নিজস্ব প্রতিবেদন: ছোটোবেলা থেকেই দারিদ্রকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। দেশ ভাগের পর প্রথমে চাকদায়, তারপরে দমদম নলতা রোডে ঠিকানায় চলে এলে রায়বাহাদুর বৈদ্যনাথ ইনস্টটিউশনে ভর্তি হন শ্যামল চক্রবর্তী। সালটা ১৯৫১। পড়াশুনায় কিছুটা ছেদ পড়লেও অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ার দরুন তাঁকে 'ডবল প্রমোশন' দেওয়া হয়েছিল স্কুলে। একেবারে ষষ্ঠ শ্রেণিতে তাকে তুলে দেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ছোট্ট শ্যামলকে।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ছাত্রাবস্থা থেকেই লেখালেখির ঝোঁক ছিল তাঁর। বার্ষিক ম্যাগাজিন, দেওয়াল পত্রিকায় নিয়মমতো লেখালেখি করতেন। ১৯৫৯ সালে স্কুল পাশ করে দমদম মতিঝিল কলেজে ভর্তি, সেখান থেকে ৬২-তে ইন্টারমিডিয়েট, ৬৬-তে বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক। কিন্তু ততক্ষণে শ্যামলের জীবনের পথ অন্য মোড় নিয়ে ফেলেছে। প্রথম থেকেই মার্কসবাদ তাঁকে হান্ট করতো, তাই ছয়ের দশকে ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়াটা ছিল শ্যামলের সময়ের অপেক্ষা।  ১৯৫৯-এ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন তিনি।



স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন শ্যামল চক্রবর্তী। ১৯৭০ সালে এসএফআই গঠিত হলে রাজ্য নেতৃত্বের ভার তাঁর কাঁধেই বর্তায়।  ১৯৭৩-র শিবপুর সম্মেলন থেকে ১৯৭৯-র বারাকপুর রাজ্য সম্মেলন পর্যন্ত টানা ৬ বছর এসএফআই-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসভাপতি ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী। এরপর এসএফআই-র সর্বভারতীয় যুগ্ম-সম্পাদকও হন তিনি। ১৯৭৮ সালে শিশির মঞ্চে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলন থেকে পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য, ১৯৮৫ সালের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী এবং ২০০২ সালে হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। আমৃত্যু ওই কমিটির সদস্য ছিলেন।



২০১৪-র ১১ সেপ্টেম্বর। পুলিসি জুলুম এবং ভাড়া বাড়ানো নিয়ে রাজ্য পরিবহণ দফতরের উদাসীনতার অভিযোগ এনে একাধিক পরিবহণ ইউনিয়ন ধর্মঘট ডাক দেয়। সে সময় পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র এই ধর্মঘটের বিরুদ্ধে অনড় মনোভাব দেখালে, শ্যামল মিত্র হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, “ধর্মঘটের দিন যদি কোনও শ্রমিকের গায়ে হাত পড়ে, তা হলে কিন্তু রাজ্যে আগুন জ্বলবে।” শেষমেশ শ্যামল-অনাদিদের লাগাতার মিছিল-প্রতিবাদে পিছু হটতে হয়েছিল রাজ্য সরকারকে। এভাবেই শ্যামল চক্রবর্তী সামনের সারিতে থেকে আন্দোলনের শরিক হয়েছেন। পরিবহণ শিল্প, বিদ্যুৎ শিল্প-সহ কয়েকটি ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় স্তরে দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি হিসেবেও তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে গ্রামীণ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীদের সংগঠনে নিয়ে আসার প্রশ্নে তাঁর উদ্যোগ প্রশংসনীয়।


সংসদীয় রাজনীতির হাতেখড়ি হয় মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। এই কেন্দ্র থেকেই শেষ নির্বাচনী লড়াইটা লড়েছিলেন শ্যামল চক্রবর্তী। সিপি‌আই(এম) বিধায়ক সুহৃদ বসুমল্লিকের মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালে ওই কেন্দ্রে বামফ্রন্টের  সিপিআই(এম) প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং প্রথমবার বিধায়ক নির্বাচিত হন শ্যামল চক্রবর্তী। ১৯৮২ সালের বিধানসভার সাধারণ নির্বাচনেও এই কেন্দ্র থেকে বিধায়ক এবং রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য। ১৯৮৭ ও ১৯৯১ সালেও মানিকতলা থেকে বিধানসভায় জয়ী হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জয়ী হতে পারেননি। ২০০৮ সালে রাজ্যসভার সাংসদও হয়েছিলেন তিনি।



বক্তা শ্যামল চক্রবর্তী তিনি যতটা জনপ্রিয়, লেখক হিসাবেও গভীর দাগ কেটে গিয়েছে পাঠকের মনে। অসংখ্য বই লিখেছেন। তাঁর মধ্যে অন্যতম ৬০-৭০ ছাত্র আন্দোলন, কাশ্মীর-অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত, সমাজতন্ত্র কী এবং কেন, তিন প্রসঙ্গ, গরু ও ত্রিশূল, আর্যরা কি ভারতের আদিম অধিবাসী, ঝড়ের খেয়া, ইত্যাদি। 


আরও পড়ুন : জমিতে চাষ করতে গিয়ে হাইটেনশন লাইনে ঝলসে গেল ফটিক


লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দল থেকে ‘বহিষ্কার’ শ্যামল চক্রবর্তী হয়তো মন থেকে মনে নিতে পারেননি। একটা সময় আলিমুদ্দিনও যখন সোমনাথ নিয়ে নরম সুর, ২০১৫ সালের জুলাইয়ে সীতারাম ইয়েচুরিকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি চলে যান শ্যামল চক্রবর্তী। যা নিয়ে সে সময় জোর জল্পনা তৈরি হয়। এ সবের তোয়াক্কা না করে ভাত, ডাল, পোস্ত, আলুভাজা আর মাছ দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে যখন কলকাতায় ফেরেন, বৃদ্ধ শ্যামলের মুখে এক তৃপ্তি হাসি। অনেক দিন পর বন্ধুকে পেয়ে মনখোলা আড্ডা মারতে পেরে অত্যন্ত খুশি শ্যামল। সাংবাদিকরা যখন ইয়েচুরিকে ঘিরে প্রশ্ন করছেন সোমনাথ কি আবার সিপিএমে ফিরছেন, ইয়েচুরির সহাস্যে উত্তর, কয়েক জন কমিউনিস্ট এক ছাদের নীচে এলে যা যা আলোচনা হয়, তাই হয়েছে! শ্যামলের কাছে বুম ধরলে কোনও উত্তর না দিয়ে হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেন এখনও তিনি সেই সোমনাথেই মশগুল!