কবীর কথা

Updated By: Sep 30, 2016, 05:12 PM IST
কবীর কথা

 

তিনি কবীর সুমন, যাঁর স্বীকারোক্তি, “নতুন বাংলা গানের সঙ্গে শুই” এবং কামনা ‘একদিন যেন বাংলা গানেই মরি’। প্রাক্তন সাংসদ সেই সুমন যাঁর ‘স্বপ্নে এখনও যৌথ খামার’। নিজেকে “আমি রাজনীতির লোক নই, কিন্তু রাজনৈতিক লোক” বলা সেই মানুষটা মন খুললেন ফোনের ওপাড়ে, আলাপচারিতা প্রিয়জন বিয়োগের ব্যথা ছুঁয়ে বাঁক নিল শারদ থেকে সারদায়, উৎসব থেকে আন্দোলনে, সিঙ্গুর থেকে বাঙ্গুরে, মদন মিত্র থেকে মিত্র মদনে, বাদ গেল না জাতীয় রাজনীতিও এবং অবশ্যই জবাব ও আমন্ত্রণ পেলেন নচিকেতা চক্রবর্তী ও শিরদাঁড়া নিয়ে কবিতা লেখা কবি। ফোনের এপাড়ে কান খাঁড়া করে শুনল নির্ণয় ভট্টাচার্য্য

২৪ ঘন্টা ডট কম- সুমন দা, আপনার দীর্ঘ দিনের সুহৃদ শহীদ কাদরী এবং আপনার অভিভাবকসমা মহাশ্বেতা দেবী দু’জনেই খুব অল্প দিনের ব্যবধানে চলে গেলেন। নিকট মানুষদের হারিয়ে কতটা শূন্যতা বোধ করছেন?
কবীর সুমন-
দেখুন, আমার প্রিয় ইতালিয়ান লেখক ইটালো কালভিনোর "ইনভিসিবল সিটিস" উপন্যাসে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে লেখা) পড়েছিলাম- একসময়ে মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখন তিনি উপলব্ধি করেন - ওই যাঃ, তাঁর চেনা পৃথিবীটা আর নেই, তার চেনা মানুষগুলোও তো আর নেই। সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্ভবত তাঁর "জল সইতে" কাব্যগ্রন্থে একটি কবিতায় লিখেছিলেন, "চেনা মুখের মানুষগুলো কই গো?" -চেনা মুখের মানুষগুলো আর থাকে না এবং এটা জীবনের একটা ধ্রুব জায়গা। যেমন, আমার এই প্রবীন বয়সে রাত্রে আর ঘুম হয় না, শুধু ঝিমুনি আসে, কিন্তু তা ঘুম নয়- সেইটা যেমন ধ্রুব, তেমন এটাও ধ্রুব।

২৪ ঘন্টা ডট কম- এ'বছর তো একটি পুজো কমিটির জন্য গান তৈরি করলেন। এই অভিজ্ঞতাটা কেমন?
কবীর সুমন-
আজ্ঞে, কোনও পুজো কমিটি কিন্তু আমায় কাজ দেয়নি, কাজ দিয়েছেন শিল্পী ভবতোষ সুতার ও তাঁর স্ত্রী শিল্পী মল্লিকা দাস সুতার। ভবতোষ ও মল্লিকার মতো এত বড় মাপের শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার এর আগে কখনও হয়নি । ফলে, এটা আমার কাছে বড় পাওনা। এই দম্পতি প্রকৃত শিল্পী, ফাঁকতালে নাম করে যাওয়া কেউ নন। তাছাড়া, পৃথিবীর বয়সে এঁরা আমার চেয়ে নবীন, তাই এঁদের সঙ্গে একসাথে কাজ করার চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেললাম।

রেকর্ডিং করছেন কবীর সুমন, পাশে শিল্পী ভবতোষ সুতার।

 

২৪ ঘন্টা ডট কম- এই ধারার কাজ তো এই প্রথম আপনার, কেমন অভিজ্ঞতা হল?
কবীর সুমন-
চমৎকার। উনি (ভবতোষ সুতার) তো স্থাপনাগুলো (ইন্সটলেশন) করেছেন। ওঁর মূল ভাবনাটা হল- 'বাঁক'। তাই, বাঁকের বিষয়ে আমি ওঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ওঁর ভাবনার কথা জানতে চেয়েছিলাম। তাতে উনি প্রথমে বললেন, দাদা আপনাকে আমি কী করে বলব? তারপর যা বললেন অর্থাৎ বিচ্ছিন্নভাবে ওনার ভাবনার কথা শুনে যা বুঝলাম তাতে আমাদের উভয়ের মাথাতেই বাঁকের ব্যাপারে প্রায় একই রকমের বিষয়গুলো ঘোরাফেরা করছে। তারপরেই গান তৈরি শুরু হল। আমি তো বরাবরই আগে লিরিকটা লিখে নিই, এক্ষেত্রেও তাই করলাম। লিখে ওনাকে পাঠিয়ে দিলাম। ওনার ভালো লাগল। তারপর সুর দিলাম ও যন্ত্র যোগ করলাম। রেকর্ড করা হল, ওঁরও ভাল লাগল, আমারও বেশ ভালো লাগল। পুজো কমিটির যিনি এসেছিলেন, দেখে তো মনে হল তাঁরও ভালোই লেগেছে।

২৪ ঘন্টা ডট কম- এটাকে কি ‘থিম সং’ বলবেন?
কবীর সুমন-
এটা না আসলে একটা গান। থিমটা হল বাঁক। হ্যাঁ, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে হয়ত এটাকে থিম সং বলা চলে। কিন্তু, এটা একটা সম্পূর্ণ গান  আসলে। আমি যখন কোনও কাজ করি তখন সেটা শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না। যেমন ভবতোষের যে থিমটা (মানে, বাঁক) তা তো কেবল ঠাকুরপুকুরের একটি বিশেষ জায়গায় যে ইন্সটলেশনগুলো উনি তৈরি করবেন তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাঁক তো একটা ইতিহাসেরও অঙ্গ। সেই কোন কাল থেকে চলেছে।  পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার দু’-একজনের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল, তাঁরা আমাকে বছর কুড়ি আগে জানান,  তখনও সেদেশে বাঁক ছিল। তেমনই আরও অনেক দেশে, যেমন আমরা যেটাকে মধ্যপ্রাচ্য বলি, সেখানেও বাঁক আছে। আচ্ছা, ইউরোপের গ্রামেও কিন্তু আমি বাঁক দেখেছি অনেককাল আগে। সে সাতের দশকের কথা। আমেরিকাতেও বাঁক দেখেছি। ফলে, বাঁকের ধারনাটা দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে।
আমাদের এখানে যেমন দাড়িপাল্লার দু’দিকে চুবড়ির মত দুটি জিনিস বসানো থাকে। মার্কিন দেশে হয়ত একটা অন্য মেটেরিয়াল। কিন্তু এক প্রিন্সিপ্যল, অর্থাৎ ধারণাটা একই রকম।  ধারণাটা আসলে একহতে বাধ্য। ফলে যে গানটা আমি তৈরি করেছি ভবতোষের এবং মল্লিকার অনুপ্রেরণায়,  সেটা একটা সারা পৃথিবীর গান হয়ে গিয়েছে। সারা পৃথিবীর শ্রমিকের গান হয়ে উঠেছে। "কাঁধে বাঁক ব্যাঁকার উপায় নেই/ দুটি পা চলছে তো চলছেই"।

২৪ ঘন্টা ডট কম-আপনার কাছে সামগ্রিকভবে পুজোটা ঠিক কেমন?
কবীর সুমন-
চমৎকার জিনিস। আমার কাছে যেকোনো ধর্মীয় উৎসবই খুব আনন্দের, শুধু বলি জিনিসটাকে বাদ দিয়ে, তাও সেটাও আজকাল মেনে নিয়েছি। আমার বরাবরই উৎসব হলে ভালো লাগে। কারণ, উৎসব তো ছোট ছেলেমেয়েদের বেশি করে। ওদের তো কিছু নেই, সব বিনোদন আমাদের এই বুড়ো দামড়াদের। আচ্ছা, একটা গ্রামের মানুষের বিনোদন কী রকম বলুন তো? আগে তাঁদের যে গ্রামীন শিল্পগুলো ছিল সেগুলো তো এখন সব অস্তমিত। আমরা শহরই গ্রাস করে ফেলেছি। এখানেই চলে আসছে পুজো।  ফলে একদম প্রত্যন্ত গ্রামের দুর্গোৎসবে আমি একটা অতুলনীয় ব্যাপার দেখেছি। ওই যে ম্যারাপের তলায় সেই দূর দূর থেকে মানুষ আসছেন, ঢাকিরাও বেরিয়ে পড়েছেন, সব মিলিয়ে একটা সাজো সাজো রব, আনন্দের আবহ। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছেন ঢাকিরা, অন্তত চার পাঁচ মাস ধরে তাঁরা বাড়ির বাইরেই কাটাচ্ছেন। সবটাই তো এই পুজো অর্থাৎ একটা ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করেই হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে যদিও আমার কাছে ধর্ম মানে কাজ। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যদি দেখি, আচার অনুষ্ঠানের সুযোগে মানুষ মানুষকে আলিঙ্গন করছে। কোথাও হয়ত, বাড়ির দিদা বা ঠাকুমা একটা নতুন কাপড় বা থান পেলেন, তিনি আবার আশীর্বাদ করে বলছেন, এর আবার কী দরকার ছিল বাবা। সবাই তো আর বড়লোক না। এইসব মুহূর্তে আনন্দে চোখে জল চলে আসে। এ জিনিস আমিও দেখেছি, আপনিও দেখেছেন। তেমনই ঈদই বলুন বা বড়দিন অথবা বিজয়া সবেতেই উৎসবের মূল সুরটা কিন্তু একই। বয়স্কদের পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করা, তেমনই তাঁরা আবার বুকে টেনে নিচ্ছেন নবীন নবীনাদের। আমার তো মনে হয় ভারী সুন্দর জিনিস। তাছাড়া, কত মানুষের জীবিকাও নির্ভর করছে এর উপরে।

২৪ ঘন্টা ডট কম- সেই ছোটবলা থেকে কবীর সুমনের নিজের পুজোটা ঠিক কেমন?

কবীর সুমন- হ্যাঁ, এই সব জীবিকা টিবিকা ছাড়ুন, আপনাকে বলি ছোট বেলা থেকে পুজো আসি আসি করলেই আমার আনন্দ হয়, সোজা কথা। শরৎকাল আমার প্রিয় ঋতু। আমি জানিনা এবং বুঝিও না বসন্ত নিয়ে কবিদের এত মাতামাতি কিসের। আমার কাছে ছেলেবেলা থেকে এই বর্ষার মেঘগুলো যেগুলোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চাইছিলাম ওগুলো আসতে আসতে সাফ হচ্ছে, বুক ফাটিয়ে নীল আকাশ দেখা দিচ্ছে। জয় গুরু, হে ভগবান, এর থেকে সুন্দর জিনিস আর কী হতে পারে!  ধীরে ধীরে শরৎ-এর গন্ধ পাল্টাচ্ছে। এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, দেখতে পাচ্ছি ঘরের পুরানো পর্দাটা একটু কেঁপে কেঁপে উঠছে,  অর্থাৎ আশ্বিনের হাওয়ায় পুজো আসি আসি করছে। এই শিয়াল-কুকুরের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বৃষ্টিও পড়ছে রোদ্দুরও উঠছে। এরপর আমার ঝামেলাটা শুরু হয় মহালয়ায়। মহালয়া মানেই কিন্তু পুজো হয়ে যাওয়া। ফলে ওই যে রেডিওতে ভেসে আসছে ‘’রুপং দেহি, জয়ংদেহী...’’ আমি ভাবছি, যাঃ আমার পুজো তো শেষ হয়ে গেল। মনটা খারাপ হয়ে যায়। আবার যখন দেখি পাড়ায় পাড়ায় পুজো মণ্ডপে একটা প্রদীপ জ্বলছে, ডাক ছেড়ে ভাই কাঁদতে ইচ্ছে করে, সোজা কথা। আজও এক অনুভূতি, একটুও কমেনি।

২৪ ঘন্টা ডট কম- নিজেই আজকাল নিজেকে বুড়ো বলেন। কেমন লাগে নিজেকে বুড়ো ভাবতে?  
কবীর সুমন- আরে বুড়ো হয়েছি তো। আমার তো খারাপ লাগে না। বুড়ো হয়ে পৃথিবীটাকে অন্যভাবে দেখছি যে। আমার যেমন অনেক শারিরীক বৈকল্য দেখা দিচ্ছে, জ্বরা দেখা দিচ্ছে, তেমনি কত পুরনো ভুলের কথা ভেবে হাসি পাচ্ছে। স্বামী বিবেকানন্দ একবার বলেছিলেন, ম্যাচিওরিটির একটা লক্ষণ হল অতীতের ভুলের কথা ভেবে হেঁসে ফেলা। সত্যিই হাসি পায়। সারাক্ষণ হয় হাসি পায়, নয় তো ঘুম পায়।
কিছুদিন আগেও যেমন মনে হত, হৈ চৈ হোঃ হোঃ কত কি হচ্ছে, যাই গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কেউ হয়ত এক জায়গায় স্লোগান দিচ্ছেন, ভাবতাম যাই নেমে পড়ি-এমন একটা ব্যাপার ছিল। সব সময় একটা বিজড়িত গদগদ ভাব ছিল আমার মধ্যে। কিন্তু, আজকে বিশ্বাস কর, (এতক্ষণে সাংবাদিক ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ হতে পেরে নিজে স্বস্তি পেয়েছে) এই সেদিন যখন সিঙ্গুরে গেলাম, দেখলাম দূর দূর থেকে লোকজন আসছেন, পুরানো লোকজন সব ‘’দাদা ভাল আছ’’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরছেন, সেটা যেমন ভাল লাগছে তেমনই বুঝতে পারছি কোথাও যেন একটা দূরত্বও এসে যাচ্ছে। তাঁদের আনন্দ, তাঁরা অধিকার ফিরে পেয়েছেন, সত্যিই আমিও তাতে ভীষণ আনন্দিত। কিন্তু সেই একই সঙ্গে আমার মনে হচ্ছে, সময় হয়ে এল, আস্তে আস্তে এবার নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া দরকার। এঁরা নিশ্চই নিজের দায়িত্ব বুঝে নেবেন। আমার মতো লোকদের এবার কাজ হল মূল কাজটাতে থাকা অর্থাৎ সুরে থাকা। তার মানে, এই প্রবীনত্বটা না এলে আমি এই ডিস্টেন্সটাও তৈরি করতে পারতাম না। নিজেকে সরিয়ে নিতে পারতাম না, এই সরিয়ে নিতে পারাটা খুব জরুরী।

২৪ ঘন্টা ডট কম- পুজোর প্রেম আপনার চোখে কী ভাবে ধরা পড়েছে?
কবীর সুমন-
পুজোতে আবার আলাদা করে প্রেম কিসের! ও আমি সবসময় প্রেমময়। তার জন্য পুজো ফুজো লাগে না। আরেকটা কথা হচ্ছে, সরস্বতী পুজোটা বরং প্রেমের। ধরুন আমি পড়তাম সার্দান অ্যাভিনিউয়ের একটা স্কুলে এবার কমলা গার্লস স্কুলে গেলাম ঠাকুর দেখতে, সেখানে চাহুনি বিনিময়, টুকটাক কথা বলা, এটা কিন্তু সরস্বতী পুজোর নিজস্বতা। বন্ধু, এটা কিন্তু দুর্গা পুজোর কেস নয়। কাজেই আমার প্রেম, প্রেমই যদি বলেন, সেই প্রেমময়তা ‘ওই সুরের আগুন লাগল নীল দিগন্তে’। এই যে বসন্তে সৌরভ, একটু আগেও বলছিলাম বসন্তটা হোপলেস, এখন দেখছি না। তার কারণ রবীন্দ্রনাথ আছেন। ওই যে আপনি একটা জায়গায় গিয়ে অনুভব করছেন, ‘এল আমার হারিয়ে যাওয়া কোন ফাগুনের পাগল হাওয়া’, এখানেই প্রেম। আমার কথা ধরুন না, আমি এখন যে নবীনাদের দেখছি, অর্থাৎ তাদের হাস্যজ্বল মুখ, আবার তাদের মান অভিমানে চোখের কোণে একটু জলের ফোঁটা এটা আমায় নতুন করে আবার জাগিয়ে দিচ্ছে। এটা আলাদা করে কিন্তু হচ্ছে না। অর্থাৎ, আই অ্যাম কনস্ট্যান্টলি ইন লাভ।

২৪ ঘন্টা ডট কম- আজকের প্রজন্মের প্রেম কী কোথাও আপনার সময়ের চেয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে?
কবীর সুমন-
দ্যাখ, ছেলেমেয়েদের মধ্যে ইদানিং রোমান্সটা কম দেখছি। আমার ছেলেমেয়েরা আমায় বুড়ো বলে ডাকে, আমার এই ডাকটা খুব ভাল লাগে। তারা আমায় বলছে, বুড়ো তুমি যে ভাবে ‘প্রেম’ কথাটা বল, আমরা আর বলিনা কেন গো? লোকে বলবে বুড়ো নিজস্বতা দেখাতে চাইছে। কিন্তু না, ‘’আমি তোমায় ভালবাসি’’, ‘’তোমার জন্য মরে যেতে ইচ্ছা করে’’, ‘’আমার মনে হয় তোমার জন্য দৌড়ে সাঁতরাগাছি চলে যাই’’-এই ধরনের পাগলামোটার জায়গায়, ‘’তোর জন্য আমার মনে চাপ হচ্ছে’’, যাই বলুন ভাই এটা হচ্ছে না। মাননীয় বুদ্ধদেব গুহর মতো মানুষ তো এই পৃথিবীতে আর বেশি নেই, তিনি একবার আমায় বলেছিলেন, কবীর এই তুই তোকারির অবসান হতে হবে। জানি না বুদ্ধদার এখন কি মত, তবে সেদিন তিনি বলেছিলেন, বাংলার প্রেমকে যদি বাঁচাতে হয়,  তুই তোকারির অবসান ঘটাতেই হবে।

২৪ ঘন্টা ডট কম- মোকবুল মিঁয়া কেমন আছেন? অনেকদিন হল তিনি চুপ মেরে রয়েছেন। কারণটা কী?
কবীর সুমন-
মোকবুল এখন চেপে আছে। আমি বরাবর স্ট্রেট ব্যাটে খেলার পাত্র, কিন্তু আমি দেখছি লোকে না, বড্ড রেগে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি। মোকবুলের ওপর খেপে যাচ্ছে লোকে। মানে কোথাও যেন কেউ কিছু ভুল করছেন না, এরকম একটা ভাব। সবাই সব ঠিক করছেন। বিশেষত, নেতারা এবং কর্তারা। ‘’হ য ব র ল’’-এর শেষ দিকে রয়েছে, বড় হলে সবাই কেমন হোঁত্কা হয়ে যায়, এই কর্তাদের  হয়েছে সেই দশা, সবাই হোঁত্কা হয়ে যাচ্ছে।

২৪ ঘন্টা ডট কম- কিন্তু, তা বলে কি মোকবুল তাঁদের ভয় পাচ্ছেন?

কবীর সুমন- না, মোকবুল দেখছে হিতে বিপরীত হচ্ছে। মানে লোকে ভুল বুঝছে সমানে। সে দিনগুলো আর নেই। সেই জন্য মোকবুল লাইন পাল্টেছে। মানে, ব্যাপারটা হচ্ছে আমি খুব সিরিয়াসলি ভাবছি ছবি করব। খুব সিরিয়াসলি ভাবছি। একটা অ্যাবসার্ড ছবি। সেই ছবিটার বিষয় হবে আমার জীবন, দেশের জীবন এবং সমাজ, আর তাতে কিছু অ্যাবসার্ডিটি। একটা মূহুর্তের পাগলামির ছবি বানাতে চাইছি। বাংলা কিন্তু বজরঙ্গি ভাইজানের মতো একটা ছবিও তৈরি করতে পারেনি। পারেনি লাঞ্চবক্সের মতো একটা ছবি বানাতেও।

২৪ ঘন্টা ডট কম- সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে?  চিন্তা ভাবনার?

কবীর সুমন- সমস্যাটা হচ্ছে চিন্তাভাবনা এবং কোনও সেলফ ক্রিটিক্যাল জায়গা না থাকার জন্য। আমরা খুব কম সৎ। দেখবেন, কি সহজে আমরা ‘আপোস করা’র কথা বলি। এম.পি. থাকার সুবাদে ভারতের নানান প্রদেশের লোকজনদের সঙ্গে মিশেছি, আমি পাশ্চাত্যেও কাটিয়েছি, কোথাও কেউ ‘আপোস‘ কথাটা এভাবে বলেন না। পান থেকে চুন খসলেই বাঙালি বলে, আপনি আপোস করে নিলেন! আমাকে যে একথা কত শুনতে হয়, ‘’আপনি মমতার বিরুদ্ধে কিচ্ছু বলছেন না, আপনি আপোস করে নিলেন!’’ আমি বলি, ‘‘বলতে যাব কেন হে! তোমার বাবা করছে নাকি এই কাজগুলো? গ্রামে যে কাজগুলো করছে মেয়েটা, কন্যাশ্রী কি তোমার বাবা করেছে?‘‘  আর একটা জিনিস দেখবেন, লোকে না সর্বদা প্রতিবাদের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। তুই নিজে রাস্তায় নাম না। সব সময় আরেকজনকে বলতে হবে কেন! আমি তো অনেক করলাম। আর গান লিখে লিখে কীই বা হবে।  তুই রাস্তায় নাম না, দেখি তোর কতটা জোর! আমরাই দেখবেন সব থেকে বেশি ফালতু বিপ্লবী বিপ্লবী বাতেলা ঝাড়ি।

২৪ ঘন্টা ডট কম- তাহলে, ‘তোমাকে পথে আমি নামাবো’-এই প্রত্যয়ী উচ্চারণ এবং প্রতিবাদ-প্রতিরোধের গান দিয়ে শেষ অবধি কি কিছুই করা গেল না?

কবীর সুমন- বন্ধু, গান একটা মূহুর্ত। গান কি সত্যি সত্যিই সবকিছু মিন করে? গান একটি মূহুর্তের অভিব্যাক্তি, যেটি সেই মূহুর্তে ঠিক আছে। শিল্প কী করতে পারে? সে দিক থেকে কিছুই (‘কিছুই’ শব্দটি জোর দিয়ে উচ্চারণ করলেন) করতে পারে না। আর তাই যদি পারতো তাহলে এতো এতো ধর্ম প্রবর্তক এসেছেন পৃথিবীর বুকে, তাঁরা তো কত কথা বলেছেন, তা যদি সবাই শুনতো তাহলে এসব কিছুই হত না। তুমি হয়ত বলবে, বুড়ো তাহলে তুমি কি বুঝছো? আমি বলবো ভাই আমি আর কিছুই বুঝছি না। শুধু একটা কথা আমি বুঝেছি, জন্মেছি যখন একা, দুঃখ করে করে মরতে আমি রাজি নই। এ পৃথিবীটাকে আমি পাল্টাতে পারব না, এ দেশকেও আমি পাল্টাতে পারব না। তবু আমার মতো করে একটা চেষ্টা তো করে যাবই। সেখানেই গান, আমি বড় জোর একটা গান বাঁধতে পারি- "আমার দৌড় ওইটুকুনিই, গান লেখা আর সুর বোলানো"।

২৪ ঘন্টা ডট কম- ‘’আপনার শাল বল্লার বেড়ায় আগুন’’ ও আরও কিছু গান সেসময় সিঙ্গুরের ভূমি আন্দোলনে প্রতিবাদীদের প্রেরণা যুগিয়েছিল। আজ, সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক ভূমিহীনদের আইনি জয়ের পর যদি গান লেখেন তাহলে সে গানে কার কথা বেশি করে আসবে- প্রান্তিক কৃষক বর্গাদারদের কথা, নাকি দু’শো বছর পর যে মমতার নামে মন্দির তৈরি হবে তাঁর?
কবীর সুমন-
সত্যি কথা বলব?

২৪ ঘন্টা ডট কম- একবারেই, কবীরের সত্য উপলব্ধিটাই তো শুনতে চাই-

কবীর সুমন- গানের একটা লাইনও আর হাত থেকে বেরবে না।

২৪ ঘন্টা ডট কম- সে কি! কেন?

কবীর সুমন- কারণ, ওই দ্বন্দ্বটা, ওই জোরালো দ্বন্দ্বটা আর চোখের সামনে নেই। মানে আইনি জয়ের মাধ্যমে একটা জায়গায় পৌঁছে গেছেন সংগ্রামী কৃষকরা। আর যেই একটা ফয়সালা হয়ে যায়, ওমনি আমার গানও চুপসে যায়। আমি তো আর রবীন্দ্রনাথের মতো করে গান লিখি না। আমি কোথায় যেন একটা রেডিক্যাল লোকই রয়ে গেলাম। আমি কোথাও একটা কমিউনিস্ট বোধ হয়। বুঝতে পেরেছেন?  বলেই দিলাম।

প্রতিবাদে, প্রতিরোধে...

 

২৪ ঘন্টা ডট কম- তার মানে স্বীকার করছেন যে আপনি কমিউনিস্ট?

কবীর সুমন- বুঝুন, ওই বৈষম্য,  ওই লড়াইয়ের জায়গা থেকে বলছি কিন্তু কথাটা। আমি বিশ্বাস করি হয় এই পৃথিবীটা সবার, নয়তো কারও নয়। কিন্তু আমি কি করব, বন্দুক হাতে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যাওয়াটা কি আমার কাজ? তবে, এটা আমি এখনও মনে করি, সমাজতন্ত্র ছাড়া ভারতের আর কোনও গতি নেই।

২৪ ঘন্টা ডট কম- তাহলে, আজকের সময়টাকে কীভাবে দেখছেন?

কবীর সুমন- গুলিয়ে গেছে সব। আমি আর সব দেখে উঠতে পারছি না। যদি সব দেখতে যাই বন্ধু, তাহলে সুরে থাকতে পারছি না। আমায় যে সুরে থাকতেই হবে। আমার ধর্ম ওটাই। আমি বারবার বলছি, আবার বলছি, হ্যাঁ আমার মধ্যে কনট্রাডিক্সন নিশ্চই রয়েছে। একি! আমার মধ্যে যদি দ্বন্দ্ব না থাকত, তাহলে তো বনমানুষ হতাম। অবিমিশ্রতাই যদি শ্লাঘার বিষয় হয়, তাহলে তো বনমানুষের জীবনটাই শ্লাঘার বিষয়, ওখানে কোনও মিশ্রণ নেই। আমার মধ্যে ইনকনসিসটেন্সি আছে। আমি মানুষ বলেই ইনকনসিসটেন্ট। আমি যদি পাথর হতাম বা শালিক হতাম তাহলে ইনকনসিসটেন্ট হতাম না। কনসিসটেন্ট মানুষ জীবনেও সৃষ্টি করতে পারে না। যেমন, প্রেম কখনো সোবার হতে পারে না। প্রেমকে ছটফটে হতেই হবে, সব লন্ডভন্ড করে দেওয়ার মতো হতে হবে। প্রত্যেকটা চুম্বনে আমি হব রিজওয়ান। এই স্বপ্ন আমি এখনো দেখি যে এমন চুমু খাব যে রাস্তা তোলপাড় হবে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের যে স্বপ্ন, তা আমার মন থেকে কেউ মুছে দিতে পারবে না। সেটা আমার। এবার যদি বলা হয় কোন পার্টির হাত ধরে তা আসবে? না, সে আমি জানি না। সে পার্টি আমি দেখিনি। এটা সত্য যে আমার মাওবাদীদের প্রতি একটা সহনাভূতি ছিল, আজও আছে।

২৪ ঘন্টা ডট কম- তাই কি আজও আপনার ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার-ছত্রধর মাহাতোর মুক্তি চাই?

কবীর সুমন- হ্যাঁ, নিশ্চই। এবং ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি এটা অত্যন্ত সন্তর্পনে অথচ খোলামেলাভাবে রিস্ক নিয়েই বলেছি যে, আশা করি রাজ্যের সরকার রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির কথা ভেবেচিন্তে দেখবেন। মন থেকে আমি এটা চাই।

২৪ ঘন্টা ডট কম- এবারের একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে তো আপনি মিত্র মদনকেও খুব মিস করছিলেন। তাঁর দ্রুত মুক্তি  কামনা করেছিলেন। এখন তো তিনি মুক্ত (জামিনে), কেমন লাগছে?  কথা হয়েছে মিত্রের সঙ্গে?

কবীর সুমন- আমার খুব ভাল লাগছে। আসলে, যে পলিটিক্সের লাইনে ওঁরা কাজ করেন সে লাইনে কিছু প্রফেশনাল হ্যাজার্ডস রয়েছে। আমি জানি, মদনকে নিয়ে কথা বলায় সবাই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না (তাচ্ছিল্যের সুরে)।  দেখুন, আমি তো মদন বাবুকে চিনতাম না।  যখন গণ আন্দোলনে ঢুকলাম তখনই আলাপ। মেট্রো চ্যানেলে প্রতি শনিবারে নাগরিকদের মুক্ত মঞ্চ তৈরি করেছিলাম আমরা, সেখানে প্রসূন ছিলেন, অসীম গিরি ছিলেন, জয় গোস্বামীও আসতেন। তখন প্রত্যেকদিন আমাদের নামে মামলা হত, কারণ আমরা রাস্তার উপর একত্রিত হতাম। এই মামলার গোটা বিষয়টা কিন্তু সামলাতেন মদন। এইসব মোকদ্দমার আঁচ আমাদের কোনও দিন টেরও পেতে দেননি মদন। যিনি এভাবে রক্ষা করেছেন, তাঁকে বন্ধু ছাড়া আর কি বলব?
তেমনই একটি বেসরকারি চ্যানেলে যেখানে আমি একটি অনুষ্ঠান করতাম সেখানে একদিন সিপিএমের গুণ্ডারা আক্রমণ করল। অনির্বান সাধু, সায়নদেবদের মারধোর করা হল। সেদিন রাত্তিরে আমাদের প্রত্যেক স্টাফকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন মদন মিত্র। আমি তো সেটা ভুলব না। আমাকেই সর্বশেষ নামিয়েছিলেন, আমি যখন বাড়িতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছি, আমি বললাম, মদন এবার বাড়ি যাও। ও তখন বলছে, না, না, আগে তুমি ঢুকবে তারপর আমি যাব। এই মদনকে তো আমি ভুলতে পারি না। এভাবেই মদনের সঙ্গে বন্ধুতা। আমি মদনের পাশে আছি। আমার বন্ধু যদি সাতশো লোককে খুনও করে, তাহলেও সে আমার বন্ধুই থাকবে। মদন কি করেছেটা কি? আমার খুব ভাল করে জানা আছে অন্যান্য পলিটিশিয়ানরা সব কী কী করেন। কেউ কেউ তো আবার পনেরো লক্ষ টাকার চাকরিও করেছেন। তবে, জামিনের পর আমার সঙ্গে মদনের দেখা হয়নি এখনও। আমি যাব যাব করছিলাম, কিন্তু শুনলাম উনি নাকি এখন একটা হোটেলে থাকেন। তারপর ভাবলাম আমি দেখা করতে গেলে যদি আবার কেউ কিছু বলে ওকে আবার জেলে ঢুকিয়ে দেয় তাই আর যাইনি। কি দরকার রে বাবা!

২৪ ঘন্টা ডট কম- সিবিআই এখন মদন মিত্রের জামিন খারিজের জন্য উচ্চতর আদালতে যাচ্ছে। এবিষয়ে কী বলবেন?

কবীর সুমন- সিবিআই-এর এই পদক্ষেপ আমি একেবারেই সমর্থন করি না। আপনার যদি চার্জশিট করার থাকে আপনি করুন, ৯০ দিনের মধ্যে করুন, আপনি অনির্দিষ্টকালের জন্য কারওকে ধরে রাখতে পারেন না। অমিত শাহ কী করল? চার জনের খুনের সঙ্গে তো অমিত শাহ জড়িত।

২৪ ঘন্টা ডট কম- অমিত শাহকে তো ওই মামলায় মহামান্য আদালত দায়মুক্ত ঘোষণা করে দিয়েছে।

কবীর সুমন- হ্যাঁ! চমত্কার! দায়মুক্ত ঘোষণা করে দিল (অবাক হওয়ার অভিব্যক্তি)! আমাদের সেই ইশরাত জাহানকে খুন করছিল যে, সেও দায়মুক্ত হয়ে গেল (কণ্ঠে ক্রোধ ও হতাশা স্পষ্ট)! এবার কথা হল, সব্বাই ছাড়া পেয়ে যাবেন, একমাত্র দোষ করলেন মদন মিত্র। হাসি পায়। আরেকটা কথা, দেশে কনস্টিটিউশন রয়েছে, বিচার হোক। সেখানে যদি তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে নিশ্চই তাঁর শাস্তি হবে। কিন্তু আমাকে তো আপনি ৯০ দিনের বেশি আটকে রাখতে পারেন না ভাই।

২৪ ঘন্টা ডট কম- কিন্তু সেদিন যদি শাস্তি হয়, তাহলে কি বলবেন পোয়েটিক জাস্টিস হল?

কবীর সুমন- বলতে পারব না। আমি এটুকুই বলতে পারি, মদন যতদিন বেঁচে আছেন আমি মদনের পাশে আছি। যে মদন মিত্র আমার ছেলেমেয়েদের সিপিএমের জঘণ্য আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, আমি আবার যদি জন্মাই আবার তাঁকে প্রণাম করব এবং বন্ধুতা অটুট থাকবে।
 

২৪ ঘন্টা ডট কম- সুমন দা, এক্ষুণি সিপিএমের আক্রমণের কথা বলছিলেন। বাম আমলে একবার আপনি  লিখেছিলেন, ‘বামের পাশে বসলে সিদ্ধকাম/বামের ঘরে সেঁধিয়ে গেলেই হয়’। এই মুহূর্তে, দল পাল্টে তৃণমূলে ঢোকার এই হিড়িক দেখে কী মনে হয়, এঁরাও কী সব ‘সিদ্ধকাম’ হতেই আসছেন?

কবীর সুমন- (প্রশ্নটা শুনে খুশি হলেন) হ্যাঁ! একদম। দেখুন আমি জাজমেন্টাল লোক না। এক এক জন এক এক সময়ে এক এক রকম কথা বলেন। বেশ করেন, তারা আমার পয়সায় খান না। কিন্তু, যারা গণআন্দোলনের সময় একটা টু শব্দও করল না বরং বিরোধিতা করল, যারা সিপিএমের একদম পাত কুড়িয়ে খাওয়া, সেই সময়ে সিপিএম যা সব কাণ্ডকারখানা করেছে তার বিরুদ্ধে একটি কবিতা বা গান লেখেননি, তাঁরা হঠাৎ এসে গেলেন তৃণমূলে। চমত্কার! নিশ্চই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল তাঁদের সেই গুরুত্বটা বুঝছেন তাই নিচ্ছেন। আমার শুধু হাসি পায় এই আর কি।

২৪ ঘন্টা ডট কম- তার মানে নিখাদ সিদ্ধকাম হওয়ার বাসনা, তাই তো?

কবীর সুমন- হ্যাঁ, আবার কি! ও দুটি পয়সার জন্য, আর কিচ্ছু না। দেখুন তাতে কোনও অসুবিধে নেই। আমায় কেউ এমনি খাওয়ায় না। একটাই জীবন, যদি বেশি খেতে পেতাম তাহলে ভালই হত। আমি তো বেসিকালি একটা বামপন্থী লোক। তাই যদি হত, তাহলে সিপিএম আমলেই খেতে পারতাম। বিষয় হল- রুচিতে লাগে। তৃণমূল আমলেও আমি চেষ্টা করলে বানাতে পারতাম না! যারা বানানোর তাঁরা তো বানাচ্ছে। যারা বানানোর তারা যেকোনও আমলেই বানিয়ে নেন। আর যারা বানানোর নন, তারা বানান না। এটাই নিয়ম।

২৪ ঘন্টা ডট কম- বঙ্গীয় রাজনীতির নতুন ট্রেন্ড- বিরোধীদের হাতে থাকা পুরসভা-পঞ্চায়েত রাতারাতি তৃণমূলের হয়ে যাচ্ছে। কেমন লাগছে এই ম্যজিকটা?
কবীর সুমন-
আমার মনে হয় কি, এই যে জায়গাটা তৈরি হয়েছে এর মূলে কিন্তু বামফ্রন্টের ব্যর্থতা। দেখুন কমিউনিস্ট পার্টির কাজ হল মাস মবিলাইজ করা। সেইটা তো কমিউনিস্ট পার্টি করেনি। সিপিআইএমকে যদি কমিউনিস্ট পার্টি মনে করা হয়, যদিও আমি মনে করি না যে ওরা কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু তবু অনেক দিনের লোকেরা ওখানে আছেন। ওই দলে এমন অনেক লোক আছেন যাঁদের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে। আমার কিন্তু, বিনয় কোঙার বা বিমান বসুর সঙ্গে কোন ইগো নেই এবং ওঁদের অনেককে বেশ ভাল চোখেই দেখেছি। তবে লড়াই হয়েছে, কিন্তু লড়াইয়ের কেসটা আলাদা। সংসদে আমি কাদের সঙ্গে গপ্পো করতাম? নীলোত্পল, শমীক, সীতারাম ইয়েচুরি এঁদের সঙ্গেই আড্ডা হত।

২৪ ঘন্টা ডট কম- আপনার সিপিএমের বন্ধুদের কখনও বলেছিলেন যে, তাঁদের দল কমিউনিজম থেকে বিচ্যুত হচ্ছে?
কবীর সুমন-
না, বলিনি। কারণ, আমি জাজমেন্টাল না। ওঁরা আমার থেকে ভাল বুঝবেন। পার্লামেন্টের সিগারেটখোরদের ঘরে আমি আমার এক সিপিএমের বন্ধুকে বলেছিলাম, আপনারা এতো গণসংগঠন করেন, তাহলে আপনাদের এমন হাড়ির হাল হল কী করে?

২৪ ঘন্টা ডট কম- তিনি কি উত্তর দিলেন?

কবীর সুমন- তিনি আমায় বললেন, কবীর আমায় দু’দিন সময় দিন। দু’দিন বাদে বললেন, যেই না পঞ্চায়েত রাজটা হল, ওমনি হাজার হাজার কোটি টাকা গ্রামে ঢুকতে শুরু করল। ওই ২০০৯ সালে দাঁড়িয়ে  তিনি বলছেন, এই হাজার হাজার কোটি টাকা ঢোকার ফলে একটা স্থানীয় কুলাক শ্রেণীর উদ্ধব হল। এবার এই লোকাল কুলাক শ্রেণীর উপর পার্টির আর নিয়ন্ত্রণ রইল না।

২৪ ঘন্টা ডট কম- আর সেখানেই কি সর্বনাশের শুরু?
কবীর সুমন-
সাংঘাতিক কথা বলেছেন কিন্তু। এর ফলে, বাঘ রক্তের স্বাদ পেয়ে গেল। আমি বললাম, তাই যদি হয় দাদা, তাহলে পরের পর ভোটে সিপিএম জয় পেল কিভাবে। তখন তিনি বললেন, আপনি তো নিজেও ভোট করেছেন, জানেন তো ভোট কি করে হয়। আমাদেরও গ্রামে ভোট করাতে হলে এঁদের (ওই কুলাক শ্রেণী) দিয়েই করাতে হবে, উপায় নেই। এই যে জায়গাটা এটা কিন্তু ঐতিহাসিক জায়গা। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম না হলে কি এই এত বড়ো ওলোটপালোটটা আসত? আমার তো মনে হয় একেবারেই না।

২৪ ঘন্টা ডট কম- আপনার কথা থেকে সিপিএমের পতনের কারণটা তো বোঝা গেল। কিন্তু এই ‘সিদ্ধকামীদের’ জায়গা দিয়ে তৃণমূল কি ঠিক করছে?
কবীর সুমন-
আমার মনে হয়, তাঁরা ঠিকই করছেন। কারণ হচ্ছে, তাঁরা উপভোগ করছেন গোটা ব্যাপারটা। দেখুন আমি আপনাকে গালাগাল দিয়েছি, প্রচুর গালাগাল দিয়েছি দীর্ঘদিন ধরে। এবার একদিন, আমি চার পায়ে, মানে হামাগুড়ি দিয়ে আপনার সামনে এসে বললাম, আমায় দুটি দিন (কবীর সুমনের স্বকীয় স্টাইলে)। আপনি হাসবেন না? আপনার ভাল লাগবে না?  তৃণমূলের কাছে বিষয়টা অনেকটা- এ্যাই এ্যাই দেখো দ্যাখো কে এসেছে, আমাদের কুটুম এসেছে! "বলি ও ননদি আর দু’মুঠো চাল ফেলে দে হাঁড়িতে, ঠাকুর জামাই এল বাড়িতে।" আপনি হাসবেন না মনে মনে?

২৪ ঘন্টা ডট কম- কিন্তু সুমনদা আপনার গানেই তো পেয়েছি, "লোভের ইশারা রুখতে পেরেছি কয়েকবার/শত্রুর সাথে সন্ধি করিনি হাজারবার..." এক্ষেত্রে শত্রুর সঙ্গে সন্ধি তো হচ্ছে। কী বলবেন?
কবীর সুমন-
শত্রুর সাথে শুধু সন্ধি হচ্ছেই না, আরও হবে। এখানে কাজি নজরুলের ওই কবিতাটা বোধ হয় এসে পড়ে- "আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা/ করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা"। কিন্তু, আমাদের কাছে পুরো জিনিসটাই একটা হিসেব। দেখুন আরবি ভাষায় একটা কথা আছে, কবি যখন রাজার পাশে পাশে হাঁটতে আরম্ভ করেন তখন সে একটা রূপোর রেকাবিতে করে তাঁর জিভটা উপহার দিয়ে দেয় রাজাকে। এক্ষেত্রেও তাই।

২৪ ঘন্টা ডট কম- আপনার মুখে বারংবার ‘মণিপুরের বাঘিনী’ ইরম শর্মিলা চানুর কথা শোনা গেছে। তাঁর ঐতিহাসিক অনশন আন্দোলন থেকে সরে এসে বিয়ে করা ও ভোটে লড়ার সিদ্ধান্তকে কিভাবে দেখছেন?
কবীর সুমন-
আমি মনে করি তিনি এক জন সিরিয়াস মানুষ, আমি চুপ করে দেখতে চাই তিনি কি করছেন। একটা ওই স্তরের সংগ্রামী মানুষ, তিনি যা করছেন নিশ্চই বুঝে করছেন। আমার অনুমতি তাঁর প্রয়োজন নেই। আমার সমর্থনেরও প্রয়োজন নেই। তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করব। সবকিছুই পরিবর্তনশীল, যিনি নিজের থেকে পাল্টান তিনিই বেঁচে থাকেন। পাথরও পাল্টে যায়, মানুষ পাল্টাবে না! তিনি নতুন রাস্তা করছেন, নতুন অভিব্যাক্তি খুঁজছেন, এ অধিকার তো তাঁর আছে। আমি ক্রিটিসাইজ করার কে?

২৪ ঘন্টা ডট কম- পার্লামেন্টেরিয়ান কবীর সুমন আজ সংসদে থাকলে কাশ্মীর ইস্যুতে কী বলতেন?
কবীর সুমন-
মুশকিল হচ্ছে কি, পার্লামেন্টে তো আমি গিয়েছি, গিয়ে দেখেছি, যে দলের টিকিটে আমি এসেছি সেই দলের হুইপ যা বলছেন সেটাকে অতিক্রম করা সম্ভব না।

২৪ ঘন্টা ডট কম- কিন্তু তারপরেও তো আপনি আপনার নিজস্ব মতামত গলায় ঝুলিয়ে পার্লামেন্টের ফ্লোরে বসেছেন।
কবীর সুমন-
হ্যাঁ, সেখান থেকে আমাকে কেউ সরাতে পারবে না। মাননীয়া দলনেত্রী বলেছিলেন আমাকে আলোচনার সময় দেবেন, সেটা হয়ত তিনি নানান কারণে দিয়ে উঠতে পারেননি। দিলে বড় ভাল হত, আমি তো তাঁকে অপমান করতাম না। সংবিধান অনুসারে সকলেরই তো একটা অধিকার আছে,  লেট আস এগ্রি টু ডিসেগ্রি। আসলে সেই পলিটিক্সটাই তো আর নেই।
দেখুন, আমি একজন সাংসদ, ৭টি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে একটি লোকসভা কেন্দ্র। এত বড় একটা এলাকা অন্তত ১০ লক্ষ লোক তো রয়েছেই, তারমধ্যে নিদেনপক্ষে ৫ লক্ষ ভোটার। এবারে ধরুন, একটি বিল উথ্থাপিত হল, বিল প্রস্তাব সকাল বেলায় টেবিল্ড হল, এবার এর উপরে ভোটাভুটি হবে। ইয়েস ভোট, নো ভোট, এটা সিক্রেট ব্যালটেই হবে। এবার আমি ইয়েস অর নো বলে দিচ্ছি আমার হুইপ অনুযায়ী। কিন্তু আমার নির্বাচকরা কোন পক্ষে? আমার তো মনে হয় গণতন্ত্র থাকলে আগে এই বিলটা এমপির মাধ্যমে যাঁরা তাঁর ভোটার তাঁদের কাছে পাঠান উচিত এবং তাঁদের থেকে জানতে চাওয়া হবে ওই বিষয়ে তাঁদের কি মত। তা না হলে গণতন্ত্রের কোনও মানেই থাকে না।

২৪ ঘন্টা ডট কম- আপনি তো বলছেন অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের কথা, আমাদের দেশে তো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চালু আছে। এদেশে এটা তো অসম্ভব!
কবীর সুমন-
সেই জন্যই তো কিছু হচ্ছে না। আরও দশ লক্ষ লোকের হয়ে আমি বলে দিচ্ছি। তাও আমার হুইপ যা বলে দিচ্ছে তাই বলছি। এ গণতন্ত্রের কী মানে আছে আমি বুঝি না।

২৪ ঘন্টা ডট কম- আপনি তার মানে সংসদকে মিস করছেন না?
কবীর সুমন-
একদম না, সত্যি সত্যি করছি না। তবে একটা জায়গা ছাড়া। সেটা হল একজন সাংসদ যদি সত্যিই কিছু কাজ করতে চায়, সেক্ষেত্রে ভারত সরকার টাকা দেয়। এই ভারত সরকারের অনেক দোষ আছে, কিন্তু একটা দোষ নেই, ভারত সরকার কিপ্টে নয়। ভারত সরকারের টাকা রাখা আছে, যদি কেউ চায়, এমপি ল্যাডের টাকা দিয়ে সে বেশ কিছু কাজ করতে পারে। আমি এটা করানোর চেষ্টা করেছি এবং সফল হয়েছি।

২৪ ঘন্টা ডট কম- এমপি ল্যাডের টাকা নিয়ে তো আপনাকে প্রচুর বিতর্কের সম্মুখীনও হতে হয়েছে?
কবীর সুমন-
তাতে আমার কিছু যায় আসে না, আমার এখানে ঘুরলেই তো দেখা যাবে কে কি করেছে। আপনি বাঙুর হাসপাতালে যান, প্রতিটি ফ্লোরে খাবার জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওপরে নিওন্যেটাল বিভাগে যে ইনকিউবেটর আছে বা যে স্পেশাল অ্যাম্বুলেন্সটা রয়েছে সেটাও এই বান্দার, এই হাইফেন বান্দার জোগাড় করে দেওয়া টাকায়। এই টাকাটা জনগণের টাকা, সেটা জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়া গেছে, আমি হাইফেন ছিলাম মাত্র। এই ব্যবস্থাটা সত্যিই খুব ভাল।

২৪ ঘন্টা ডট কম- কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার কী মতামত?
কবীর সুমন-
কাশ্মীরের হাতে ব্যালটটা আগে দেওয়া হোক। কাশ্মীরে গণভোটটাই তো কখনও হয়নি। পাকিস্তান ভুলে যান না। কাশ্মীরের মানুষ তাঁদের আত্মনির্ধারণের অধিকারটা পাচ্ছেন না কেন? ভারত সরকার তো কথা দিয়েছিল। কি হল সেই কথার?

২৪ ঘন্টা ডট কম- কিন্তু কাশ্মীরে তো গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকার রয়েছে। সে সরকার তো ওখানকার মানুষরাই ভোট দিয়ে গড়েছেন। তাহলে কী বলবেন?
কবীর সুমন-
ও হো, ওটা তো আমি আপনি সকলেই যখন ইচ্ছা বলতে পারি। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার যে কোথায় কী ভাবে মেওয়া ফলায় তা তো আপনিও জানেন বন্ধু, আমিও জানি। আমার কথা হল গণভোটটা হল না কেন? আগে রেফারেন্ডাম, তারপর তাঁরা যদি ঠিক করেন যে চাঁদের অংশ হবেন, তাহলে তাই মেনে নিতে হবে।
আমি বহু বছর আগে, কাশ্মীরের ধসে আটকে পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, অধিকাংশ মানুষই কিন্তু ভারতকে বেশি পছন্দ করেন। আমার কাশ্মীরি বন্ধু আমাকে বলেছেন, তুমি দয়া করে তোমার সরকারকে বোঝাতে পারবে যে আমাদের নৈকট্যটা ভারতের সঙ্গেই, পাকিস্তানের সঙ্গে নয়। তাঁর কথায়, ধর্মই যদি হবে তাহলে ভারতেই তো বেশি সংখ্যক মুসলমান আছে। যাক, এখন গণভোটটাই চাই কিন্তু।

২৪ ঘন্টা ডট কম- আপনার অভিজ্ঞতা বলছে, কাশ্মীরিরা বেশিরভাগ ভারতেরই অনুরক্ত। তাহলে কেন্দ্রের বর্তমান সরাকরের জন্যই কি ওখানকার অবস্থা আরও ঘোরাল হয়ে যাচ্ছ বলে মনে করছেন?

কবীর সুমন- নিশ্চয় আরও জটিল হয়ে গেছে। কিন্তু এতদুর আসত না যদি অনেক আগেই ওখানকার মানুষদের প্রকৃত মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হত।

২৪ ঘন্টা ডট কম- তিন তালাক প্রথার অবসান চেয়ে আবারও সুপ্রিমকোর্টে আবেদন জমা পড়েছে। আপনি নিজেকে ধর্মে মুসলমান বলেন, তালাকের বিষয়ে আপনার কি মত?

কবীর সুমন- ধুর, এসব ফালতু ব্যাপার তুলে দেওয়া উচিত। এটা একটা আধুনিক পৃথিবী, এখানে আধুনিক আইনকানুন থাকবে।

২৪ ঘন্টা ডট কম- আপনি কি ইউনিফর্মড সিভিল কোডের পক্ষে?

কবীর সুমন- অ্যাবসিলিউটলি।

২৪ ঘন্টা ডট কম- বছর দেড়েক আগে, কলকাতার কলামন্দিরে আপনার অনুষ্ঠান শুরু হল নচিকেতার একটি গান দিয়ে। সেসময় অসুস্থ নচিকেতার দ্রুত আরোগ্য কামনা করে আপনি জানিয়ে দিলেন, আপনার পরে আর একটাও আধুনিক বাংলা গান তৈরি হয়ে থাকলে সেটি নচিকেতার ‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়...’। সেই নচিকেতা কদিন আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় সাক্ষাতকারে বলেছেন যে বাংলা গানে কবীর সুমনের কোন অবদান নেই। কী বলবেন?

কবীর সুমন- হা..হা..হা..কী বলব! আমার কিছুই বলার নেই। বলি গরম পড়েছে খুব। গরম পড়েছে, আহা রে (হাসতে হাসতে)।

২৪ ঘন্টা ডট কম- শুধু এইটুকুনিই প্রতিক্রিয়া?

কবীর সুমন- উত্তরে আরও তীব্র ও সুদীর্ঘ অট্টোহাসি...

২৪ ঘন্টা ডট কম- নচিকেতা অবশ্য বলেছেন যে বাংলা সাহিত্যে আপনার কিছুটা অবদান রয়েছে।

কবীর সুমন- ওলে বাবা লে, বাবা রে বাবা (সদ্যজাত শিশুকে আদর করার মতো করে)। গাল টিপে দেওয়া উচিত। আহা রে বাবু সোনাটা আমার। আরে আমি কি বলি বলুন তো? এখন কেউ যদি বলে গঙ্গানামে যে নদীটা দেখছো ওটা আসলে হোয়াং হো নামক নদীর একটি উপনদী, তাহলে আমি তাকে কি বলতে পারি! যদি কেউ এসে বলেন, তোমরা যাকে কাস্তে বল ওটা আসলে ইনকিউবেটর, ওখানে মুরগি ঢুকিয়ে দাও দেখবে কেমন পকা পক ডিম বেরচ্ছে, তা সেক্ষেত্রে আমার যা প্রতিক্রিয়া হবে এক্ষেত্রেও তাই।

২৪ ঘন্টা ডট কম- ভবিষ্যতে নচিকেতা চক্রবর্তীর গান আর গাইবেন?

কবীর সুমন- হা..হা..হা..কী বলব শুধু ওই গানটা নয় নচিকেতা চক্রবর্তীর আরেকটি গান ছিল "পাতা ঝড়া মরশুমে আমরা বৈশাখি হাওয়া..." অসামান্য লেগেছিল গানটা, এখনও লাগে। এবং আমি এই গানটা শিখে নিয়ে গাইবারও পক্ষপাতী। "যখন সময় থমকে দাঁড়ায়" এখনও আমি সুযোগ পেলে এখানে ওখানে গেয়ে থাকি। আরেকটা গান আছে, "তুমি আসবে বলেই" আমার ভীষণ ভাল লেগেছে। গানের সুরটা ভাল লেগেছে। আমি গান বলতে সুর বুঝি। উনি অনেকদিন ধরেই কীসব বলছেন! কিন্তু মুশকিল হল, ওনার সঙ্গে তো আমার দেখা সাক্ষাতও হয় না।

২৪ ঘন্টা ডট কম- কবীর সুমন কি প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে এখন একটু রেস্ট্রিক্টেড?
কবীর সুমন-
দেখুন, আমি একজন প্রবীণ মানুষ। আমি কি অবদান রেখেছি সঙ্গীতে তা আমি জানি। এবার কে কি বলল না বলল তাতে কিছু আসে যায় না। নচিকেতা ছেড়ে দিন, একবার ডি.এল. রায়ের মতো মানুষ রবীন্দ্রনাথকে ভেঙিয়ে 'আনন্দ বিদায়' নামক নাটক লিখেছিলেন। ভাবা যায়! এসএফআই এক সময় 'জাতিস্মর' গানটাকে ভেঙাত। নচিকেতা তো একসময় এই পার্টির হয়েই আমাকে গালাগাল করত। ওদের সঙ্গে থেকে ওনার অনেক বেশী আয় হয়েছে, অনেক বেশি বিত্তের অধিকারি হয়েছেন। আমি থাকলে আমারও হত। কিন্তু আমার রুচিতে বেধেছে।

২৪ ঘন্টা ডট কম- এই ধরনের মন্তব্যের পিছনে কারণটা কী বলে মনে হয়?
কবীর সুমন-
আসলে পুরো জিনিসটা একটা হতাশা থেকে আসে। আমি যেমন দেখেছি অনেকেই আমার জীবনে কজন মহিলা, এই নিয়ে চিন্তা করে। ওই ডি.এল. রায়ের মতই সারাক্ষণই ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা আর গভীর আত্ম অমর্যাদা।

২৪ ঘন্টা ডট কম- এই ঈর্ষা কী আপনার মহিলা গুনমুগ্ধের সংখ্যার জন্য নাকি সঙ্গীত প্রতিভার জন্য?
কবীর সুমন-
আমি জানি না। আমার মনে হয় না, সঙ্গীত-ঠঙ্গিত নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা লাগিয়েছেন বলে। এই ব্যাপারটা আমার কাছে সত্যিই স্পষ্ট নয়। দেখুন নচিকেতাবাবু আমার সম্পর্কে যে কথাগুলো বলেছেন সেগুলো আমি জানি। শুধু উনি নয়, একজন কবিও বলেছেন শুনেছি, আমি নাকি উপেক্ষারও অযোগ্য। এটা আমি কিন্তু পড়িনি, আমাকে বলা হয়েছে। তেমনি আমার শিরদাঁড়া নেই, অনেকের রয়েছে তাই নিয়ে কত কি হয়েছে-

২৪ ঘন্টা ডট কম- তবে শিরদাঁড়া নিয়ে যিনি কবিতা লিখেছেন তিনি কিন্তু ঘোষিত সুমন ভক্ত।
কবীর সুমন-
হোক না। তিনি কোথাও ভক্ত, কোথাও শক্ত, কোথাও মক্ত, কোথাও পোক্ত। আমি বলি কি ওটা নিয়ে ওঁর লেখার অধিকার রয়েছে। কিন্তু কই আর কেউ তো লেখেননি।  জয় গোস্বামী তো লেখেননি, ধরুন শরৎবাবু তো লেখেননি, তারাপদ রায় তো লেখেননি, সুনীল লেখেননি, শক্তি লেখেননি, আরও অনেকে আছেন যেমন দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়, আমার সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি, তিনি তো লেখেননি, স্বাগতা দাশগুপ্তও তো লেখেন না, কৃষ্ণা বসু লেখেন না।

২৪ ঘন্টা ডট কম- শিরদাঁড়া নিয়ে এই যে কবিতা এটাকে কীভাবে দেখছেন, একটা বিরোধী মত নাকি রুচিহীনতা?
কবীর সুমন-
একেবারে রুচিহীন। একটা রাজ্য একেবারে নেমে যাচ্ছে। একেবারে বারোটা বেজে গেছে। ভারতে এতগুলি রাজ্য আছে, এত সংস্কৃতি রয়েছে এসব কথা কোথাও হয় না। আমাদের এখানে ঘটে কেন? কারণ আমরা পরাজিত। আমরা রামমোহনের সঙ্গে একই জিনিস করেছি, বিদ্যাসাগরের সঙ্গেও তাই। বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের শেষ পঁচিশটা বছর বাঙালির মুখ দর্শণ করেননি।

২৪ ঘন্টা ডট কম- যাঁরা আপনাকে এসব বলছেন তাঁদের কিছু বলতে চান?

কবীর সুমন- একটা হল ভাড়া করে অনুষ্ঠান হোক। হল ভাড়া আমি দেব। কেউ যেন কোনও পলিটিক্যাল পার্টির সাহায্য না নেয়। আমি একা থাকব। ক রাত্তির চাই (কণ্ঠে প্রত্যয়ের বিচ্ছুরণ)? ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে শ্রোতারা আসুক। যাঁর যাঁর আমার সংগীত নিয়ে বলার আছে তাঁদের সকলকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, শুধু একটা তানপুরা থাকবে আমাদের মাঝে। আসুন তো আপন মনে গান শোনাই লোককে। কবিতাও হোক। যারা আমার শিরদাঁড়া নিয়ে খুব চিন্তিত তাঁরাও আসুন, কবিতা বলুন আমিও একটু কবিতা বলি। আসুন না মানুষকে আমরা এন্টারটেনমেন্ট দিই। খেউড় করে কি লাভ?  কবে হবে জানাবেন কিন্তু।  চ্যালেঞ্জ নয়, আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, শরত্কালের আমন্ত্রণ...

কবীরের প্রত্যয়ী অনুভব শরতের পেঁজা তুলো মেঘের মতো ভাসতে থাকে...

 

.