টেমসের তীরে শিকড়ের খোঁজ, বাঙালিয়ানায় রঙিন ব্রিটেনের দুর্গাপুজো
ওয়েব ডেস্ক: গঙ্গা আর টেমস কি কখনও মিশে যেতে পারে? আলবাত পারে। বাঙালির শিকড়ের খোঁজ যদি প্রাণের উত্সবের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়, তখন গঙ্গা আর টেমসের পাড় বাঙালিয়ানায় রঙিন হয়ে ওঠে। এবারও বিলেতের দুর্গাপুজোতেও ছিল সেই রঙ।
কলকাতার সঙ্গে লন্ডনের পুজোর তফাত একটাই। রাস্তার উপর প্যান্ডেল খাটিয়ে বারোয়ারি পুজোর বালাই নেই। কিন্তু ভক্তি আছে। মনের খোরাক আছে। রয়েছে বাঙালিয়ানা। প্যান্ডেল নেই তাই ভরসা কমিউনিটি হল।
ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছেন প্রবাসী বাঙালিরা। লন্ডনের ক্যামডেন সেন্টার থেকে শুরু করে হ্যারো, ম্যানর পার্ক, সাউথ হল, কেনসিংটন, ক্রয়ডন, স্লাও, হ্যাম্পস্টেড ও হ্যামারস্ট্রিটের মতো বিভিন্ন এলাকায় বড় করে পুজো হয়। এ ছাড়াও ম্যাঞ্চেস্টার, লিভারপুল, বার্মিংহ্যাম, নিউ ক্যাসল, বাকিংহ্যামশায়ার ও স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতেও দুর্গাপুজোয় মেতে ওঠেন বাঙালিরা।
আরও পড়ুন-অর্থনীতিতে নোবেল পেতে চলেছেন রঘুরাম রাজন?
ইংল্যান্ডের সব থেকে পুরনো পুজো হয় ক্যামডেন সেন্টারে। ১৯৬৬-তে সরস্বতী পুজো দিয়ে শুরু। তারপরেই জন্ম ব্রিটেনের প্রথম দুর্গাপুজোর। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আজও অমলিন ক্যামডেন সেন্টারের পুজো। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ২০০৬ সালে ক্যামডেনে শোভাযাত্রা করে নিয়ে আসা হয় প্রতিমা। কলকাতার কুমোরটুলি থেকে মা দুগ্গার জাহাজ পাড়ি।
কলকাতাকে টেক্কা দিতে ক্যামডেনে এখন থিমের পুজো। এ বছর থিম ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধের কন্যাশ্রী। বিশ্বমঞ্চে সেরার শিরোপা জিতে নেওয়ার পর কন্যাশ্রী এখন প্রকৃত অর্থেই বিশ্বশ্রী। সুদূর ব্রিটেনেও সেই কন্যাশ্রীরই জয়গান।
পুজোর সব উপকরণ আনা হয় কলকাতা থেকেই। কিন্তু শুধু মণ্ডপে পুজো হলেই তো হল না। পুজোয় চাই স্টল। খাওয়া দাওয়া থেকে পোশাক, কর্পোরেট মোড়কে যেন বাংলারই গল্প। বছরভরের রোজনামচা থেকে বেরিয়ে বাঙালিয়ানায় মাখামাখি। আরও বেশি করে বাঙালি হয়ে ওঠা।
কলকাতার মতো ক্যামডেনেও প্রতিমা দর্শনে দীর্ঘ লাইন। ব্রিটেনের ভিন্ন প্রান্ত থেকে ভিড় জমান বহু মানুষ। এত মানুষের ভিড়। ফাস্টফুড ছাড়া কি পুজো জমে? সিঙাড়া, চপ, তেলেভাজা, বাদ নেই কিছুই। রসনায় পিছিয়ে নেই প্রবাসের বাঙালিরাও।
পুজোর নিয়মে ত্রুটি রাখতে নারাজ ক্রয়ডনের বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন। নির্ঘণ্ট মানতে না পারলেও, শিকড়ের টান আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে এই পুজোয়। ভক্তিতে কোনও খামতি নয়। তাই পুরোহিতের বিশেষ ব্যবস্থা। বাঙালিয়ানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য আড্ডাতেও ব্রিটেনের অন্য পুজোকে টেক্কা দেয় ক্রয়ডন। লন্ডনের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ জড়ো হন পুজোর কটা দিন। হুল্লোড়ের জৌলুসে ক্রয়ডন যেন একটুকরো কলকাতা।
আরও পড়ুন-ধোনিকে বড় ক্রিকেটার বানিয়েছে সৌরভের আত্মত্যাগ : সেওয়াগ
লন্ডন থেকে থেকে একটু দূরে, জায়গাটার নাম স্লাও। প্রতি বছর সাবেকিয়ানার পুজো দেখে স্লাও। সবথেকে বড় কথা, এখানে কোনও কমিউনিটি হল ভাড়া নেওয়া হয় না। রীতিমতো প্যান্ডেল খাটিয়ে পুজো হয় এখানে। সৌজন্যে স্লাও ক্রিকেট অ্যান্ড হকি অ্যাসোসিয়েশন।
ব্রিটেনে বেড়ে উঠলেও প্রবাসী বাঙালিদের সন্তানরা যাতে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে, বাঙালিয়ানা যাতে হারিয়ে না যায়, সে বিষয় সচেতন বাবা-মায়েরা। শুধু প্রবীণ নয়, নবীনের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে চান তাঁরা।
শুধু সংস্কৃতি নয়, বাঙালি নারীর অঙ্গশোভায় শাড়ির কোনও বিকল্প নেই। বিদেশের যে প্রান্তেই যাক না কেন, বাঙালি নারী শাড়িতেই বুঁদ। সেই ভালবাসাকেই বিলেতে নতুন করে রঙিন করেছেন এক বঙ্গনারী। শাড়ির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা জুড়তে যিনি প্রবাসেও বাঙালি নারীর প্রতীক। রোশনি মুখোপাধ্যায়।
প্রবাসে শুধু ভক্তিভরে পুজোই নয়, কবজি ডুবিয়ে ভূরিভোজও মাস্ট। রয়্যাল বার্কশায়ারের পুজোয় হেঁশেলে ম ম করা গন্ধ আর বাঙালি রসনাতৃপ্তির সব উপকরণ যেখানে মজুত। কোনও ভাড়া করা রাঁধুনি নয়, রান্না থেকে পরিবেশন, সবই হাতে হাতে সারেন পুজো কমিটির কর্তারাই।
বিলেতের বিসর্জনেও অভিনবত্বের ছোঁয়া। গঙ্গা বা ইছামতীর মতো টেমস এখানে বুক পেতে দেয় না মাকে কৈলাস পৌঁছে দিতে। মনখারাপের জলে ভিজলেও টেমসের পাড় মাকে বরণ করে উল্লাসে মাতে। প্রাণের উত্সব-অন্তের ক্ষণটিকে মনের মণিকোঠায় সযন্তে আগলে রাখে প্রবাসী বাঙালিরা।