সৌমিত্র সেন 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING


রানি রাসমণি নামটি বললেই এখন আমজনতার মানসে একটি টেলিসিরিয়ালে রানির ভূমিকায় অভিনয় করা মহিলার মুখ ভেসে ওঠে। এই অভিনেত্রী ইদানীং বাংলায় একটি 'হাউসহোল্ড নেম' হয়ে গিয়েছেন। তাঁর ফ্যাশন স্টেটমেন্ট নিয়েও চর্চা হচ্ছে। তিনি এখন রীতিমতো 'সেলেব'।


সিরিয়ালের মাধ্যমে বাংলার গৌরবান্বিত অধ্যায়কে ফিরে দেখার এই ভেঞ্চার দর্শকমনে ভালই ছাপ ফেলেছে। মানুষ বেশ উপভোগও করছেন বলেই শোনা গিয়েছে সিরিয়ালের মোড়কে এই পিরিয়ড পিস।


এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। মুশকিল হল, সিরিয়ালের বাইরের রানি রাসমণিকে নিয়ে। তাঁকে নিয়ে আর বাঙালি সরাসরি খুব একটা ভাবে বলে মনে হয় না। বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি, এ তো বহুচর্চিত। বাঙালি ইতিহাসের তোয়াক্কা করে না। তা যদি না হত, তবে, নারীর ক্ষমতায়নের এই যুগে, নারী আন্দোলনের অগ্রগতির এই টাইম-ফ্রেমে কোনও না কোনও পর্বে বাঙালি ঠিক কোথাও না কোথাও রানি রাসমণির উল্লেখ করতই। 


রানির সময়কালটা মনে রাখা খুব জরুরি। রামমোহন যখন বছরকুড়ির তরুণ যুবা তখন, ১৭৯৩ সালে, আজকের দিনে জন্ম রাসমণির। দীর্ঘকালীন অনগ্রসরতা ও জড়ত্ব থেকে তখন ভারত সবে একটু-একটু মুখ তুলতে শিখছে। অন্ধকার তখন ঘন। ১৮২৯ সালে রদ হয় সতীদাহ প্রথা। পরের বছর ১৮৩০-এ রামমোহন ইংল্যান্ডে চলে গেলেন। ঈশ্বরচন্দ্র তখন বছরদশেকের বালক। এর উনিশ বছর পরে বেথুন সাহেবের সঙ্গে মিলে বিদ্যাসাগর বাংলায় মেয়েদের প্রথম স্কুলটি করেন। এর ঠিক এক বছর আগেই যদিও, ১৮৪৮-এ, জ্যোতিরাও গোবিন্দরাও ফুলের চেষ্টায় ভারতের প্রথম মেয়ে-ইস্কুলটি স্থাপিত হয়ে গিয়েছে। ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ স্বীকৃত হয়। এত কথা বলার কারণ এই যে, 'নারীমুক্তি আন্দোলন' কথাটির তখনও জন্মই হয়নি। মেয়েদের কথা একটু একটু করে ভেবে জাতিটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ তখনই নিজের জীবনচর্যার মধ্যে দিয়ে রানি রাসমণি এই নারী-আন্দোলনের নান্দীপাঠটি করে রেখেছিলেন। 



কী ভাবে? একটু ফিরে তাকানো যাক। সময়টা উনিশ শতক। স্থান মধ্য কলকাতা। সেই সময়ে কোনও এক বার দুর্গাপুজোয় ষষ্ঠীর দিনে ব্রাহ্মণেরা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে নবপত্রিকা স্নান করাতে যাচ্ছিলেন। সেই রাস্তায়  ছিল এক সাহেবের বাড়ি। নবপত্রিকার শোভাযাত্রায় তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটল। তিনি সরকারি সহায়তা নিয়ে বাদ্য  এবং পুজো বন্ধ করতে সচেষ্ট হলেন। কথাটা কানে গেল রানির। পরদিন তিনি আরও শব্দঝঙ্কার-সহযোগে শোভাযাত্রার ব্যবস্থা করলেন। রানির বিরুদ্ধে শান্তিভঙ্গের মামলা দায়ের হল। পঞ্চাশটাকা জরিমানাও হল। তিনি বিনা প্রতিবাদে সেই টাকা সরকারের ঘরে জমা দিলেন। কিন্তু জানবাজার থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত সমস্ত  পথ খুঁটি দিয়ে ঘিরে বন্ধ করে দিলেন। সরকার-পক্ষ থেকে এ নিয়ে আপত্তি উঠলে রানি বলে পাঠালেন, রাস্তাটি তাঁর জমিতে, সেখানে তিনি যা খুশি তাই করতে পারেন। নিরুপায় সরকার তখন রানির জরিমানার টাকা প্রত্যর্পণ করল। রানিও সর্বসাধারণের জন্য রাস্তা খুলে দিলেন।


এই হলেন রানি। ভীষণ 'ভোকাল'। প্রতিবাদের জায়গাটা চিনে নিতে ভুল করেন না। প্রতিপক্ষকে দেখে কুঁকড়ে যান না। নিজের কথাটা নিজের মতো করে বলতে জানেন। আত্মনির্ভর, স্বাধীনচেতা, স্পষ্টবাক, সাহসী। সেকালে এক হিন্দু ঘরের বিধবার পক্ষে এমন চরিত্রবল খুবই দুর্লভ ছিল। যে-সময়ে স্বামীহারা নারী ঘরে-বাইরে ব্রাত্য, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে রানি যেন অগ্নিসমা!


হালিশহরের কাছাকাছি কোনও এক গ্রামে জন্ম রানির। বাবা হরেকৃষ্ণ দাস কোনও রকমে পরিবারের ভরণপোষণ করতেন। ঘটনাচক্রে জানবাজারের জমিদার প্রীতরাম দাসের পুত্র রাজচন্দ্রের সঙ্গে রাসমণির বিয়ে হয়। ১৮৩৬ সালে প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা মূল্যের সম্পত্তি রেখে রাজচন্দ্র মারা যান। 


এই সময় থেকেই রাসমণির জীবনের নবপর্যায়। নিছক 'হাউজ ওয়াইফ' বা 'হোম-মেকার' থেকে তিনি তাঁর এস্টেটের কাণ্ডারি হয়ে দাঁড়ালেন। পাশাপাশি ধর্মাচরণেও অনুরক্ত হলেন। জমিদারির কাজকর্ম দেখে  যে সময়টুকু পেতেন ব্যয় করতেন ভগবৎ-চিন্তায়। কর্মজীবন ও ভাবজীবন চলতে লাগল হাত ধরাধরি করে। 


সাধারণ মানুষের দুঃখবেদনায় বরাবর বিচলিত হতেন এ হেন রানি। অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। সেগুলি ধীরে ধীরে মিথে পরিণত হয়েছে। গরিব জেলেরা বহুকাল ধরে গঙ্গায় মাছ ধরত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আয়বৃদ্ধির লালসায় হঠাৎই জলকর প্রবর্তন করল। মৎস্যজীবীর দল কোম্পানির কাছে অনেক আবেদন-নিবেদন করল। কোনও কাজ হল না। অগত্যা তারা রানির কাছে দরবার করল। রানি তখন দশ হাজার মুদ্রায় ঘুসুড়ি ও মেটিয়াবুরুজের মধ্যবর্তী গঙ্গা ইজারা নিলেন। এবং তাঁর প্রথম কাজই হল, দড়িদড়া দিয়ে তাঁর জল-সীমানাটি চিহ্নিত করা। এর ফলে এ-পথে বন্ধ হয়ে গেল জাহাজ-নৌকার চলাচল। ঘোর আপত্তি জানাল ব্রিটিশেরা। তাদের পণ্য পরিবহণে ব্যাঘাত ঘটছিল। রানি জানালেন, যথেচ্ছ জলযান চলার ফলে মাছ ও মৎস্যজীবীদের ক্ষতি হচ্ছে। রানির এ কাজের আসল উদ্দেশ্য  বুঝে এবং কোনও উপায়ান্তর না দেখে বাধ্য হয়ে জলকর তুলে নিল কোম্পানি। সমানে-সমানে টক্কর নেওয়ার এই মানসিকতা নিশ্চিতভাবেই উনিশ শতকের নারীমনের মানচিত্রে খাপ খায় না। 


লড়তে পারতেন যেমন ঠিক, তেমনই বরাবরই প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন রানি। দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়েও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। উচ্চবর্ণের কোনও ব্রাহ্মণ শূদ্রনির্মিত মন্দিরপ্রতিষ্ঠাকার্যে ব্রতী হতে চাইছিলেন না। অবশেষে ঝামাপুকুর টোলের রামকুমার চট্টোপাধ্যায় বিধান দিলেন রানিকে। রানির স্বপ্ন সম্ভব হল। 



ধর্মাচরণের ক্ষেত্রেও খোলামনের মানুষ ছিলেন রানি। জমিদারি সেরেস্তার কাগজপত্র নামাঙ্কিত করার প্রয়োজনে নিজের যে সিলমোহরটি বানিয়েছিলেন সেখানে উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন-- 'কালীপদ-অভিলাষিণী রাণী রাসমণি।' কিন্তু আশ্চর্যের যে, দক্ষিণেশ্বরে তাঁরই চেষ্টায় শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব ভাবধারার এক অনায়াস ত্রিবেণী সঙ্গম তৈরি হয়ে গেল। 


রানিকে কী ভাবে মনে রেখেছে কলকাতা? দু'একটি মূর্তি আর তাঁর নামাঙ্কিত অ্যাভিনিউর মারফত। আর রয়েছে কয়েকটি বাজার আর গঙ্গার ঘাট, যেসবের সঙ্গে তাঁর নামটি কখনও-সখনও জুড়ে নেন কলকাতাবাসী। 


আরও পড়ুন: শুরু করেছিলেন শরৎচন্দ্র, ১৫০ বছর পরেও বলতে হচ্ছে, 'বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও'


                     নকশাল আমল থেকে আজ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে শুধু ভেঙেই চলেছে বাঙালি