সৌরভ পাল


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING


ক্রিকেট মাঠের এক একটা মুহূর্ত, এক একটা ছবি, এক একটা যুগের, এক একটা মহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষ্মী হয়ে থাকে। ইতিহাসের পাতা খুঁজলেই লর্ডসে কপিল দেবের হাতে  বিশ্বকাপের ট্রফি (১৯৮৩, ভারত প্রথমবার বিশ্ব চ্যম্পিয়ন, অধিনায়ক কপিল ও টিম ইন্ডিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়), সেই লর্ডসের ব্যলকনিতে দাদা'র জামা ওড়ানো (তিনশোধিক রান তাড়া করে ইংল্যান্ডের মাটিতে ব্রিটিশদের হারিয়ে ন্যাটয়েস্ট ট্রফি জয়) এক এক একটা যুগের এক একটা চিরস্মরণীয় ইতিহাস। যুগ পরিবর্তনের নিয়মে খেলার ধরণ বদলায়, খেলার আচরণ বদলায়, নিয়ম বদলায়, পুরনো নতুনকে জায়গা ছেড়ে দেয়। কালান্তরের পথ পেরিয়ে নতুন যুগ ভারতীয় ক্রিকেটে। বিরাট যুগ। নবাব পতৌতি, সানি যুগ, কপিলের বিশ্ব জয়, ক্যাপ্টেন আজহার ও তাঁর ভারত, সচিন্ময়ী ক্রিকেট, মহারাজ ঘরানা, দ্রাবিড়ীয় ইতিহাস, ক্যাপ্টেন কুল এবং বিরাট এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে ক্রিকেট ইন্ডিয়া। মাইল ফলকে লেখা থাকছে এক এক ঈশ্বরোচিত ক্রিকেটারদের নাম। তালিকাটা বেশ লম্বা। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, নবাগতই এখন লম্বা তালিকার এক নম্বরে। একের পর এক, রেকর্ড ভাঙছেন। জানি না, বিরাটকে থামানো যাবে কিনা! স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসকে টেক্কা, ইতিহাস যাকে মারকুটে বলেই চেনে। ক্রিকেটের নন্দন কাননে ঈশ্বরকে কুর্নিশ। ভারতের ক্রিকেটে নৃশংস অধ্যায় লেখা হলে তার নায়ক হবেন বিরাট কোহলিই, এনিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।



পরিসংখ্যান নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি না, ওটা তো গুগলেও পাওয়া যায়। কিছু মুহূর্ত নিয়ে বলতে চাই।


২০১১ সালের মোহালি। পাঞ্জাব দ্য পুত্তর যুবরাজের সিংহ গর্জন। অস্ট্রেলিয়াকে কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়ে সেমিতে ভারত। 'দিবে আর নিবে, মিলিবে আর মেলাবে', এমনই মেলাতে চাই আমিও। সেদিনও ২২ গজে হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন যুবরাজ। ব্যাট হাতে হেলমেটের ভিতর থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসছে। ছবি, ভোলার নয়। আবারও মোহালি। এবারও নাট্যমঞ্চ একই। প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। ফরম্যাট কুড়ির। এবার নায়ক বিরাট। ১৬১ রানের লক্ষ্যে ৫০ শতাংশ রান বিরাটের। ৫১ বলে ৮২। শেষ ওভারে ৬ বলে মাত্র ৪ রানেই ইতিহাস ফিরিয়ে আনবে বিরাটরা। ধোনি নিজের স্বভাবোচিত ভঙ্গিতেই হাসিল করলেন জয়। ৫ বল আগেই টার্গেট অ্যাচিভ। খেলার শেষ ৬ ওভার দেখলে মনেই হচ্ছিল না জয়টা শেষ ওভারে এতো সহজ করে দেবে বিরাট। আরও ১৫ রানও বোধহয় সেদিন ধোনিদের কাছে এক তুড়ির মতই সোজা হত। সৌজন্যে বিরাট। সেই বিরাট সেদিন ব্যাটিংয়ে যে আগ্রাসন দেখালেন তা জয়ের পর নেই। বরং ৭৮ মিনিটের দীর্ঘ লড়াইয়ের পর যেন রণভূমিকে প্রণাম। মোহালির ২২ গজের যুবির মতই হাঁটু গেড়ে বিরাট, হুংকার নেই, শান্ত, যেন প্রলয় শেষ।




প্রলয় তাণ্ডবে একমাত্র  শিবের কপিরাইট। তবে ক্রিকেট মাঠে এমন একনায়ক হওয়াটা বিরাটের পক্ষে সোজা নয়। আছে গেইল নামক ঝড়। আরও আছেন ভিভ, লারারা। ভিভকে ছুঁয়েছেন অনেক আগেই। এবার ক্রিকেটের আরও এক রাজপুত্রকে দেখিয়ে দিলেন, 'স্যার সব আলো ঢেকে যাবে' কারণ ক্রিকেটের আকাশে এখন 'বিরাট তারা'। নইলে ব্রায়ান লারাকে বলতে হয় নাকি, "আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই, বিরাট সেরা"। ক্যারিবিয়ান দ্বীপ-পুঞ্জের কালো হীরে লারার রেকর্ড মনে আছে? একাই চারটে সেঞ্চুরি, একটা ম্যাচে, একটাই ইনিংসে। ২০০৩-০৪ সাল। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অ্যান্টিগোয়ানায় ৭৭৮ মিনিট ধরে ব্যাট করেছিলেন, ৫৮২ বল একাই ব্যাট করেছিলেন, চার ছিল ৪৮টি, বাপি বাড়ি যা করেছিলেন ৪ বার। অ্যান্টিগোয়ানার স্কোরবোর্ডে সেদিন জ্বল জ্বল ৪০০*। না, দলগত স্কোর নয়। ব্রায়ান লারার চারশত রান। ইতিহাসে প্রথম। দল করেছিল ৭৫১। ২২ গজে লুটিয়ে পড়ে চুমু খেয়েছিলেন লারা, "পতিত হেরিয়া কাঁদে স্থির নাহি বাঁধে করুন নয়নে চায়। নিরুপম হেম জিনি উজোর গোরা-তনু অবনি ঘন পড়ি যায়। গৌরাঙ্গের নিছনি লইয়া মরি", লারার তনু গোরা নয়, কিন্তু সেদিন ক্যারিবিয়ানরা ব্রিটিশদের সাদা চামড়ায় লিখে দিয়েছিল কলঙ্ক। অবশ্য সেটা আশীর্বাদও, লারার ৪০০ রানের সঙ্গেই যে উচ্চারিত হয় নাসির হুসেনের ইংল্যান্ডের কথা। যেমন 'দেবী দুর্গার পূজায় পূজিত হন অসুর'। মোহালির মন্দিরে ক্রিকেটের পূজো। তবে সেটা নৃশংস। বিরাট যেভাবে একের পর একে ব্যাগি গ্রীনদের স্বপ্ন ভঙ্গের চিত্রনাট্য রচনা করছিলেন তাতে কোনও মায়া দয়া ছিল না। অস্ট্রেলিয়াতেও মারেন, ঘরের মাঠেও মারেন, টেস্টেও সম্মান দেন না, টি-টোয়েন্টিতেও দেন না, ফকনার যাবেন কোথায়? শেন ওয়ার্ন সচিন নিয়ে ভীত, এবার বোধহয় আরও এক ভয়াল স্বপ্ন আরও এক ব্যাগি গ্রীনের চোখে। আর তাতে 'খলনায়ক' বিরাট।




সচিনোচিত বিরাট। যার খেলা দেখে বড় হয়েছি, তাঁর সামনে এমন পারফরম্যান্স, কল্পনা করা যায় না, পাকিস্তান-ভারত ম্যাচে ক্রিকেটের নন্দন কাননে এই ছবিও একটা ইতিহাস, একটা অধ্যায়। যার কাঁধে ব্যাটন ছাড়লেন, তিনি যোগ্য সম্মান দিলেন। ক্রিকেটের মক্কায় সচিন সচিন হৃদয়ের মণিকোঠায় থাকবে, 'Sounds Forever'। ঈশ্বর যখন ক্রিকেটকে 'Good bye' বলছেন, চিত্রনাট্যে বিরাট যেন বলছেন, 'পিকচার আভি বাকি হে মেরে দোস্ত'। ক্রিকেটের নন্দন কানন কলকাতা থেকে কোচি ম্যাক্সিকান ওয়েভ, বন্দেমাতরমের মতই মাঠ এখন গর্জে ওঠে 'বিরাট বিরাট' গুঞ্জনে।   



যে কথা বলে শেষ করতে চাই, কোহলিই 'দ্য কিং'। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে আলোচনা ছেড়ে দিন। ক্লাস ফোরের একটা বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করুন, ক্রিকেট দেখো, ফেভারিট কে? এক নিঃশ্বাসে যে নাম আসবে সেটা বিরাট কোহলি। এটা ইস্যুই নয়। যেটা ইস্যু, ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ কে? আপনি পাড়বেন, বাকিরাও পাড়বেন। এটা এক নম্বরের প্রশ্ন অথবা ১০০, ক্লাস ফোরের বাচ্চাটা বলবে 'ম্যান অব দ্য ম্যাচ' বিরাট। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমিও অবাক হয়েছিলাম। কী বলছে! বুঝতে পেড়েছিলাম ওর রক্তে, রন্ধ্রে ক্রিকেট মানে কোহলি হয়ে গিয়েছে। আরও বুঝতে পারছিলাম কেন বিরাট কিং!  ক্লাস ফোরের বাচ্চাটার কাছে আমি 'কাকু' আর বিরাট কোহলি (কোহলি আর আমার বয়সের ফারাক ২ বছর, বিরাট এখন ২৭, আমি রজত জয়ন্তী বর্ষে) কেবলই বিরাট। ঠিক আমাদের কাছে শাহরুখ, সলমন, আমিরদের পরিচয় যেমন কেবল নামেই।