অধীর রায়: করোনাভাইরাসের জন্য  কার্যত গোটা বিশ্বে লকডাউন। এই লকডাউনে জেরে মানুষ আজ গৃহবন্দি। এই বন্দি দশায় সবাই কমবেশি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু সব সমস্যার উর্দ্ধে গিয়ে এক ভয়াবহ বন্দিদশায় দিন কাটাচ্ছেন ৩৬ জন নৌ-কর্মী । যাঁদের মধ্যে আছেন ক্যাপটেন, রাঁধুনি, নিরাপত্তারক্ষী এবং ক্রুজ বয়।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

প্রায় কুড়ি দিন হয়ে গেল তাদের চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না  খাদ্য বা পানীয় জল  । এককথায় চরম সংকটে দিন কাটছে তাঁদের। শান্তিপুর পৌরসভার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে গুপ্তিপাড়া ঘাট। গত মাসের শেষের দিকে এই গুপ্তিপাড়া ঘাটে এসে লকডাউনের জন্য আটকে যায় ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথোরিটি অব ইন্ডিয়ার (INLAND  WATERWAYS  AUTHORITY  OF INDIA) চারটি ক্রুজ। এইগুলো পোর্ট ট্রাস্টের অধীনস্থ। যাত্রীদের  গঙ্গাবক্ষে বিনোদন দেওয়া হয় এই ক্রুজে। রাতে থাকার বিলাসবহুল ব্যবস্থা আছে। এদের গন্তব্যস্থল ছিল বেনারস। সেই মতো গত ১৩ মার্চ কোচি বন্দর থেকে রওনা দেয়। কলকাতা বন্দর হয়ে যাওয়ার কথা বেনারসে। কোচি-কলকাতা হয়ে বেনারস যাওয়ার পথে শুরু হয়ে যায় লকডাউন। থমকে যায় চারটি বিলাসবহুল ক্রুজের যাত্রা। এদের লকডাউন না ওঠা পর্যন্ত শান্তিপুরের গুপ্তিপাড়া ঘাটে নোঙর ফেলতে বলা হয়।



পোর্ট ট্রাস্টের এক আধিকারিক জানান, "কলকাতা থেকে বেনারস যাচ্ছিল এই ক্রুজগুলো। এর মধ্যেই লকডাউন শুরু হয়ে যায়। কলকাতা থেকে ইলাহাবাদ  পর্যন্ত পোর্ট ট্রাস্টের বেশ কয়েকটি টার্মিনাল আছে। তার মধ্যে শান্তিপুরের গুপ্তিপাড়া ঘাট একটি টার্মিনাল। লকডাউন চালু হয়ে যাওয়ার জন্য ওদের গুপ্তিপাড়ার টার্মিনালে নোঙর করতে বলা হয়।" আর এই নোঙর করাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বিপত্তি। এলাকার মানুষ জানতে পারেন, এই চারটি ক্রুজ এসেছে কোচি থেকে। ততদিনে খবরে গুপ্তিপাড়ার মানুষ জেনে গেছেন কেরলে ছেয়ে গেছে করোনাভাইরাস। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে। তাঁরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করে এই ক্রুজ থেকে একজনকেও নামতে দেয়নি।



এলাকার মানুষ খবর দেয় শান্তিপুর থানা এবং পুরসভায়। গুপ্তিপাড়ার ক্রুজের ৩৬ জনের  রক্ত পরীক্ষার দাবি জানায় স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। তাঁদের দাবি মতো সবার রক্ত পরীক্ষা করে জানানো হয় এরা প্রত্যেকেই সুস্থ। তবুও এলাকার মানুষ ক্রুজ থেকে নামতে দেয়নি একজনকেও। কেন ? এক স্থানীয় বাসিন্দার কথায়,  "এরা কেরল থেকে এসেছে। কেরলে গোষ্ঠী সংক্রমণের আশঙ্কা করছে সবাই। আর এদের যে রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে তা সাধারণ পরীক্ষা। করোনাভাইরাসের কোন পরীক্ষা হয়নি। কিসের ভরসায় এই ঝুঁকি নেব। এমনিতেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। কোনভাবেই এদের ওই জাহাজ থেকে নামতে দেব না।"


আরও পড়ুন- জরুরি পরিষেবা বাদে হাওড়ায় বন্ধ সব অফিস, দোকান, বাজারে অতি নজরদারি পুলিসের


অভিযোগ, নামতে না দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কে খাদ্য বা পানীয় জল দিয়েও সাহায্য করেনি। ফলে চারটি ক্রুজের ৩৬ জন নৌ-কর্মীর খাদ্য ও পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে। নৌ-কর্মী শিবপ্রসাদ বাবু বলেন,  "আমরা এলাকার বাসিন্দা এবং প্রশাসনের কাছে হাতজোড় করে আবেদন করে ছিলাম রক্ত পরীক্ষা করে দেখা গেছে আমরা সবাই সুস্থ । আর কেরলে করোনা ভাইরাস প্রকট হওয়ার আগেই আমরা কোচি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। আমাদের একজনকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক। যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং খাদ্যসামগ্রী কিনে আনতে পারি। কিন্তু সেই সুযোগও  আমাদের দেওয়া হচ্ছে না। প্রশাসন সব বুঝতে পারছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় মানুষের বিরুদ্ধে তারা যেতে পারছে না।"



নেই খাদ্য, নেই পানীয় জল। এই অবস্থায় শান্তিপুরের গুপ্তিপাড়া ঘাটের টার্মিনালের এক নিরাপত্তারক্ষী ওই ছত্রিশ জনের জন্য স্থানীয় বাজার থেকে কিছু খাদ্যসামগ্রীর ব্যবস্থা করেছিলেন। সেটা জানতে পারেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এরপরই হুমকি আসে বলে অভিযোগ। সেই টার্মিনালের নিরাপত্তারক্ষী রতন সাহা বলেন, "ক্রুজের কর্মীদের জন্য খাবারের এবং পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু তাতেও বাধা দেয় এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা। পাশাপাশি আমাকে মারার হুমকিও দেওয়া হয়।" এই সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে পোর্ট ট্রাস্টের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সমস্যার কথা জানানো হয়। কিন্তু  সমস্যা সমাধান বিষয়ে আশ্বস্ত করলেও  তাতে খুব একটা সুরাহা হয়নি বলে অভিযোগ।


জানানো হয় স্থানীয় বিডিও  সুমন দেবনাথকে। শান্তিপুরের বিডিও জানান,  গুপ্তিপাড়ার ঘাট যে হেতু শান্তিপুর পুরসভার অধীনে যা করার পুরসভাই করবে। এরপর স্থানীয়, বাসিন্দাদের  না চটিয়ে শান্তিপুরের পুরসভা সাময়িক কিছু খাবার এবং পানীয়  জলের ব্যবস্থা করে। শান্তিপুর পুরসভার চেয়ারম্যান অজয় দে বলেন, "পুরসভা  মানবিকতার সঙ্গে সবটাই দেখছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি  অনুযায়ী ওদের ক্রূজ থেকে  নামতে না দিলেও বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়ে ওই ক্রুজে খাবার পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরসভার তরফ থেকে পানীয় জলের একটি ট্যাঙ্ক রোজ গুপ্তিপাড়া ঘাটে পাঠানো হচ্ছে। বড় কোনও সমস্যা এখন আর নেই। আর চারিদিকে যা অবস্থা সবদিক বিবেচনা করেই পুরসভাকে সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে। যদি  কোনভাবে এখান থেকেই করোনা সংক্রমণ ছড়ায় সেই দায় কে নেবে।"


তথ্য সংগ্রহে: বিশ্বজিত্ মিত্র