌সেলফ মেড'‌ টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। কারও কাছে খেলা শেখেননি। কোচ হিসেবেও তিনি '‌সেলফ মেড'‌। কারোর কাছে কোচিং শেখেননি। এমনকী কখনও কোনও কোচিং কোর্স করার কথা ভাবেননি ভারতী। নিজেই নিজেকে কোচ হিসেবে তৈরি করেছেন। যেখানে কোচ হিসেবে অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন, দেশবন্ধু স্পোর্টিং ইউনিয়নে। ওঁর হাতে তৈরি হয়েছে দুই বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মান্তু ঘোষ। ওখানেই গণেশ কুণ্ডু, কৌশিক দাসরাও তৈরি। আছেন আরও অনেক সফল খেলোয়াড়। ডেফ অলিম্পিয়াড-‌সহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া সোমা কুণ্ডু, পলি সাহা, সুরভি ঘোষরা বেড়ে উঠেছেন ওঁর কোচিংয়েই। 



তবে ইচ্ছে থাকলেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে পারেননি ভারতী। তাই তিনি নিজেকে '‌বড় বা ভাল খেলোয়াড়'‌ হিসেবে কখনও দাবিও করেননি। তাঁর কথায়, "আমি বড় বা ভাল প্লেয়ার ছিলাম না। আমি নিজেও জানতাম, অত বেশি বয়সে নিজের চেষ্টায় খেলা শিখে ভাল কিছু করা যাবে না। কিন্তু মন দিয়ে খেলতাম। তখন থেকেই আমার চেষ্টা ছিল যতটুকু পারি অন্যদের দেখে শিখে নিই। ওই শিক্ষাটা আমি ছোটদের খেলা শেখানোর কাজে লাগাব। তাই খেলতে খেলতেই ১৮ বছর বয়স থেকে ছোটদের কোচিং করাতে শুরু করি। ‌এখনও সেই কাজটাই করে যাচ্ছি। সেই ১৯৬৯ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখনও টেনে যাচ্ছি।" 


ওঁর কাছে টেবিল টেনিস সব কিছু। তাই ঘর-‌সংসারে জড়াননি। কিন্তু তাই বলে কখনও একাকীত্ব বোধ করেননি? ভারতী দেবীর প্রতিক্রিয়া, "টেবিল টেনিসই আমার ঘর-‌সংসার। ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়েই আমার জীবন কেটে গেল। ওদের মায়া ত্যাগ করতে পারলাম না। সেই জন্য নিজের বেঁচে থাকার তাগিদ কখনও অনুভব করিনি। বয়স শরীরে থাবা বসিয়েছে। রোগ বেড়েছে। তবে নিষ্ঠা কমেনি। তাই সকাল-বিকেল দুই বেলা লড়ে যাচ্ছি।" 


কোচ হিসেবে অধিকাংশ সময়ই তাঁর কেটেছে দেশবন্ধু স্পোর্টিং ইউনিয়নে। সাংগঠনিক সমস্যায় বাংলার টেবিল টেনিসের যখন টালমাটাল অবস্থা তখন তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন ওই ক্লাব। আসলে গোষ্ঠী রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাননি। ওখান থেকে সরে যাওয়ার কিছু পরে যোগ দেন অমিত আগরওয়াল টেবিল টেনিস অ্যাকাডেমিতে। পরে আবার দেশবন্ধু স্পোর্টিংয়ে ফিরলেও ছাড়েননি ‌অমিত আগরওয়াল টেবিল টেনিস অ্যাকাডেমি। ফলে এখন দুই জায়গায় কোচিং করাচ্ছেন। 


ভারতী বলছিলেন, "সকালে দেশবন্ধুতে যাই। ওখানে কিছু বাচ্চার সঙ্গে ভেটারেন্স প্রতিযোগিতায় খেলার জন্য কয়েকজন অনুশীলন করে। আর বিকেলে অমিত আগরওয়াল টেবিল টেনিস অ্যাকাডেমিতে যাই। ওখানে অনেক বাচ্চা, একটু বড়রাও আসে। আসলে আমি ছোটদের শিখিয়েই তো বেশি আনন্দ পাই। একই সঙ্গে বিশেষ ভাবে সক্ষম ছেলেমেয়েদের খেলা শেখাই। ওরা সমাজে নানাভাবে উপেক্ষিত। অনেকেই ওদের অবহেলা করে। ওদের জন্য কিছু করতে পারাটা আমার কাছে গর্বের।" 


দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে খেলা শেখানোর জন্য ২০১৬ সালে পেয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা পুরস্কার। যে পুরস্কার ওঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া পেয়েছেন বঙ্গরত্ন পুরস্কার। এই পুরস্কারও নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে। এছাড়াও উত্তরবঙ্গের কিছু সংস্থা ওঁকে বিভিন্ন সময়ে পুরস্কৃত করেছে। তবে ভারতী ঘোষের আসল পুরস্কার তো ওই খুদে ছেলে-মেয়েরা। যাদের ব্যাট-বলের আওয়াজে ওঁর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বেঁচে থাকার জন্য বাড়তি অক্সিজেন পান ৭৯-র দিকে এগিয়ে যাওয়া 'সেলফ মেড' কোচ।


(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)