জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটাল ব্যুরো: আয়নাঘর। শুনতে যতটা সাদামাটা ততটাই রহস্যময়। শেখ হাসিনার আমলে তৈরি এই আয়নাঘরেই রাখা হতো গুম করে রাখা মানুষজনকে। আলো বাতাসহীন একটি কক্ষ। সেখানে সারাক্ষণ ঘড়ঘড়িয়ে চল ফ্যান। শেখ হাসিনা বিদায় নেওয়ার পর কথা উঠেছে আয়নাঘরের বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

কাদের রাখা হতো ওই আয়না ঘরে? হাসিনার আমলে বিরোধীদলের বহু নেতা কর্মী নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। তারা কোথায় তাদের কোনও হদিস নেই। এমনকি সেনাবাহিনীর লোকজন রয়েছেন ওই তালিকায়। আয়নাঘর আসলে গোয়েন্দাদের একটি গোপন বন্দিশালা বা ডিটেনশন ক্যাম্প।


আরও পড়ুন-সংখ্যালঘুদের উপরে হামলায় জড়ানো যাবে না, দলের কর্মীদের নির্দেশ খালেদার


বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থার খবর অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ৬০৫ জন গুম হয়েছেন। এদের অনেকেই বিএনপি সমর্থক। এদের অনেককেই জঙ্গি বলে আটক করা হয়। এদের অনেকে ফিরলেও তারা প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। তবে এদের মধ্যে দুজন তা খানিকটা প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন সেলিম নামে একজন। তাঁকে আচমকাই মাথায় টুপি পরিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে জানানো হয় তাকে রাখা হবে আয়না ঘরে। এর দায়িত্বে রয়েছে প্রতিরক্ষা দফতর ডিজিএফআই।


নেত্র নিউজকে সেলিম জানিয়েছেন, সকালের খাবারে বিস্কুট দেওয়া হতো। দিনরাত একটি একজস্ট ফ্যান চলত শব্দ করে। মাঝেমধ্যে বিমান ওঠানামার শব্দ পেতেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে বিনা কারণে মানুষজনকে গুম করার অভিযোগ উঠতো সামরিক গোয়েন্দাদের  বিরুদ্ধে। মূলত আওয়ামী লিগ বিরোধীদের তুলে এনেই বিভিন্ন অভিযোগে আটকে রাখা হতো। সেলিম কোনও হাইভ্যালু বন্দি ছিলেন না। তাই তিনি মুক্তি পান।


ওই আয়নাঘরে এর একজন বন্দি ছিলেন হাসিনুর রহমান। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সেনার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল।  সেলিমের আগে ওই কক্ষে যারা বন্দী ছিলেন, তারাও তার অপহরণকারীদের পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট সূত্র রেখে গেছেন —অনেকেই খাবারের সাথে দেওয়া মাংসের হাড় বা কোন শক্ত বস্তু দিয়ে ডিজিএফআইয়ের নাম কক্ষের দেয়ালে খোদাই করে লিখে গেছেন।


মালয়েশিয়া থেকে এক সাক্ষাৎকারে সেলিম নেত্র নিউজ-কে বলেন, “ওই রুমের ভিতরে আপনার অনেক লেখা। ওয়ালের মধ্যে খোদাই করে লেখা। আমার মনে হচ্ছে এখানে কত লোককে যে রাখা হইছে এটা অনুভব করার মতো না। একেক জনের লেখার হাতের স্টাইল একেক রকম। ‘আমাকে ডিজিএফআই ধরে নিয়ে আসছে’, ‘আমাকে ডিজিএফআই এরেস্ট করছিল বাড়ি থেকে’ — এইরকম অনেক লেখা। অনেকে আবার নাম্বার লিখে রাখছে যে যদি সম্ভব হয় আমার পরিবারকে কেউ বইলেন যে আমাকে যেন খোঁজ করে, আমাকে সরকার এইখানে এইভাবে বন্দি করে রাখছে।


হাসিনুর রহমানের অভিজ্ঞতা সেলিমের উল্টো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই লেফটেন্যান্ট কর্নেল শুরু থেকেই নিজের “হাই ভ্যালু” বন্দি হওয়ার বিষয়টি বুঝতেন। তাকে আটক করা হয় ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট। তবে সেটি ছিল তার দ্বিতীয়বার গুম হওয়ার ঘটনা। তিনি প্রথমবার গুমের শিকার হয়েছিলেন ২০১১ সালের জুলাইয়ে। সামরিক বাহিনীতে তিনি পদকপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন; বীরত্বের জন্য পেয়েছিলেন “বীর প্রতীক” খেতাব। র‍্যাবের একটি ইউনিটের অধিনায়ক থাকাকালে তিনি বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে ২৮ বছর চাকরি শেষে তাকে বরখাস্ত করা হয়। অভিযোগ হল, তিনি নিজেই জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন! এই অভিযোগ তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন।


মিরপুর ডিওএইচএস-এ নিজের বাসা থেকে তাকে যারা ২০১৮ সালে ধরে নিয়ে যায়, তাদের পরনে ছিল পুলিসের গোয়েন্দা শাখা বা ডিবির পোশাক (কাউকে আটক করার কোনো আইনি একতিয়ার ডিজিএফআই-এর নেই; ফলে, কাউকে অপহরণ করতে হলে এই সংস্থার সদস্যরা বেসামরিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় ধারণ করে)।


২০১৮ সালের আগস্টে তাকে তুলে নেয়ার পর হাসিনুর প্রায় ১৮ মাস “নিখোঁজ” ছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তখন অন্য অনেক গুমের শিকার ব্যক্তিদেরদের মতো তিনিও নিজের গুম হওয়া নিয়ে বেশি তথ্য দিতে সম্মত হননি। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুতে সরব হয়েছেন। নেত্র নিউজের একজন সম্পাদক এই ইস্যুতে তার সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব রাখলে তিনি সম্মত হন।


সেলিম তার গুমের বিষয়ে কিছুই না জানলেও, হাসিনুর ছিলেন সামরিক বাহিনীর ভেতরকার একজন লোক। তিনি এই গোপন বন্দিশালার অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ও নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে বলতে পেরেছেন।


তিনি বলেন, “উত্তরে ১৪ তলা বিল্ডিং, দক্ষিণে মেস বি, তার মাঝখানে হল একটা মাঠ, মাঠের মাঝখানে [এই কারাগার]—এর ঠিক পূর্ব পাশে হল লগ এরিয়া হেড কোয়ার্টার, স্টেশন হেড কোয়ার্টার, এবং ইএনসির (প্রধান প্রকৌশলী) অফিস, পশ্চিম পাশে হল এমটি শেড, ডিজিএফআইয়ের এমটি শেড, এবং উত্তর-পূর্ব কোনে হল ডিজিএফআইয়ের মসজিদ। এই গুম হাউজটার ছদ্মনাম হলো আয়নাঘর।”


হাসিনুর রহমানের দেয়া এসব তথ্যের ভিত্তিতেই নেত্র নিউজ কারাগারটির অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। গুগল আর্থের স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত সাম্প্রতিক ছবি অনুযায়ী ওই ভবনটির ছাদ তারপুলিন বা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। হাসিনুর নিজেও সম্প্রতি পাশের একটি ভবনে গিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে ভবনটি আসলেই ছাউনি দিয়ে আবৃত।


সেলিম বলেন: “ফ্যান বন্ধ করলে অনেক লোকের কান্নার শব্দ আসে, কিন্তু ওইটা ফ্যান ছাড়া অবস্থায় বোঝা যায় না।”


হাসিনুর রহমান বলেন: “কোন কিছু যাতে শোনা না যায় এবং ভিতরের কোন শব্দ যাতে বাইরে না যায়, বড় এগজস্ট ফ্যান ইউজ করে, খুব বড় বড়। যেমন ওই প্রতি পাঁচটা রুমের সাথেই দুইটা এগজস্ট ফ্যান, অর্থাৎ, ওই দশটা রুমের সাথে চারটে এগজস্ট ফ্যান, যাতে কোন শব্দ ভিতর থেকে বাইরে না যায়, বাইরের শব্দ ভিতরে না আসে।”


যেসব সেলে তারা বন্দি ছিলেন, সেসব সম্পর্কেও কাছাকাছি বর্ণনা দেন দুই জন। যেমন, সেখানে কোনো জানালা ছিল না। ছিল দুই অংশ-সমেত একটি দরজা: একটিতে ছিল লোহার শিকের দরজা, তারপর কাঠের দরজা, যেখানে একটি ছিদ্র করা।


যেই দুই সামরিক কর্মকর্তা আয়নাঘরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নেত্র নিউজকে নিশ্চিত করেছিলেন, তাদের একজন এই কারাগারের কয়েকটি ছবিও আমাদের সরবরাহ করেন। সেই ছবিগুলোও এই দুই জনের বক্তব্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।


সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র কারাগারের সাবেক ও বর্তমান বন্দিদের একটি তালিকা নেত্র নিউজকে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন মোবাশ্বের হাসান, যিনি ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর ভারতের সংবাদ মাধ্যম দ্য ওয়্যারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তাকে ডিজিএফআই অপহরণ করেছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, যিনি নিজেও একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, ও ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায় একসময় আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন।


বর্তমানে যারা আটক রয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ২ জন ব্যক্তি যাদেরকে ২০১৬ সালের আগস্টে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ধরে নিয়ে যায়। এদের একজন হলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেম। আরেকজন হলেন আবদুল্লাহিল আমান আযমী, যিনি নিজেও সেনাবাহিনীর একজন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। আযমী হলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের ছেলে। গোলাম আযমও একই আদালতে দণ্ডিত হয়েছিলেন।


মীর আহমেদ বিন কাসেম ও আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে আয়নাঘরে দেখেছেন এমন দুই কর্মকর্তা বিষয়টি নেত্র নিউজকে নিশ্চিত করেছেন। এমনকি হাসিনুর রহমান যখন বন্দি ছিলেন তখন তিনিও আয়নাঘরে তাকে দেখেছেন। তাদেরকে রুটিনমতো টয়লেটে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে যেসব প্রহরীরা ছিলেন, তাদের বিভ্রান্তির কারণে হাসিনুর টয়লেটে আযমীকে দেখে ফেলেন। পরবর্তীতে তিনি সেখানে কর্মরত এক বেসামরিক প্রহরীর মাধ্যমে বিষয়টি আরও নিশ্চিত হন।



(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের AppFacebookWhatsapp ChannelX (Twitter)YoutubeInstagram পেজ-চ্যানেল)