বোল্ড বাট নট আউট!

আট-ন'বছর আগের কথা। কলকাতার নামী মিডিয়া হাউসের ট্রেনি জার্নালিস্ট আমি। প্রথম দিকের অ্যাসাইনমেন্ট। তখন মুম্বইয়ের এক মডেল-কাম-উঠতি অভিনেত্রী একটি বাংলা ছবির শুটিং করতে কলকাতায় এসেছেন। কলকাতার ক্যানভ্যাসে তখনও 'পাপারাত্‍জি'র পোঁচ পড়েনি, তাই খানিক নির্বিঘ্নে ইন্টারভিউ নেওয়া যেত। ঠাণ্ডা ঘরে বসেও কপালে অনভিজ্ঞতার ঘাম। নোটবুকে ঝালিয়ে নিচ্ছি শেষ মুহূর্তের প্রশ্নগুলো।

Updated By: May 22, 2012, 04:53 PM IST

আট-ন'বছর আগের কথা। কলকাতার নামী মিডিয়া হাউসের ট্রেনি জার্নালিস্ট আমি। প্রথম দিকের অ্যাসাইনমেন্ট। তখন মুম্বইয়ের এক মডেল-কাম-উঠতি অভিনেত্রী একটি বাংলা ছবির শুটিং করতে কলকাতায় এসেছেন। কলকাতার ক্যানভ্যাসে তখনও 'পাপারাত্‍জি'র পোঁচ পড়েনি, তাই খানিক নির্বিঘ্নে ইন্টারভিউ নেওয়া যেত। ঠাণ্ডা ঘরে বসেও কপালে অনভিজ্ঞতার ঘাম। নোটবুকে ঝালিয়ে নিচ্ছি শেষ মুহূর্তের প্রশ্নগুলো।

নায়িকা এলেন ঘরে। তুলির টানে আঁকা চোখ, ভ্রু। টিকোলো নাক, কচি ডালিম-চিবুক। এমন এক সুমুখশ্রী দেখলে মা-দিদিমারা ছেলে বা নাতির সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব পেড়ে ফেলতেন এখুনি। কিন্তু নায়িকা মুম্বইবাসী, তায় দক্ষিণী। শরীরের ছাঁদে বঙ্গনারী বলে ভ্রম হওয়ার সম্ভাবনাই সেন্ট পারসেন্ট। আরও অবাক হলাম...

পরিচ্ছন্ন, টান-মুক্ত বাংলায় আলাপ শুরু করলেন সুন্দরী। এগিয়ে দিলেন হাতে ধরা ক্যারামেল পপকর্নের টাব। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বাংলা শিখেছেন! যাই হোক, ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নগুলো নোটবুকেই তুলে রেখে নির্ভেজাল আড্ডা। মুম্বইয়ের লেটেস্ট গসিপ থেকে সাহিত্য, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স থেকে সোশিওলজি। শেষেরটি ওই নায়িকার অনার্স সাবজেক্ট ছিল। পপকর্ন শেষ করে হঠাত্ আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, "কী ভাল লাগল আমার! আমায় কেউ ইন্টারভিউতে সোশিওলজি নিয়ে জিজ্ঞেস করে না। মনে হল কলেজ ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিলাম!"

সেই আলিঙ্গনের বাঁধন আজও আলগা হয়নি। এবছর সেই নায়িকা পেয়েছেন ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। 'দ্য ডার্টি পিকচার' ছবির জন্য। একই সঙ্গে তিনি সামলাচ্ছেন সামাজিক দায়িত্ব। দেশ জুড়ে 'স্যানিটেশন ড্রাইভ'-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হলেন তিনি। সেদিনের সেই ইন্টারভিউতেই জানিয়েছিলেন তাঁর এই ইচ্ছেটার কথা। সোশিওলজির স্টুডেন্ট ছিলেন যখন। আর বোধহয় নাম বলতে হবে না...বিদ্যা বালন। The Big ' V '। দ্য বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল। গত বছর বলিউড ছবিতে 'হিট'-এর খরা তিনি একা 'বুক' দিয়ে বাঁচিয়েছেন। 'বুক' চিতিয়ে খান খান করেছেন 'খান'-সাম্রাজ্য।

আজকাল, কোনও নায়িকা এক ইঞ্চি বুক বেশি দেখালেই তাঁকে বোল্ড বলাটা রীতি। ক্যামেরার সামনে নায়ককে লিপ-কিস করলেই বলি বোল্ড সিন। আর শয্যাদৃশ্যে স্কিন-শো করলে তো ক্লিন বোল্ড! এক দশক আগেও ফিল্ম-সাংবাদিকতায় বোল্ড শব্দটা এমন সহজপাচ্য ছিল না। আমাদের সিনিয়ররা নগ্নতাকে নগ্নতাই বলতেন। যৌনতাকে যৌনতা। চুমুকে চুমু। এবড়োখেবড়ো সেক্স-দৃশ্যকে মাখন মাখিয়ে বোল্ড বলার আহ্লাদেপনা চালু হয়নি তখনও। আর এই বোল্ড-এর মোড়কেই নায়িকাদের মধ্যে শুরু হয়নি নগ্ন হওয়ার চোরা-প্রতিযোগিতা।

হাল আমলে 'সাহসী' হওয়ার দৌড়ে নতুন ট্র্যাকে দৌড়চ্ছে টলিউড। গত দু'বছর ধরে এক টলি অভিনেত্রী মিডিয়ার কাছে ঢ্যাঁড়া পেটাচ্ছিলেন, 'আমার কোনও ন্যাকামি নেই। পর্দায় নগ্ন হতে রাজি আছি।' এই বলে বেশিরভাগ সময়ে এন্টারটেনমেন্ট বুলেটিনের শীর্ষে ছিলেন তিনি।

অসুবিধে নেই। নায়িকাদের এমন স্টেটমেন্ট পাবলিক খায়। সাংবাদিকদেরও খোরাক জোটে। অসুবিধে হল যখন তিনি বেমক্কা কাজটি করে বসলেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এক পরিচালকের ছবিতে। চ্যাঁচড়ার বেড়ার আড়ালে খুল্লামখুল্লা 'ওরাল সেক্স।' 'অস্ফুট' শীত্‍কার এবং সহ-অভিনেতার উদ্দেশে অশ্রাব্য সব অনুরোধ। এমন সাহসী দৃশ্য বাপের জন্মে দেখেনি বাঙালি নয়ন! অবশ্য MMS-এ দেখেনি এমন নয়, কিন্তু মেনস্ট্রিম নায়িকার এমন কাজ...ছি:!

সেই দৃশ্যে ক্যামেরা ছিল একই জায়গায় স্থির। ঠিক যেভাবে লুকিয়ে মোবাইলে পর্ন ভিডিও শুট করা হয়। একটি নগ্ন শয্যাদৃশ্যকে বাস্তব এবং বোধগম্য করবার জন্য পরিচালক বা ক্যামেরাম্যান কেউই তেমন শ্রম ব্যয় করেননি। লং শট-এ 'uncut' ঐ ভার্সান প্রায় MMS -এর মর্যাদাতেই ফাঁস হয়ে গেল YouTube-এ!

বঙ্গজুড়ে ছিছিক্কারের পঙ্কেও, কয়েকজন দরদী সাংবাদিকের কাছ থেকে দুয়েকটা বাহবার পদ্মফুল অবশ্য জুটেছিল নায়িকার। "ইনিই প্রথম 'সাহসিকা,' 'বোল্ড' বঙ্গললনা যিনি ইহা ক্যামেরার সামনে 'করিয়া' দেখাইয়াছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়াই ক্ষান্ত হন নাই"। ইত্যাদি, ইত্যাদি। নায়িকাও সেই স্টেটমেন্ট-টি ক্যাশ করলেন। মুম্বইয়ে একটি খুল্লমখুল্লা ছবির অফার জুটল। ছবি ফ্লপ। এখন তিনি প্রাণপণ চেষ্টায় আছেন ইমেজ মেক-ওভারের!

ঐ বিদেশি ছবিটি যদিও বঙ্গদেশে আর মুক্তির আলো দেখেনি, তবে একালের অভিনেত্রীদের মধ্যে ঘটনাটা বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। ঐ নায়িকারই এক 'কলিগ' সগর্বে ঘোষণা করেছেন যে, 'আমিও নগ্ন হব, তবে ওর মতো টিকটিকির ল্যাজ হব না। দেদার খাব, মদ গিলে আউট হব, জীবন থেকে ডায়েটিং বাদ দেব, তারপর হব। আরে বাবা পাবলিক আমার 'কার্ভস' দেখতে চায়!

'দ্য ডার্টি পিকচার'-এর পর মুটকি নায়িকারা নিজেরাই নিজেদের একটা পোশাকি নাম দিয়েছেন। 'কার্ভেশাস!' দেখাদেখি বিগত-যৌবনা নায়িকারাও ক্যামেরার সামনে নানান ভঙ্গিমায় ত্বক আবিষ্কার করছেন! খুদে নিউ-এন্ট্রান্টরা ব্যাপার-স্যাপার দেখে সার বুঝছেন, বুক দেখালেই নাড়ু মিলবে...

সবার দাবীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে জনান্তিকে বলি, এঁদের জন্মের ঢের আগে দেবিকারানি অন-স্ক্রিন সপাট চুমু খেয়েছেন। স্টিল ক্যামেরার সামনে বক্ষসম্ভার উন্মুক্ত করেছেন কাননদেবী। পর্দায় নগ্ন হওয়ার নিদর্শনও ভারতীয় ছবিতে রয়েছে বহুদিন আগেই। 'ফাইভ রাইফেলস' ছবির সেই সুবিখ্যাত দৃশ্য, রাইফেল হাতে নগ্ন উর্ধ্বাঙ্গের সেই পাঁচ অভিনেত্রী! সেন্সরের কাঁচির শাসন আজও রুদ্ধ করতে পারেনি ইন্টারনেটে অ্যাভেলেবিলিটি। তখন ফোটোশপের সুবিধে ছিল না। নায়িকাদের আঢাকা অংশের দাগ মেচেতা, ছুলি ফোটোশপের ক্লিকে পরিষ্কার করা হত না। বিদেশি ক্রিম-ফাউন্ডেশন-কনসিলারের পলেস্তরায় খুঁত ঢাকার সুযোগও ছিল না।

'দ্য ডার্টি পিকচার' যাঁরা দেখেছেন, এবং সঠিক বুঝেছেন, তাঁরা একমত হবেন যে, বিদ্যা বালন আসলে দীর্ঘদিনের একটা চক্রে উল্টোপাক দিতে পেরেছেন। আগেও নারীকেন্দ্রিক ছবি হয়েছে বলিউডে। রাখির 'মা', রেখার 'খুন ভরি মাং' এবং আরও অনেক অনেক ছবি ছিল নায়িকাপ্রধান। তবু এখনও, বলিউডে নারী অভিনেত্রী ততখানি জায়গাই পেয়েছে, যতখানি পুরুষ তাকে ছেড়েছে। ছবি ব্যবসা করলেও নারী-অভিনেত্রীকে ক্রেডিট দেওয়ার রেওয়াজ ছিল না এত কাল। বিদ্যার বালনের নাম এখন বলিউড শেয়ারমার্কেটের সূচক উপরের দিকে তুলেছেন, তার নেপথ্যে শুধু 'কার্ভস'-ই একমাত্র কারণ নয়। দীর্ঘ সংগ্রাম, সংযম, হৃদয়ে ভাঙন ও জোড়া দিয়ে এক ধাপ করে সিঁড়ি ওঠার যে কাজটা দাঁতে দাঁত চেপে এত দিন করেছেন বিদ্যা, তারই একটা সম্মিলিত বহি:প্রকাশ 'ডার্টি পিকচার।'

আসলে এঁদের জানা নেই বাঙালি অভিনেত্রীদের সম্ভ্রমের চোখেই দেখে ইন্টারন্যাশনাল দর্শক। বিশ্বের দরবারে পৌঁছনোর জন্য নগ্নতা কোনও চাবিকাঠি নয়, অস্ত্রও নয়। বিশ্ব এখনও বঙ্গনারীর অধরা মাধুরীতেই মজে আছে। দেখতে চায়নি তার ত্বকের নির্লজ্জ বিস্তার। বোল্ড শব্দটা দিয়ে যতই সেটাকে 'অথরাইজ' করার চেষ্টা হোক না কেন, নায়িকাদের জীবনে শরীর একটা ফাঁদ। প্রায় সারা কেরিয়ার জুড়েই বুদ্ধি খাটিয়ে ট্যাকল করতে হয় এটাকে। তবুও জীবনে একবার-না-একবার এই বিপুল, বিশাল এন্টারটেনমেন্টের পৃথিবীতে লুকিয়ে থাকা চোরা-শিকারীর ফাঁদে পা দেন সব অভিনেত্রীই। সাফল্যের চুড়োয় দাঁড়িয়ে এখনও রাত্রি শেষে বালিশ ভেজে চোখের জলে। সে প্রসঙ্গে না হয় পরে আলোচনা হবে। আজ বরং বোল্ড বিদ্যার জন্য রইল বুকভরা ভালোবাসা। এক নম্বরে এসে, শুটিং-এর প্রবল চাপ সামলেও নিজের দেশকে 'ক্লিন পিকচার' করতে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। এমন এক নায়িকা যাঁকে নির্দ্বিধায়, নিশ্চিন্তে বলা যায়- BOLD!

ফুলকলি






Tags:
.