অধীর রায়: সোদপুর থেকে শিলিগুড়ি। দূরত্ব প্রায় সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার। লকডাউনের আবহে অনাত্মীয়কে বাঁচাতে জীবনদায়ী ওষুধ পৌঁছে দিলেন সোদপুরের এক মিষ্টি বিক্রেতা। কিন্তু কীভাবে? গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ। নেই কুরিয়ার পরিষেবা। সুদূর শিলিগুড়িতে মুমূর্ষ রোগীর আকুতি অনুভব করেই হয়তো পৌঁছে গিয়েছিলেন মিষ্টি বিক্রেতা কমল দাস। কিন্তু সেই জার্নিটা এতটা সহজ ছিল না...
সোদপুর স্টেশন রোডের উপর দোকান কমল দাসের। দিন তিনেক আগে দুপুরে একজন ক্রেতা আসেন মিষ্টি কিনতে। তিনি ওই এলাকারই বাসিন্দা। মুখ চেনা। একদিকে লকডাউন তার উপর দুপুরবেলা। দোকানে ক্রেতা নেই। দোকানের কর্মচারীর মিষ্টি দেওয়ার ফাঁকে কমলবাবু ওই ক্রেতার সঙ্গে লকডাউন নিয়ে আলোচনা করছিলেন। কথায় কথায় ওই ক্রেতা লকডাউনে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা শেয়ার করেন কমল দাসের সঙ্গে। সেই আলাপচারিতায় কমলবাবু জানতে পারেন ওই ক্রেতার এক আত্মীয় শিলিগুড়িতে থাকেন। বিনা ওষুধে তার সেই আত্মীয় এখন মৃত্যুর পথযাত্রী।
এক ব্যক্তির আর্থারাইটিসের ওষুধ না মারা যাবে এ কথা ভাবতেই পারছেন না কোমল  দাস। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, লকডাউনের মধ্যেই ওষুধ নিয়ে শিলিগুড়ি যাবেন। পরোপকারী হিসেবে এলাকায় কমলবাবুর নামডাক আছে। তা বলে লকডাউনের সময় একেবারে শিলিগুড়ি! যাবেন কিভাবে? সেই প্রস্তুতি পর্ব  শোনালেন কমল দাস।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING


তিনি জানান, ঘটনা শোনার পর সেদিন রাতে ঘুমাতে পারেননি। সকালে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন. শিলিগুড়ির বাসিন্দা শুভ্রজিৎ গাঙ্গুলি আর্থারাইটিস রোগে আক্রান্ত। বয়স বিয়াল্লিশ বছর। কর্মসূত্রে স্ত্রী এবং তিন বছরের কন্যা সন্তানকে নিয়ে  শিলিগুড়িতে থাকেন। বেশ কয়েকবছর ধরে আর্থারাইটিসে ভুগছেন। সম্প্রতি একেবারে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। কলকাতায় চিকিৎসা করিয়ে কিছুটা ভালো আছেন। কিন্তু ডাক্তার যে ওষুধগুলো দিয়েছেন সেগুলো কলকাতা ছাড়া পাওয়া যায় না। দামও প্রচুর। মোট ৬৫ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হবে। লকডাউনের জন্য ওষুধ কিনতে পারছেন না। এরপরই প্রেসক্রিপশনের ফটোকপি  আনিয়ে পঁয়ষট্টি হাজার টাকা দিয়ে সব ওষুধ কিনে শিলিগুড়ি গিয়ে শুভ্রজিৎ গাঙ্গুলীর হাতে ওষুধ পৌছে দিয়ে আসেন তিনি।
প্রেসক্রিপশনের ফটোকপি পাঠানোর আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই সমস্ত ওষুধ হাতে পেয়ে চোখে জল ধরে রাখতে পারেননি শুভ্রজিৎ গাঙ্গুলী। কার্যত জীবন ফিরে পেয়ে আনন্দে কান্না ভেজা গলায় জানান, "আজও এমন মানুষ আছেন এটা ভেবেই কিছুক্ষণ কমলবাবুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। প্রায় বারো ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে এক অচেনা অজানা  মানুষের জীবন দান করতে এতদূর ছুটে এসেছেন। দিনদশেক আগে ওষুধ ফুরিয়ে যায় । এতগুলো টাকা প্রথম ধাপের লকডাউনের আগে জোগাড় করতে পারি নি । কিন্তু পরে টাকা যখন জোগাড় হল ততদিনে লকডাউনের মেয়াদ বেড়ে গেছে । তাই আর ওষুধ কিনতে পারিনি। যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। রোজ ঘুমের ওষুধ আর ব্যাথার ট্যাবলেট খেয়ে দিন কাটছিল। ঠিকমতো  ওষুধ না খাওয়াতে শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দিয়েছিল । মেয়ে ছোট।     সব মিলিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছিল। কমলবাবু আমার নতুন জীবন দিলেন । কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানানোর  ভাষা নেই ।"
শুভ্রজিৎ এর আত্মীয়ের  কাজ থেকে সমস্ত ঘটনা শোনার পর সেদিনই  স্থানীয় খড়দা থানায় গিয়ে সমস্ত ঘটনা পুলিসকে জানান  কমল দাস । আর শিলিগুড়ি যাওয়ার অনুমতি চান। পুলিসও বিষয়টি মানবিকতার সঙ্গে বিবেচনা করে বারাকপুর কমিশনারেটের নির্দেশে কমল দাসকে শিলিগুড়ি যাওয়ার অনুমতি দেয় । এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে কমলবাবুর এই ধরনের  কাজ নতুন নয় । প্রচারে আড়ালে  থেকে  মানুষের বিপদ শুনতে পেলেই স্বর্তঃফূর্তভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন পরোপকারী কমল দাস।


তথ্য সংগ্রহ: অনন্ত চট্টোপাধ্যায়