অর্থের জগতকে শিল্পীর প্রতিবাদ, নগ্ন হয়েই রইলেন গ্যালারিতে
সৌরভ পাল
সাদা ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে আঁচড়ে শিল্প বড় হচ্ছে। রঙে, তেলে, জলে মিশে একাকার বিশ্ব ভুবন। প্রতিবাদের ছবি ক্যনভাসে ক্যানভাসে 'সুনামি' আনছে। প্রতিবাদের ভাষায় ছবিতে স্থান পেয়েছে নগ্নতা। কিন্তু উল্টো একটা ঘটনা, যা বুকের পাঁজরে হাতুড়ি দিয়ে বার বার আঘাত করে যায়, 'প্রতিবাদ জানাতে ক্যানভাসে নগ্নতা আঁকলেন না, বরং নিজেই নগ্ন হলেন'। বুলেটের গতিকে হার মানিয়ে চেতনায় উল্কাপাত ঘটিয়েদিলেন কম্বোডিয়ান শিল্পী। পুঁজির কাছে বিক্রি না হয়ে নগ্নতায় জানালেন প্রতিবাদ। নগ্ন করলেন সমাজটাকে।
ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না...প্রতিবাদ গানে। কলকাতার রাজপথে হোক কলরব, ল্যাম্প পোস্টের মতই কেবল কালো মাথার ভিড় আর আরও আরও চিৎকার, আরও আরও স্লোগান, এটাও প্রতিবাদের ভাষা। মিছিলে মিছিলে প্রতিবাদ। আমার নাম, তোমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে 'হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কন্ঠ ছাড়ো জোড়ে'। কলকাতার আকাশ প্রতিবাদের ধ্বনিতে মিলিয়ে যায় ভিয়েতনামে। দুয়ারে দুয়ারে 'ফ্যান চাই', দুর্ভিক্ষের প্রতিবাদের ইতিহাস আজও উজ্জ্বল। কলমকে স্তব্ধ করতে কলমকারের রক্ত ঝড়েছে দুই বাংলায়ই। ব্লগার খুনে ওয়েব দুনিয়ায় আরও বেশি ব্লগ তৈরি হওয়াও, প্রতিবাদ। প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন শর্মিলা চানুও। জিভে জল নেই, পেটে নেই দানা, নিস্তব্ধতায় প্রতিবাদ যেন আরও জোড়ালো। দেশভাগের যন্ত্রণা, সিনেমায় প্রতিবাদের কথা জানিয়েছেন ঋত্বিক কুমার ঘটক।
তেহেরিক স্কোয়ার থেকে পুনের ফিল্ম ইন্সটিটিউট, মানছি না মানব না কেবল ট্যাগ লাইন নয়, অধিকারের প্রতিবাদ, শিল্পের প্রতিবাদ। কলম, তুলি, সুরের লড়াই এখন কেবল মাত্র বন্দুকের বিরুদ্ধে নয়। লড়াই শিল্প বনাম পুঁজির। একচেটিয়া পুঁজির মালিকের কাছে বিকিয়ে যাচ্ছে শিল্প, প্রতিনিয়ত বিক্রি হচ্ছে শিল্পসত্ত্বা। শিল্পীর প্রতিবাদ কী হবে, কোন ভাষায় কথা বলবেন প্রতিবাদী তাও যদি সমাজ ঠিক করে দেয়, তাহলে সেটা কি আদৌ প্রতিবাদ হয়, না কি হয় ফরমায়েশ? এই চলো, একটু প্রতিবাদ করি বলে ফেসবুকে কয়েক কলি শব্দ ঝরিয়ে আহা, দেখো প্রতিবাদ করেছি আর আমার প্রতিবাদে সামিল হতে লাইক দাও, শেয়ার করো বলেও প্রতিবাদ চলছে। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে এই প্রতিবাদও প্রতিবাদ, আর এদের একটা স্পেশাল ক্যাটাগরিও আছে, আছে নামও। 'সো কলড এলিট', 'কর্পোরেট বিপ্লবী' বা বলা হয় ফেসবুক বিপ্লবী। হ্যাঁ। এমনটা হচ্ছে। এবার এই 'বড্ড কঠিন' কাজের বদলে প্রতিবাদ জানাতে যদি গোটা একটা দিন হাজার হাজার লোকের সামনে আপনাকে নগ্ন অবস্থায় বসে থাকতে হয়? পারবেন? বিকৃত মস্তিষ্ক ইংরাজি ভাষায় যাকে বলা হয় 'pervert', এমনটাই মনে হবে! সমাজ বলবে 'ন্যুডিটি'। ফ্রিতে একটা নেংটো শরীর দেখতে ভিড়ও জমে যাবে। কামরস মনে যৌনবিপ্লবের দ্বারও উন্মোচন করবে। প্রতিবাদের ভাষা-টাসা তখন 'ঝলসানো রুটি', ও দেখতেও বড্ড বাজে আর খেতেও বড্ড বিস্বাদ। আবার প্রশ্নটা করছি, আপনি পারবেন তো? পারবেন তো এত কিছুর মধ্যে বিল্পবে, প্রতিবাদে নিজেকে এগিয়ে দিতে? উত্তরটা আপনি মনে মনেই দিয়ে দিন। উত্তরটা হল, আপনি পারবেন না। কারণ, শিল্পসত্ত্বাটা বড্ড দেখানো, ভাবানো নয়। আর এই 'অসম্ভব' এমন প্রতিবাদ একজন করে দেখিয়ে দিলেন। অর্থ, পয়সা, ধন, দৌলতের কাছে নিজেকে বিকিয়ে না দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নগ্ন হয়েছেন। আসলে নগ্ন করেছেন সমাজটাকে।
মনে আছে মনিপুর? 'Rape us, not our childrens'। মনে আছে এই স্লোগানটা? মায়েরা নিজের মেয়ের সম্ভ্রম বাঁচাতে নগ্ন হয়ে পথ হেঁটেছিলেন। তখনও তো নগ্ন হয়েছিল সমাজটা। 'রাজা তোর কাপড়' কোথায়? এই প্রশ্নটাই তো ছুড়ে দিয়েছিল 'মা'য়েরা।
কেনা-বেচার হাটে স্বতন্ত্র প্রতিবাদ কন্ঠে অনাবৃত হলেন। পেঁয়াজের খোসার মত একটা একটা আস্তরণ খুলে পড়ছে, বৃষ্টি হচ্ছে চোখে। চাই না অর্থ। চাই না ধনদৌলত। 'শিল্পকে কোল বালিশ করে বাঁচা'র থেকে নগ্ন হওয়াই শ্রেয়, এই পথটাই বেছে নিয়েছেন শিল্পী ও সাইকোথেরাপিস্ট লিজা লেভি। কম্বোডিয়ান শিল্পী কষিয়ে চড়টা মারলেন পুঁজির সাম্রজ্যবাদের বিরুদ্ধে। মার্কিন মুলুকের নিউ ইয়র্ক শহরে সমবেত হোয়াইট কলারদের মুখে সাদা চামড়ার লিজা লেভির নগ্নতা গ্যালন গ্যালন কালি একেবারে চোখে মুখে লেপে দিলো। এ কালি ডিটারজেন্টেও পরিষ্কার হওয়ার নয়। কর্পোরেট তুমি অর্থ বোঝো, শিল্প বোঝো না। আলু বেচা আর পটল বেচার মত শিল্পটা বেচা যায় না!
আপনি নিশ্চয় বোঝেন, একজন মহিলাকে হাজার হাজার মানুষের সামনে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ দেখাতে হলে কতটা দম লাগে। শালিকের মত হৃদপিণ্ড নিয়ে বাঁচবেন না, কলজেটাকে বড় করুন। বাজপাখিরা উড়তে ভয় পায় না, বাঁচুন বাজের হৃদপিণ্ড নিয়ে। প্রতিবাদ জানাতে আপনার মনে কোনও ভয়? সেটা কিন্তু আপনার মনুষত্ত্বে শোভা পায় না। কি তাই তো?