আতঙ্কের নাম যখন ঘুড়ি
ঝুমুর দাস
একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শুরু করি। আমাদের বাড়িটা মফস্বল এলাকায়। বাড়ির পিছনে বিশাল বিশাল আম, কাঁঠালের বাগান রয়েছে। রোজ কত কত পাখি সেই বাগানে আসে। পায়রা, বক, কোকিল, মাছরাঙ্গা, টুনটুনি, চড়ুই, ফিঙে, বুলবুলি, শালিক, আরও কত নাম না জানা পাখি। গাড়ির একটানা কর্কশ হর্নের আওয়াজের বাইরে পাখির মিষ্টি ডাক মন ভালো করে দেয়। সময় অসময়ে সেই সবুজে ভরা বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকলে আর তার সঙ্গে মেশানো বিভিন্ন পাখির মধুর ডাক কল্পনার জগতে নিয়ে যায়।
রোজ ঘুম থেকে উঠে সেই বাগানে পাখিদের আপনমনে খেলা দেখা আমার মায়ের অভ্যাস। আমার মা একটু প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। গাছগাছালি পছন্দ করেন। নিজে হাতে বাড়ির ছাদে টবে বিভিন্ন ফুল ফলের গাছ করতে ভালোবাসেন। তাঁর কাছেই শোনা, সকালে ওই বাগানে নাকি প্রচুর সাদা বক আসে। তারা সারাদিন বাগানে ঘুড়ে বেড়ায়। তারপর সন্ধে হওয়ার আগেই উড়ে চলে যায়। রোজ মায়ের কাছে বকেদের কত গল্পই শুনি। একদিন ভোরবেলা অফিস বেরোচ্ছি। কাকাকে দেখলাম কাঁচি হাতে কোথায় যাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করতে বলল, পাশের বাগানে ঘুড়ির সুতোয় একটা বক আটকে গিয়েছে। উড়তে পারছে না। ছটফট করছে। শেষ পর্যন্ত কী হল তখন আর জানার সময় ছিল না। বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু সারাদিন একটা উদ্বেগ থেকেই গেল বকটার জন্য। বাড়ি ফিরেই মাকে জিজ্ঞাসা করলাম। মা বলল, কাকা সুতো কেটে দিতে বকটা উড়ে যায়। পরে কাকার কাছে বিস্তারিতভাবে জানলাম। শুনলাম, ঘুড়ির সুতো বকটার একটা ডানায় এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল যে ডানা কেটে রক্ত পড়ছিল। কোনওক্রমে ডানা থেকে সেই সুতো কেটে দেয় কাকা। কিন্তু এতটাই আহত হয়েছিল বকটা যে উড়তে পর্যন্ত পারছিল না। হেঁটে হেঁটে একটা ঝোপের মধ্যে গিয়ে বসেছিল। পরে ধাতস্থ হতে উড়ে চলে গিয়েছিল।
কথাপ্রসঙ্গে কাকার কাছে এরকম আরও গল্প শুনলাম। একটা পায়রা একদিন এমনভাবে দোকানের শাটারে ঘুড়ির সুতোয় আটকে গিয়েছিল যে তার সারা শরীরে সুতো এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল। একটি স্বহৃদয় ছেলে পায়রাটাকে নামিয়ে আস্তে আস্তে গা থেকে সুতো বের করে। ঘটনাটা শুনতে শুনতে গা শিউড়ে উঠেছিল।
কয়েকদিন আগেই বিশ্বকর্মা পুজো গেল। আকাশ পরিস্কার থাকলেই সেই সময়টা আকাশ লাল, নীল, সবুজ নিভিন্ন রঙের ঘুড়িতে ছেয়ে যায়। বিশেষ করে মকর সংক্রান্তি থেকে দুর্গাপুজোর পর পর্যন্ত। চারিদিকে তখন ছেলেদের হইহইয়ের একটা আওয়াজ। যে যখন পারছে ঘুড়ি, লাটাই হাতে টুক করে বাড়ির ছাদে কিংবা আদ্দেক তৈরি কোনও বাড়ির ছাদে উঠে ভোকাট্টা ভোকাট্টা বলে চেচাচ্ছে। উত্সবের আমেজ আর কী। এদের দেখেই তখন মনে হয় এই বুঝি পুজো এসে গেল। তবে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে বিপদের খবরও কম পাওয়া যায় না। কত ছেলে নেড়া ছাদ থেকে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটায় আবার কত ছেলের প্রাণও চলে যায়। তবে এই ঘুড়ি ওড়ানোকে কেন্দ্র করে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা আমাদের চোখেই পড়ে না, কিংবা পড়লেও সেটাকে আমরা গুরুত্ব দিই না। তেমনই একটা ঘটনা হল ঘুড়ির সুতোয় পাখি আহত এবং মৃত্যু।
ঘুড়ি ওড়ানোটা আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয় একটা খেলা। কচিকাঁচা থেকে বড়, সব বয়সের মানুষ ঘুড়ি ওড়ানোয় খুব মজা করে। ঘুড়ি ওড়ানোর আগে তার কতরকম প্রস্তুতি। কীভাবে মাঞ্জা দিলে তার ঘুড়িই সবথেকে শক্তিশালী হবে, অন্যের ঘুড়িকে অনায়াসেই ভোকাট্টা করা যাবে, তার নানারকম পরিকল্পনা। সেই মতো চলে বেশ কিছুদিন ধরে মাঞ্জা দেওয়ার কাজ। কাঁচ গুঁড়ো করে, ভাতের মাড়, বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে চলে মাঞ্জা দেওয়া। তারপর তা শুকনো করা। সুতোর মাঞ্জা এতটাই কড়া হওয়া দরকার, যাতে প্রতিপক্ষের ঘুড়ি কাছে এলেই তা মাখনের মতো কেটে যেতে পারে। এরপর সেই কড়কড়ে মাঞ্জা দেওয়া সুতো নিয়ে ঘুড়ির লড়াইয়ে নেমে পড়া। কিন্তু এসবের মাঝে একবারও মাথায় আসে না, আকাশে ওড়া প্রাণিগুলোর কথা। যাদের বিচরণ ক্ষেত্রটাই আকাশ। আমরা যেমন রাস্তায় ঘুড়ে বেড়াই, ওরাও তেমনই আকাশে বাঁচে।
ঘুড়ি ওড়ানোর সময়ে আমাদের চোখ তখন থাকে কীভাবে প্রতিপক্ষের ঘুড়ি কাটা যাবে সেদিকে। আর ঘুড়ি কাটা গেলে তো কোনও কথাই নেই। উল্লাস, ফূর্তিতে চারিদিকে তখন কত উচ্ছ্বাস। কিন্তু আমরা একবারও ভেবে দেখি না, আমাদের সেই আনন্দের ফলে কত নিরপরাধ প্রাণ আহত হচ্ছে। ঘুড়ির সুতোয় জড়িয়ে আহত এবং মৃত পাখিদের সংখ্যাটা জানলে চোখ কপালে উঠবে। ভাবতেও পারবেন না, রোজ কত কত পাখি আহত হচ্ছে। দেখা গিয়েছে, গত বছর শুধুমাত্র আহমেদাবাদে ২ হাজার ৩৯৪টি পাখি আহত হয়েছে ঘুড়ির সুতোয়। ৪৯০টিরও বেশি পাখি মারা গিয়েছে গুজরাটে। ঘুড়ির 'কড়া' মাঞ্জা দেওয়া সুতো তাদের নরম শরীর ভেদ করে মাংসের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। কারও ডানা কাটা গিয়েছে, তো কারও লেজ। কারও কারও আবার গলা থেকেও বাদ পড়েছে। কিছু পাখি সৌভাগ্যক্রমে কারও বাড়ির ছাদে কিংবা মাটিতে নেমে আসলে বা কোনও স্বহৃদয় ব্যক্তির নজরে পড়লে বেঁচে যায়। আর বেশিরভাগেরই প্রাণ যায় ওই অবস্থায় গাছের ডালে আটকে থেকে। এক পশুচিকিত্সকের কথায়, ঘুড়ির উত্সবের সময়ে প্রত্যেকদিন প্রায় ২৫০-র ও বেশি পাখি আহত হয়। তাদের মধ্যে কিছু মারাও যায়। তাহলে সংখ্যাটা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন? যদি ২৫০-র বেশি পাখি রোজ আহত হয়, তাহলে সারা বছরে কত পাখি আহত হচ্ছে? তাদের মধ্যে আবার কত পাখি চোখের আড়ালে, গাছের ডালে প্রাণ হারাচ্ছে?
সবশেষে কয়েকটা কথা বলার। এবার থেকে ঘুড়ি ওড়ানোর সময়ে, আনন্দে মেতে ওঠার সময়ে একবার ওই সমস্ত নিরপরাধ প্রাণিগুলোর কথা ভেবে দেখবেন। যারা কোনও অন্যায় ছাড়াই রোজ আমাদের আনন্দের শিকার হচ্ছে। প্রাণ বলিদান দিচ্ছে। আনন্দ নিশ্চয়ই করুন। কিন্তু এমন আনন্দ কি সত্যিই আনন্দের, যা অন্য কারও প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া যায়? রাস্তায় একটা দুর্ঘটনা দেখলে যেমন সেই রাস্তা দিয়ে যেতে তারপর বেশ কয়েকদিন আমাদের ভয় ভয় করে, আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে, তেমনই ওদেরও সতীর্থকে ঘুড়ির সুতোয় জড়িয়ে প্রাণ হারাতে দেখলে, ওদেরও মনে আতঙ্ক তৈরি হয়। আর হ্যাঁ, আমার পাশের বাগানে বকটার ওরকম করুণ পরিণতি দেখে বাকি বকগুলো আর ওখানে ঘুরতে আসেনি। সেদিনের পর ওখানে আর কোনও বককে দেখা যায়নি।