প্রাণেশ্বরী পরম যন্ত্রণার
সুচিক্কণ দাস
ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর। আর মন খুঁজে ফেরে মুখ। জীবন্ত নারীর সঙ্গে প্রতিমার মুখের কী মিল আছে? শিল্পীর মানসলোকে প্রতিমার যে মুখ ফুটে ওঠে, তা কি কোনও জীবন্ত নারীর? নাকি নিখাদ কল্পনার?এ বিভ্রান্তি আজও গেল না।
ছোটবেলায় দেখতাম মুর্শিদাবাদের শিল্পী রঙ-তুলির ছোঁয়ায় কী পরম মমতা একটু একটু করে চোখ আঁকছেন প্রতিমার। তারপর ঘামতেল দিয়ে সেই প্রতিমা মণ্ডপে যখন নিয়ে যাওয়া হল, তখন দূর থেকে তাঁকে প্রণাম জানানোই ছিল দস্তুর। বালকের চেতনায় তো আর বড় হয়ে ওঠার জটিল মনস্কতার ছোঁয়া নেই। এমনি করে কেটে গেল শৈশব-কৈশোর-যৌবন। নানা ঘাত প্রতিঘাতে মনের ভেতরকার ধর্মের বাঁধন গেল আলগা হয়ে। প্রতিমা তো মাটির মূর্তি মাত্র। এর বেশি কিছু নয়। একথা মনকে ধরে বেঁধে বোঝাতে অবশ্য কম কসরত করতে হয়নি। কিন্তু যখনই মণ্ডপে গিয়ে প্রতিমার মুখের দিকে তাকিয়েছি, তখনই শুরু হয়েছে এক অদৃশ্য রক্তক্ষরণ, অশ্রুতে সিক্ত হয়ে উঠেছে হৃদয় পারাবার।
এ কি মোহ? এ কি অন্তরের দুর্জ্ঞেয় এক কোণে লুকিয়ে থাকা ধর্মবিশ্বাসের অবশেষ? নাকি প্রবল শক্তির আধার এক নারীর পায়ে দুর্বল, অসহায় পুরুষের আত্মসমর্পণ? তরুণ বয়সের শুরুতে পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের এবার ফিরাও মোরে। কবিতার শেষের দিকে লাইনগুলো এরকম, তারপর জীবযাত্রা অবসানে/ ক্লান্ত পদে রক্তসিক্ত বেশে/ উত্তরিব একদিন শ্রান্তিহরা শান্তির উদ্দেশে/ প্রসন্নবদনে মন্দ হেসে / পরাবে মহিমালক্ষ্মী ভক্তকণ্ঠে জয়মাল্যখানি/ করপদ্ম পরশনে শান্ত হবে সর্বদুঃখগ্লানি, সর্ব অমঙ্গল/ লুটাইয়া রক্তিম চরণতলে/ ধৌত করি দিব পদ আজন্মের রুদ্ধ অশ্রুজলে/ সুচিরসঞ্চিত আশা সম্মুখে করিয়া উদঘাটন/জীবনের অক্ষমতা কাঁদিয়া করিব নিবেদন/মাগিব অনন্ত ক্ষমা/ হয়ত ঘুচিবে দুঃখনিশা/ তৃপ্ত হবে একপ্রেমে জীবনের সর্বপ্রেমতৃষা।
কল্পনায় সেই মহিমালক্ষ্মীর মুখ আঁকার চেষ্টা করতাম। কিন্তু কোনও আদলই তৈরি হয় না। একটা সময়ে মনে প্রশ্ন দেখা দিতে শুরু করে, সত্যিই যদি মহিমালক্ষ্মী কেউ থাকতেন, তাহলে কেমন হত তাঁর মুখ? মায়ের মতো? স্ত্রীর মতো? মেয়ের মতো? মনে মনে গোপনে কামনা করা কোনও প্রেমিকার মতো? উত্তর মেলে না। একে একে চেনা মুখ গুলো ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। কত স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা, শ্রদ্ধা, মুগ্ধতায় ভরা সেই সব মুখ। চেনা-অচেনা, দূরের-কাছের কত না মুখের সারি। কিন্তু সেসব ছাপিয়ে ফুটে ওঠে মণ্ডপের প্রতিমার মুখ। মনে হয়, জীবনের সব ব্যর্থতা, সব আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে যেন দাঁড়াতে পারি ওই মূর্তির কাছে, চোখের জলে নিবেদন করতে পারি জীবনের সব অক্ষমতা, হয়ত মিলতে পারে অনন্ত ক্ষমা। হয়ত তৃপ্ত হতে পারে জীবনের সর্বপ্রেমতৃষা।
এখন তাই পুজো এলেই মণ্ডপে মণ্ডপে খুঁজে ফিরি সেই মুখ। পড়তে চাই প্রতিমার চোখের ভাষা। বুঝতে চাই রহস্যঘেরা আঁখির তারায় আছে কিনা কোনও সান্ত্বনার ইশারা। প়ডতে চেষ্টা করি স্মিত ওষ্ঠাধরের ভাষা। সেখানে কি আছে কোনও ক্ষমার আশ্বাস? পুজো থেকে পুজোয়, মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে, পথ থেকে পথপ্রান্তরে, শহর থেকে মফস্বলে, ঝলমলে আলোর নীচে স্তব্ধবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি প্রতিমার মুখপানে চেয়ে। রহস্যের অবগুণ্ঠন ঘোচে না। চারপাশে সুবেশা নারীদের ভিড়। সেদিকে তাকালে বিভ্রান্তি আরও বাড়ে। জীবন্ত নারীর চোখের ভাষাও কেমন যেন দুর্বোধ্য। জীবন কোনও ইশারা দেয় না। প্রতিমার মুখেও মেলে না কোনও সঙ্কেত। পথ হারা ক্ষ্যাপা তবু খুঁজে ফেরে পরশপাথর।