অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ফিদেল কাস্ত্রো...নামটাই মনে করিয়ে দেয় একটি ছোট্টো দেশের কথা। যে দেশটা থামতে শেখেনি কোনও দিন। যে দেশটা হারতে শেখেনি কোনও দিন। শেখেনি বড়দের চোখ রাঙানি মেনে নিতে। তাই বোধহয় আজও কেউ সেখানে যাওয়ার আগে বলেন না কিউবা যাচ্ছে! বরং বলেন, কাস্ত্রোর দেশে যাচ্ছি। কারণ, ১ কোটি ১৩ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটির প্রতিটি মানুষেরই যে একটাই পরিচয়...'কাস্ত্রোর দেশের মানুষ।'


৯০ বসন্ত...থুরি, ৯ দশকের সংগ্রাম পেরিয়ে আজ তিনি আর নেই। তবে রেখে গেছেন সেই ১ কোটি ১৩ লাখ কাস্ত্রোকে। তাঁরা জানেন, এই নেতা কী করেছেন তাদের জন্য।


ক্যারিবিয়ান সাগরের ওপর অবস্থিত একটি ছোট্টো দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা। ঔপনিবেশিক শ্মাসন থেকে মুক্তির দাবিতে কিউবাতে লড়াই শুরু হয় ১৮৯৫ সাল থেকে। অবশেষে আন্দোলন, সংঘাত পেরিয়ে ১৯০২ সালে কিউবাকে ঘোষণা করা হয় জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, তারপর থেকেই 'বড়দা' আমেরিকার চোখ রাঙানি শুরু হয় এই দেশটির ওপর। প্রধানত তামাক ও চিনি উত্‍পাদনকারী এই দেশটির ওপর বছরের পর বছর ধরে নজর ছিল আমেরিকার। কিন্তু তাতে বাধ সাধেন ১৯২৬ সালে সেদেশে জন্ম নেওয়া 'বিচ্ছু' ছেলেটি। মা-বাবা আদর করে নাম দিয়েছিলেন ফিদেল আলেজান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ। পড়াশুনোতেও নেহাত খারাপ ছিলেন না।


কিন্তু, তারপর যে কী ভুত চাপল ছেলেটার মাথায় যে সরাসরিই নেমে পড়লেন সমাজের জন্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। চোরাগোপ্তা নয়, সরাসরি লড়াই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে।


লড়াই যে মসৃণ হবে না তা প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন। তাই মাত্র ৮২ জনকে নিয়েই শুরু করে দেন নিজের পথ চলা। অর্থনৈতিক ব্যারিকেড, খুনের শাসানি, খুনের চেষ্টা থেকে চরিত্র হনন...সবই হয় তার বিরুদ্ধে। অবশেষে, সব প্রতিপক্ষই পিছু হটতে বাধ্য হয় তাঁর কাছে। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরের এই লড়়াইতে কখনও ঝুঁকতে দেখা যায়নি তাঁকে।


সহজ ছিল না ফিদেলের এই 'আমেরিকা জয়'...এই লড়াইয়ে ফিদেলকে লড়তে হয়েছে একের পর এক 'হেভিওয়েট'-এর সঙ্গে। আজ সবটাই ইতিহাস....যে ইতিহাস আগামী কয়েক প্রজন্মকে বিপ্লবের পাঠ শেখাবে....


১) 'দেশকে বিকোতে দেব না,' এই মনোভাব নিয়ে এগোতে গিয়ে প্রথমেই ফিদেল মুখোমুখি হন দুইথ ইসেনহোয়ারের। বে অফ পিগস-এ ফিদেল ও তাঁর অনুগামীদের আটকাতে আমেরিকার এই প্রেসিডেন্ট সাহায্য করেছিলেন কিউবার তত্‍কালীন শাসক ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে। অস্ত্র ও সৈন্য পাঠিয়ে আটকানোর চেষ্টা করা হয় ফিদেলকে।


২) ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ফিদেলকে লড়়াই করতে হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির বিরুদ্ধে। অর্থনৈতিক ব্যারিকেড থেকে অস্ত্র যোগানে কিউবাকে পঙ্গু করার চেষ্টা করেন কেনেডি।


৩) এরপরই তাঁকে পড়তে হয় লিন্ডন জন্সনের থাবার মুখে। রক্তচক্ষু, দাদাগিরি ও শেষে নিকেল রপ্তানির ওপরও আসে নিষেধাজ্ঞা। আবারও সেই ব্যারিকেড। তবুও, না মানার প্রতিজ্ঞা। আর তাই রক্তচক্ষু, দাদাগিরিকে উপেক্ষা করেই এগিয়ে চললেন এই যোদ্ধা।


৪) যখন ভাবছেন এই তাবড় তাবড় নেতাদের আক্রমণের হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছেন, ঠিক তখনই সিনে এলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন। একই নীতি তাঁরও। যেভাবেই হোক আটকাতে হবে ফিদেলের সফরকে। গ্রেফতার করা হল শ'য়ে শ'য়ে কিউবার মত্‍স্যজীবীকে। তবুও না। কিছুতেই দমানো গেল না তাঁকে।


৫) এলেন জেরাল্ড ফোর্ড। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭-এর মধ্যে তিনিও নানা ভাবে আক্রমণ হেনেও রুখতে পারলেন না এই আজব মানুষটাকে।


৬) এরপর মার্কিন শাসনে আসেন ডেমক্রেট পার্টির সদস্য জিমি কার্টার। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে কিছুটা হলেও সম্পর্কে উন্নতি ঘটে। ব্যারিকেড নয়, তাঁর সময় শিথিল করা হয় কিউবার প্রতি আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গী।


৭) কয়েকদিন যেতে না যেতেই, ফের পরিবর্তন আমেরিকায়। কার্টারের পর মার্কিন শাসনে আসেন রোলান্ড রেগান। বলা হয় তাঁর শাসনকালেই আমেরিকা ও কিউবার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি চরমে পৌঁছে যায়। টিভি, রেডিও থেকে প্রতিটি প্রচার মাধ্যেমে ফিদেলের বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রচার। কঠোর করা হয় ব্যারিকেডের নীতি।


৮) জর্জ H.W. বুশ। নামটা হয়তো আপনাদের অবনেকেরই মনে আছে। তাঁর শাসনকালেই টোরিসেলি আইন পাশ করিয়ে ১৯৮৯ সালে চরম অর্থনৈতিক ব্যারিকেডের মুখে ফেলে দেওয়া হয় কিউবাকে। আমেরিকার কথা শুনে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশও সেই সময় কিউবার সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। ফলে, চরম সমস্যায় পড়তে হয় কিউবাকে।


৯) ১৯৯৩ থেকে ২০০১। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন। আইনে আরও বদল। কঠোর কিউবার বিরোধিতা। ভয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে গেলেন ৩৬ হাজার কিউবার বাসিন্দা। ফিদেলের বিরুদ্ধে শুরু হল আরও জোরাল প্রচার।


১০) তারপরও কমেনি সমস্যা। জর্জ H.W. বুশের ছেলে জর্জ W বুশের রাজত্বেও একইরকম ভাবে শুরু হয় ফিদেল বিরোধী প্রচার। জারি থাকে অর্থনৈতিক ব্যারিকেডও। তবুও ধৈর্যচ্যুতি হয়নি তাঁর। লড়াইয়ের ময়দান ছেড়েও পালিয়ে যাননি তিনি। নিজেকে আরও কঠোর, আরও দৃঢ় করেছেন। দৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠেছেন ''The revolution is a dictatorship of the exploited against the exploiters"


১১) যদিও, তারপর থেকে ধীরে ধীরে কিউবার সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতি হতে শুরু করে। বারাক ওবামার শাসনে বেশ কয়েকটি ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে, তখন শারীরিক কারণে দায়িত্ব থেকে সরে গেছেন ফিদেল। তবুও, শাসনের রাশ তাঁর হাতেই। অবশেষে সেই ঐতিহাসিক দিন। ২০১৪-র ডিসেম্বরে ওবামা ও রাউল কাস্ত্রো যৌথভাবে ঘোষণা করেন, "কিউবা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হল। থাকল না আর কোনও ভেদাভেদ।"


আজ ফিদেল প্রয়াত। কিন্তু রেখে গেলেন সেই বিখ্যাত উক্তি ''I think that a man should not live beyond the age when he begins to deteriorate, when the flame that lighted the brightest moment of his life has weakened."