শর্মিলা, ভালবেসে ভোটে লড়ুন, আপনার জয় হোক

Updated By: Aug 10, 2016, 06:47 PM IST
শর্মিলা, ভালবেসে ভোটে লড়ুন, আপনার জয় হোক

নির্ণয় ভট্টাচার্য্য

নাকে গোঁজা দুটো নল, ছোট ছোট দুটো চোখ, কঠোর চোয়াল আর এক নির্লিপ্ত চাহনি- নাম ইরম শর্মিলা চানু। জীবনের ষোলোটা বছর না খেয়ে রইলেন। প্রতিবাদের না খাওয়া। অভিমানের না খাওয়া। কিন্তু, রাষ্ট্র বুঝলে তো! তোয়াক্কা করলে তো! হাজার হোক শর্মিলাও তো রাষ্ট্রেরই সম্পত্তি। তাই রাষ্ট্রও তাঁর গোঁসা ঘরের খিল ভেঙে (না খুলিয়ে), প্রতিরোধের ব্যারিকেড টপকে তাঁকে কারাশয্যায় শুইয়ে নাকে নল গুঁজে খাইয়েছেন বছরের পর বছর। শাস্তিও দিয়েছে, দায়িত্বও পেলেছে। গল্পটা এভাবেই চলছিল...কয়েক বছর ধরে। কিন্তু শর্মিলা নিজেই গল্পটায় অন্য বাঁক আনলেন। বৈপ্লবিক বাঁক। জীবনের বাঁক।

গুঞ্জনটা চলছিলই কয়েকদিন ধরে। অবশেষে, গত কাল সরকারিভাবে আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন, আর অনশন নয়। এবার তিনি খাবেন। ভোটে লড়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টাও করবেন, হতে পারলে Armed Forces (Special Power) Act'1958 (আফস্পা)-কে প্রত্যাহার করবেন। এবং অবশ্যই বিয়ে করে সংসার করবেন। এসব কথাই শর্মিলা গতকাল বলেছেন। কিন্তু, আজ যা বললেন তা আরও তীক্ষ্ণ, আরও সরাসরি-"আমি দেবী হয়ে বাঁচতে চাই না। এটা আমার জীবন। সিদ্ধান্ত আমি নেব। মানুষের ওপর আস্থা রয়েছে। তাঁরা আমার পাশে থাকলে নির্বাচনে জিতে আফস্পা হটাবই।" শর্মিলার এই অনশন প্রত্যাহার ও বিয়ে করার সিদ্ধান্তে তাঁর পরিবার ও 'সহযোদ্ধা' মহল থেকে যে প্রতিক্রিয়া উঠে এল তা ভাবাচ্ছে। না, ভাবাচ্ছে না, খারাপ লাগাচ্ছে। না, খারাপ লাগাচ্ছে না, হতাশ করছে।

শর্মিলার দাদা সিংহজিত্ বলেছেন, "এটা ওর (শর্মিলার) ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমাদের কিছু বলার নেই।" তিনি আরও জানিয়েছেন, তাদের মা সখী দেবী বলেছেন যে আফস্পা প্রত্যাহার না করা হলে তিনি মেয়ের মুখ দেখবেন না। শর্মিলা চানুর আন্দোলনের সেনাপতি বাবলু লোইতংবাম শর্মিলার এই সিদ্ধান্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যে শর্মিলা ছিলেন মনিপুরের মুখ। অনশন ভাঙার, ভোটে লড়ার এবং সংসার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনিই রাতারাতি মণিপুরের (তাঁর একদা ঘণিষ্ঠদের) আক্রমণের লক্ষে। তাঁর পাশে কেউ নেই। নার্স তাঁর মুখে মধু দিয়ে অনশন ভাঙালেন। কেনও পরিজন নেই, কোনও সহযোদ্ধা নেই। মণিপুরি একটা সংগঠন প্রাণ কেড়ে নেওয়ার হুমকিও দিল চানুকে। অনেকেই বিশেষত তাঁর এককালের সহযোদ্ধারা বললেন, 'প্রেমে ফাঁসিয়ে রাষ্ট্র আসলে তাঁকে আদর্শচ্যুত করতে চাইছে।' কিসের আদর্শ? আদর্শটা কী ভোটে লড়ার বিরুদ্ধে ছিল? ভালবেসে বিয়ে করার বিরুদ্ধে ছিল? অনশনও একটা আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। ভোটও তো তাই, তাহলে? অনশনের মূল লক্ষ্য ছিল আফস্পা হটানো, ভোটে লড়ার উদ্দেশ্যও তো তাই। আর পড়ে রইল, প্রেম আর সংসার। তার সঙ্গে প্রতিবাদের বিরোধ কোথায়? বরং ভাল না বাসলে কী প্রতিবাদ করা যায়? বিপ্লব হয়? যারা বলছে তারা কী সুস্থ? নিশ্চই সুস্থ, তারা কী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন?

শর্মিলা ১৬টা বছর না খাওয়া প্রতিবাদ করে বুঝছেন যে এই পথে কাঙ্খিত আফস্পা প্রত্যাহার অসম্ভব। হওয়ার হলে এর মধ্যেই হত। তাই তিনি কৌশল বদলালেন। 'যে অস্বস্তিকর ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছো, সেটাকে অনুসরণ করেই তার শীর্যে ওঠো। ব্যবস্থা বদলানোর ক্ষমতার অধিকারি হও, আর তারপর ব্যবস্থাটাকে বদলে দাও'-এটাই চানুর বর্তমান কৌশল। তিনি সফল হবেন কিনা সে কথা ভবিষ্যত বলবে, কিন্তু আজকে তাঁর 'মুন্ডুপাত' ইতিহাসকে লজ্জা দেবে নিশ্চিত।

আসল ব্যাপার হল, শর্মিলা চানুকে প্রতিবাদের মুখ করে, বিপ্লবের পাষাণ বেদী বানিয়ে অনেকেই দায়মুক্ত মূলস্রোতের জীবনে রয়েছেন। শর্মিলা বুঝছিলেন তিনি জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। বিপ্লবের দায় কাঁধে নিয়ে কেবল বছরের পর বছর নাকের নলকে সাথী করে শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হচ্ছিলেন। আজ সেই বেদীটা বলেছে আমি আর দেবী (পড়ুন, বেদী) হয়ে থাকতে চাই না, মণিপুরের মানবী হয়ে উঠতে চাই। এখানেই গণ্ডগোল, বেদী না থাকলে তো 'বিপ্লবের থান' হারিয়ে যায়, সেই বিপ্লব থেকে পাওয়া স্বপ্ন ও সুবিধার অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে যায়। তাই এই বিরুদ্ধাচরণ।

মজার কথা, ২০০০ সালের ২রা নভেম্বর মালোম বাসস্ট্যান্ডে যে ১০ মানুষ 'ভুয়ে সংঘর্ষে' খুন হয়েছিলেন, তাঁদের পরিবার কিন্তু পুরোপুরি সমর্থন করে শর্মিলার মূল-স্রোতে ফিরে আসার সিদ্ধান্তকে। বিরোধিতা করে শর্মিলার প্রেমিক ডেসমন্ডকে হীন সমালোচনা করাকে। ওঁরা সত্যিই শর্মিলার এই ঘর বাঁধার (ও ভোটে লড়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে) স্বপ্নকে সমর্থন করেন কারণ ওঁদের যে ঘর ভেঙেছে তাই ওঁরা যন্ত্রণাটা বোঝেন, অন্যকে ঘরের আনন্দ-সুখ পেতে দিতে চান। তাই, আজ যারা শর্মিলাকে সমালোচনা করছেন বিপ্লব বিচ্যুতির দোহাই দিয়ে, তারা নিশ্চিন্ত থাকুন ইতিহাস তাদের ক্ষমা না করলেও বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস তাদের মাথায় তুলে রাখবেই। আর শর্মিলা, আপনি জয়ী হোন। আপনি 'লৌহ মানবী'র লৌহ শিকল ভেঙেছেন, আপনার জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা...

.