সব্যসাচী চক্রবর্তী


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সালটা ১৮১৩। রাজা রামমোহন রায় পা রাখলেন কলকাতায়। ১৮১৫ থেকে পাকাপাকি শহরেই বাস। বাংলার নবজাগরণের শুরুয়াদ বলা ভালো, সেই বছরগুলোর মধ্যেই। তারপরের ঘটনা কমবেশি সবাই জানি। ভেতো, ভীরু, লজঝড়ে, চিঁ চিঁ করা বাঙালি আচমকা শের বনে গেল। সিস্টেম নিয়ে তুলতে শুরু করল প্রশ্ন। স্বাভাবিক ভাবেই সবথেকে বেশি গায়ে ফোস্কা পড়ল যার, তা হল ধর্ম। শহুরে, ‘শিক্ষিত’ বাঙালির মধ্যে এল যুক্তিবোধের ঝড়। 


এই যুক্তিবোধের ঝড়টাকে সাদা চোখে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। এক, যাঁরা অজস্র দেবদেবীর সমাহার থেকে নিজেদেরকে থিতু করলেন উপনিষদে। ব্রাহ্ম ধর্মে। রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুররা এই পথের। আর দুই, ডিরোজিওর হাত ধরে উঠল ‘ধর্মবিরোধী’ যুক্তিবাদী ঝড়। যা কিছু পুরোনো সংস্কারি, তাতেই প্রশ্ন, যুক্তি-তর্কের ঝাঁঝ। মোটের ওপর যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে শুরু করল বাঙালি। তবে মনে রাখা দরকার, এই বোধ কিন্তু কিছু শ্রেণির মানুষের মধ্যেই থেকে গেল। বাকি যাঁরা তুলনায় সাধারণ, তাঁরা কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা বিভ্রান্ত, কিছুটা না জেনেই শ্রদ্ধাশীল। 



বাংলার নবজাগরণ বাঙালিকে যুক্তিশীল হতে শিখিয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার থেকেও বেশি দিয়েছে ক্রাইসিস। প্রচলিত বিশ্বাস, মনন, ঈশ্বরনির্ভরশীলতা নিয়ে ক্রাইসিস। অবশ্য এটা হওয়ারই ছিল। প্রচলিত ধ্যান ধারণা যুক্তিবোধের সামনে ধাক্কা খেলে অস্তিত্ব সংকট অনিবার্য। ডেনমার্কের কিয়ের্কেগার্দের অস্তিত্ববাদের দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে যারা চিল্লিয়ে ফাটিয়ে দেন, তারা ভেবেও দেখেননি, তাঁর শিশুকাল থেকেই এ বাংলায় শুরু হয়ে গিয়েছিল অস্তিত্ববাদী সংকট। যা নিয়ে কোনও কাজ আজ পর্যন্ত হয়নি। ঈশ্বর আছেন কী নেই, এই দোলাচল দিয়েছিল অসহায়তা। ঠিক খ্রীষ্টানদের পুরোনো আর নতুনের দ্বন্দ্বের মতোই। 


আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে রোষের ফল ভুডুইজিমের মতো ভূতুড়ে কালা যাদু। যার সঙ্গে আমরা এঁটে উঠি না, তাদের বিচার অচেনা অজানা ঈশ্বরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া মানুষের দস্তুর। এ বাংলাতেও ইংরেজ আর জমিদারদের ‘ঈশ্বর বা আল্লা শাস্তি দিবেন’ গোছের মনোভাব দেখেই পিঠ বাঁচিয়ে চলছিল বাঙালি। মনের সে ভাবের ঘেঁটি ধরে নাড়িয়ে দিল নবজাগরণ। 


বেঙ্গল রেনেসাঁর চাপে তাপে যখন বোধ যুক্ত মনন দ্বিধাগ্রস্ত, নতুন যুক্তি পথের সন্ধানী, তখন তাদের শেষ ধাক্কাটা দিয়ে একেবারে থামিয়ে দিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। রামকৃষ্ণের কাছে এসে থামল যুক্তিবোধ। ঠাকুর সাফ জানিয়ে দিলেন, যুক্তি বোধের চেয়েও বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। যত মত, তত পথ। কোন পথ তোমার, ইওর চয়েজ। নতুন ভাবে ভক্তিভাবের জোয়ার বইল যে ঈশ্বরকে ঘিরে, তিনি কালী। পরবর্তীকালে বিবেকানন্দ বিশ্বাস আর যুক্তিবোধের দুর্দান্ত মিশেলে সংশয়ের আর কোনও জায়গাই রাখলেন না। 


'মা' কালী। পুরোপুরি বঙ্গজ দেবী। দেবী চামুণ্ডে, কালিকের ‘করাল দংষ্ট্রারেখা’ ছাপিয়ে তিনিও মা। 'শ্যামা মা'। নাঃ, কালী শ্যামা হয়ে উঠেছিলেন কিন্তু রামকৃষ্ণেরও প্রায় একশো বছর আগে, রামপ্রসাদের হাত ধরে। 
“এ বার সাকার রূপে দেখা দাও মা, মূর্তি গড়ে তোমার অর্চনা করি”
বাংলায় কালী পুজোর প্রবর্তক বলা যায় নবদ্বীপের কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে। তন্ত্রসাধক। কৃষ্ণানন্দের আগে বাংলায় তন্ত্রসাধনা ছিল বেশ একটা গা ছমছম ব্যাপার। কৃষ্ণানন্দ এসে তাকে একটু নরম সরম করলেন। সাধারণের কাছে আনলেন একটু। এখন যে মা কালীর শান্ত রূপ। সেই দক্ষিণাকালী, তাঁর হাত ধরেই। যাই হোক, রামপ্রসাদ কৃষ্ণানন্দের শিষ্য ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি তাঁর রামপ্রসাদী গানের সুরে, ভয়ংকরী কালীকে করে তুললেন উমার মতোই ঘরের মেয়ে। মেয়ে নয়, বলা ভালো, মা..।



আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক, ভারতবর্ষের ভক্তি আন্দোলন। যা শুরু হয়েছিল দক্ষিণ ভারতে। যে আন্দোলনের রেশ এ বঙ্গদেশে এল শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে। রামপ্রসাদকে ফেলা হয় ভক্তি আন্দোলনের মধ্যে। ভক্তিবাদী শাক্ত ভাবনা, তাঁর হাত ধরেই। মনে রাখা দরকার, ভক্তি আন্দোলনে ঈশ্বরের নারী ভাবকেই কিন্তু প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। সে কারণেই বৈষ্ণবরা নিজেরা রাধা ভাবের, এবং ‘জগতের একমাত্র পুরুষ প্রকৃতি শ্রীকৃষ্ণে’র উপাসক তাঁরা। অন্তত বৈষ্ণবদের তাই মত। শ্যামা পুজো, সেই ভক্তি আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি। ব্রাহ্মণ্যবাদের মুখে ঝামা ঘষে মাতৃশক্তির আরাধনা। 


রামপ্রসাদ তাঁর জীবদ্দশাতেই জনপ্রিয় হয়েছিল। রামকৃষ্ণের হাত ধরে তিনি সবস্তরের মানুষের কাছেই পৌঁছে গেলেন। রামকৃষ্ণের হাত ধরে কালী থুড়ি শ্যামা ভাব পৌছলো অসামান্য উচ্চতায়। তন্ত্রসাধনা হয়ে উঠল আরও কাছের। মানুষের কাছে তা ভয়ের থাকলেও, হল ভক্তিরও। শ্যামা মা’কে, ভয় মিশ্রিত ভক্তি আবেগে কাছে টানল বাংলা। ভেবে দেখুন, ঠিক আমার-আপনার মায়ের মতো। মা’কে ভয় পাই, মা আবার কাছেও টানেন। মায়ের ওপর রাগ করি, মায়ের কাছে আবদারও করি, মারও খাই। উমা যেখানে ঘরের মেয়ে, শ্যামা সেখানে 'মা'। ভয়ংকরী কালীকে মা ভাবতে বাধ্য করলেন রামকৃষ্ণ। যুক্তিবোধ ভাসলো বিশ্বাসবোধে। অবিশ্বাস আর অস্তিত্বের সংকটের অন্ধকার কাটলো দীপাবলীতে। এমনকি বিবেকানন্দের দৌলতে, ইংরেজদের বিরুদ্ধেও লড়াইয়ে শক্তি জোগাতেন মা কালীই। মহাকালের বিজয়ীতা, মহাকালী। আর মা’কে ছেড়ে আমরা যাই কোথায় বলুন তো?  


শ্যামা। কালো বরণ। সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন, অন্ধকারের উত্‍স হতে উত্‍সারিত আলো। এও সেরকম। কালোর মধ্যেই আলোর ভাবনা। যে ভাবনা চরম বিজ্ঞানসম্মতও বটে। কারণ বিজ্ঞানও মানে, চরম অন্ধকারের গর্ভেই থাকে ফোটন। বিগ ব্যাংকে যদি চরম আলো বলে ধরে নিই, তারও আগে তো সেই চরম অন্ধকারই। এক মহাচেতন। মহাকালের ব্লু প্রিন্ট। লক্ষ্য করে দেখবেন, কৃষ্ণও কালো। তিনি পালনকর্তা। সুতরাং শাস্ত্র কিন্তু অন্ধকারকে ভয় না পেয়ে, তাকে ভালো ভেবে তার কাছে নত করতেই শিখিয়েছে। কারণ, আলো নয়, শ্রেষ্ঠ অন্ধকারই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যেটা আমরা বুঝতে পারি না, আমাদের কাছে সেটাই ভয়ংকর। অন্ধকারের ক্ষেত্রেও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেটাই হয়েছে। তাই আমরা কালো শ্যামার অর্চনায় এনেছি আলো। অন্ধকারকে মেনে নিয়েও আলোর জয়কে দেখতে চেয়েছি। 



আসলে ঈশ্বরবিশ্বাসের বিপরীতপ্রান্তেই শয়তানের বাস। শয়তান ঈশ্বরেরই প্রতিভূ। সে কারণেই কালী ভয়ংকরী, রক্ত পিপাসু হয়েও ঈশ্বর। অসুর যে অসুর, তাদের থেকেও ভয়ংকরী। ভূত চতুর্দশী, আত্মা, যক্ষিণী, শ্মশান তাই জুড়ে গিয়েছে মা কালীর সঙ্গেও। তবুও দিনের শেষে তিনি মা। তিনি ভালো এবং আলো। আসলে আপনি মুদ্রার কোন পিঠ নিয়ে ভাববেন, হেড না টেল, সেটা আপনারই। ভালো ভাবুন, ভালো হবে। এটাই শেষ কথা। দীপাবলি, সেই ভালোর কথাই বলে। অন্ধকারের মধ্যে খোঁজ দেয় আলোর। ভালো ভাবুন এবং ভালো থাকুন, দেখবেন, ভালো হবেই হবে। দীপাবলীর শুভেচ্ছা রইল। ভালো থেকো, ভালো রেখো..