শুভপম সাহা: এক জীবনে অনেক জীবন বাঁচা যায়। এক জীবনে অনেক জীবন বাঁচানো যায়। আবার এই এক জীবনেই 'বিশ্বযুদ্ধ' রুখে দেওয়া যায়! এমনটা আর ক'জনই বা পারেন! যিনি পারেন মহাকাল তাঁকে মনে রাখে, এই বিশ্ব তাঁকে বুকে রাখে। যেমনটা পেরেছিলেন জেমস হিলিয়ার ব্লাউন্ট (James Hillier Blount) ওরফে জেমস ব্লান্ট (James Blunt)। 


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

জেমস ব্লান্ট কে? একজন আন্তর্জাতিক পপ তারকা? যাঁর প্রথম অ্যালবাম 'ব্যাক টু বেডলাম' (Back to Bedlam) সারা বিশ্বে এখনও পর্যন্ত ১১ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে! যাঁর 'ইউ আর বিউটিফুল' (You're Beautiful) শুনে প্রেমের সাগরে ডুব দেওয়া যায় বারবার? নাকি যিনি প্রাণের বন্ধু ও আরেক বিশ্ববন্দিত গায়ক এড শিরানের (Ed Sheeran) সঙ্গে চুক্তি করেছেন যে, তাঁকে গান লেখা শিখিয়ে দিলে তবেই তিনি এডকে স্কি করা শেখাবেন! এসবই গায়ক ব্লান্টকে নিয়ে কথা বললে আলোচনায় আসবে।



ব্রিটিশ গায়ক-গীতিকার হিসাবে যে ব্লান্টকে এখন গোটা দুনিয়া চেনে, সেই ব্লান্টের আরও একটা 'অসামান্য' পরিচয় রয়েছে। সে কথা বলতে গেলে ঘড়ির কাঁটাকে বেশ কিছুটা পিছন দিকে ঘোরাতে হবে। অতীতের সরণি ধরে হাঁটলে বোঝা যাবে যে, সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের (Russia-Ukraine) আবহে ব্লান্টের কথা কেনও আজ ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। 


এক অন্য ব্লান্টকে চেনার জন্য একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। উইল্টশায়ারের টিডওয়ার্থের ৪৯ বছরের বাসিন্দা ১৯৯৬ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ছিলেন ব্রিটিশ সেনায়। স্যান্ডহার্স্টের রয়্যাল মিলিটার কলেজ (Royal Military College, Sandhurst) থেকে সেনা প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্লান্ট যোগ দিয়েছিলেন লাইফ গার্ডস (হাউসহোল্ড ক্যাভালরি রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত) রেজিমেন্টে। এখান থেকেই ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় উত্তীর্ণ হন ব্লান্ট। অস্ত্র প্রশিক্ষণের পাঠ নিতে তিনি আবার গিয়েছিলেন কানাডার শাফিল্ডে অবস্থিত ব্রিটিশ আর্মি ট্রেনিং ইউনিউটেও (British Army Training Uni Suffield, BATUS)। সেখানে ব্লান্টের রেজিমেন্টের ছ'মাসের পোস্টিং ছিল। ব্লান্ট সেখানে কমব্যাট ট্রেনিংয়ের অনুশীলন নেন। শিখে নেন কী ভাবে অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে।



যোদ্ধা ব্লান্টকে আসল পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল ১৯৯৯ সালে কসোভোয়Russia-UkraineWar: International pop star James Blunt who stopped third world war । যা ব্লান্টের জীবন জীবনদর্শন আমূল বদলে দিয়েছিল। ব্রিটিশ সেনার ক্যাভালরি রেজিমেন্টের অন্তর্গত ব্ল্যু অ্যান্ড রয়্যালস (Blues and Royals) স্কোয়াড্রনের কর্মকতা হয়ে বছর পঁচিশের ব্লান্ট ন্য়াটোর (North Atlantic Treaty Organization, NATO) সঙ্গে মোতায়েন ছিলেন কসোভোতে (Kosovo)। ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার কর্মকর্তা ব্লান্টকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রিস্টিনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি (Pristina International Airport) দখলে আনার।


ঘটনাচক্রে ন্যাটো দখল নেওয়ার আগেই সেই বিমানবন্দর রুশ সেনার কবজায় চলে এসেছিল। ২০০ রাশিয়ান সেনা অস্ত্র তাক করে ছিলেন ব্লান্টদের দিকে। ব্লান্ট ৩০ হাজার ন্যাটো সেনার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ইউনিটের প্রধান ছিলেন তিনিই। বোঝাই যাচ্ছে যে ওই প্রিস্টিনা বিমানবন্দরে স্ট্যান্ড-অফ ঠিক কতটা উত্তপ্ত হয়েছিল সেসময়। 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী'। যার আক্ষরিক অর্থ, যুদ্ধ না করে সূচের অগ্রভাগ সমান মাটিও ছেড়ে দেবে না কেউ।  যদিও ন্যাটো ইচ্ছা করলে তুড়ি মেরে রুশ সেনাকে গুঁড়িয়ে সেদিন বিমানবন্দরের দখল নিতে পারত। ২০০ সেনা বনাম ৩০ হাজার সেনা! এক অসম লড়াই! কে বিজয়ী হবে তার আগাম অনুমানের জন্য কোনও পুরস্কার নেই।



লড়াইয়ের অদম্য নেশা ও দখল নেওয়ার অমোঘ টান থেকেই শুরু হবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ! মন সায় দেয়নি ব্লান্টের! ব্লান্ট আক্রমণের পথ বেছে নেননি। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বহু বছরের রাজনৈতিক শত্রুতার পাঠ নিশ্চই তাঁরও অজানা ছিল না। এর মধ্যেই কিন্তু ব্লান্টের কানে তাঁর উর্ধ্বতনের নির্দেশ রেডিও বার্তায় চলে এসেছে। যেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছিল বিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা। এই প্রসঙ্গে বিবিসি-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্লান্ট বলেছেন, "জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্কের কাছ থেকে সরাসরি নির্দেশ এসেছিল রাশিয়ান সেনাদের পরাভূত করার। বিভিন্ন শব্দ উনি ব্যবহার করেছিলন, যা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল তখন। রেডিওতে বলা হয়েছিল রাশিয়ানদের ধ্বংস করে দেওয়ার কথা।"



যোদ্ধা ব্লান্টের মানবিক হৃদয় একবারও কোর্ট মার্শাল হওয়ার ভয়ে ভীত ছিল না। সরাসরি ওয়েসলি ক্লার্কের নির্দেশ অমান্য করেন তিনি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা থেকে ব্লান্টকে রুখে দিতে সমর্থন করেছিলেন তাঁর দলের আরেক মানবিক যোদ্ধা। নমা জেনারেল মাইক জ্যাকসন। সেই মুহূর্তে যিনি ব্লান্টকে বলেছিলেন, "তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার জন্য আমার সৈন্যদের দায়ী করতে পারব না।" এমনটাই সাক্ষাৎকারে জানান ব্লান্ট। সেই চর্চিত স্ট্যান্ড-অফে রুশ সেনা কার্যত পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিল আগেই। ব্লান্টদের তারা বলেছিলেন যে, তাদের জল ও খাবার শেষ হয়ে গিয়েছে। যে বিমানবন্দরের দখল নিয়ে এই লড়াই, তা তারা ভাগ করে নেওয়ার অনুমতিও চেয়েছিলেন।


ব্লান্টের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া বা যুদ্ধে তো যাওয়ার কথাই ছিল না। যে হাত বরাবর গিটার তুলে নিতে চেয়েছিল, সেই হাতে কিন্তু নিজের ইচ্ছায় বন্দুক ওঠেনি। আসলে ব্লান্টের রক্তে প্রবাহিত হয়েছিল যোদ্ধা সত্তা। ব্লান্টের বাবাও ছিলেন সেনায়। কর্নেল চার্লস ব্লাউন্ট চেয়েছিলেন ছেলেও তাঁর মতো সেনাবাহিনীতে যোগ দিক।। সেই সূত্রে ব্লান্টের জন্মও হয় টিডওয়ার্থের এক সেনা হাসপাতালে। চার্লস ব্লাউন্ট ব্রিটিশ সেনার হেলিকপ্টার পাইলট ছিলেন বলে ব্লান্টকেও বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ব্লান্ট পাইলট হিসাবে লাইসেন্স পেয়ে গিয়েছিলেন।


ব্লান্টের পড়াশোনার খরচ সেনাবাহিনীই বহন করেছে। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, এবং অর্থনীতির মতো বিষয়ে ব্লান্টের দারুণ দখল ছিল। ইউনিভার্সিটি অভ ব্রিস্টলে গিয়ে তিনি মহাকাশ উত্পাদন প্রকৌশল এবং সমাজবিজ্ঞান (Aerospace manufacturing engineering and sociology) নিয়ে পড়াশোনা করেন। ৯৬ সালে সমাজবিজ্ঞানে তিনি স্নাতক হন। সেনাবাহিনীর অর্থায়নে পড়াশোনা করার জন্যই ব্লান্টকে সশস্ত্র বাহিনীর হয়ে বাধ্যতামূলক ভাবে চার বছর দেশের সেবায় নিয়োজিত থাকতে হয়েছিল। যদিও যোদ্ধার বর্মকে কখনই মন থেকে আপন করতে পারেননি শিল্পী ব্লান্ট। 'ও রে হাল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল!' এমনটাই ছিল ব্লান্টের ভাবনা।




ব্লান্টের কথা বলতে গেলে বারবার কসোভোতেই ফিরতে হবে। ভাবলে অবাক হতে হয় যে, ব্লান্ট যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের গিটার নিয়ে গিয়েছিলেন সঙ্গে করে! স্ট্যান্ড-অফরে সময় প্রায়শই সেনাবাহিনীর ট্যাংকের পাশে গিটার নিয়ে বসে পড়তেন তিনি। বার করে নিতেন কাগজ-কলম। কসোভার স্থানীয় মানুষরাই সেসময় ব্লান্টদের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করতেন। সহযোদ্ধা ও স্থানীয়দের গিটার বাজিয়ে গান শোনাতেন ব্লান্ট। যুদ্ধের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক যোদ্ধা এভাবে শান্তির বার্তা দিচ্ছেন! এমনটা কী আদৌ দেখা যায়!



রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে ব্লান্টই বলতে পারেন, "যুদ্ধে কোনও সাহসিকতা নেই।" তাই তো তিনিই লিখতে পারেন 'নো ব্রেভারি'র (No Bravery) মতো গায়ে কাঁটা দেওয়া, চোখে জল আনা গান। সামরিক পোশাকেও ব্লান্টের চোখে বারবার যুদ্ধবিধ্বস্তদের দুঃখ আর দুঃখই শুধু ফুটে উঠেছে। নাহলে রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে তিনি লিখতেন না,  "And I see no bravery/ No bravery in your eyes anymore/ Only sadness/And I see no bravery/ No bravery in your eyes anymore/ Only sadness/Only sadness" ব্লান্ট আজও যুদ্ধ চান না। নাহলে দিন সাতেক আগে এই গানের ইউটিউব লিঙ্কই টুইট করে লিখতেন না "একটি যুদ্ধের গান!"


আরও পড়ুন: Russia-Ukraine War: 'রাশিয়ার ভবিষ্যতে বিশ্বাস করে না বিশ্ব, তারা Ukraine-র কথা বলে", দাবি Zelensky-র


আরও পড়ুনRussia-Ukraine War: 'NATO যুদ্ধ করবে না Russia-র সঙ্গে, জোটে যোগ দিতে চাই না', দাবি Zalensky-র


(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)