বলিউড জাহাজে আনন্দের প্রাণসঞ্চার

ছবির নাম- শিপ অফ থেসিয়াস রেটিং- *****

Updated By: Jul 24, 2013, 10:58 PM IST

শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম- শিপ অফ থেসিয়াস
রেটিং- *****
শহরের জনবহুল রাস্তায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে এগোচ্ছে একটি ছোট্ট কীট। চতুর্দিকে ব্যস্ত বুটের সশব্দ আঘাত। যেকোনও মুহূর্তে মৃত্যু অনিবার্য। পরম মমতায় এগিয়ে এল একটি স্ট্যাম্প পেপার। কীটকে তুলে নিয়ে রেখে দিল সবুজ পাতার নির্বিঘ্ন আশ্রয়ে। আমরা দেখলাম, সেই স্ট্যাম্প পেপার হাতে এগিয়ে গেলেন সন্ন্যাসী মৈত্রেয়। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষাধীন পশুপাখিদের বাঁচার অধিকার নিয়ে মামলা লড়ছেন যিনি। সমাজের চোখে যা "ধিক্কৃত", "অবাস্তব"...হাসপাতালের সিঁড়ির তলায় হাহাকার করে কাঁদছেন এক হতভাগ্য মহিলা। তার স্বামীর অপারেশনের নামে চুরি গিয়েছে কিডনি। শোনার পর এক তরুণ স্টকব্রোকার নবীন (সোহম শাহ) তত্ক্ষণাত্ সিদ্ধান্ত নেয়, সেই ব্যক্তির চুরি যাওয়া কিডনি ফিরিয়ে দেবেই সে।
অন্ধ মহিলা হেঁটে চলেন রাস্তায়। হাঁস ও গৃহপালিত প্রাণীর ডাক শুনে ক্যামেরা বের করেন। অনায়াসে তুলে নেন অপূর্ব সব ফোটোগ্রাফ। সেই মহিলাই একদিন দৃষ্টি ফিরে পান আই ট্রান্সপ্লান্টেশনের মাধ্যমে। দুচোখ ভরে দেখতে থাকেন বহুবর্ণের পৃথিবীকে। ব্যাগে পুরে রাখেন তাঁর তৃতীয় নয়ন। শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তির ওপর ভরসা করেই যে পৃথিবীকে দেখেছিলেন তিনি!
সবাই এ ছবির কুশীলব নয়। তবু গোটা ছবি জুড়ে এদের কী দামাল উপস্থিতি। এ ছবির প্রধান চরিত্র বলা হয়েছিল, তিন জনকে। একজন অন্ধ মহিলা ফোটোগ্রাফার, এক জন সন্ন্যাসী ও একজন স্টকব্রোকার। সবারই কোনও না কোনও প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপিত হয়েছে জনৈক ব্যক্তির দেহ থেকে। এভাবেই যদি গল্পটাকে বলা হয় তবে বলিউডি স্টোরিটেলিং-কে এক বড়সড় থাপ্পড় কষানোই হবে। আসলে আনন্দ গান্ধীর ছবিটাকে উল্টো করে সাজালে ওই গল্পটা পেলেও পেতে পারেন, কিন্তু তা করলে নেহাতই ছেলেখেলা হবে। বরং, গল্পটা দেখতে থাকুন ক্যামেরার গতিপথ অনুসরণ করতে করতে। শিপ অফ থেসিয়াস ছবিতে পঙ্কজ কুমারের ক্যামেরা আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত, বহু গবেষণা সত্ত্বেও সুদূরপরাহত, বহু মতাদর্শে চর্চিত অথচ অদৃশ্যপূর্ব কোনও এক বাস্তবকে আবিষ্কার করেছে। যার নাম প্রাণ। জীবন।
প্রাণ আছে, এখনও প্রাণ আছে। শরীর ও আত্মা যেন পাশাপাশি শুয়ে আছে। আনন্দ গান্ধী এই শতবর্ষের সিনেমায় প্রথম প্রাণের ধারণা দেখালেন। থেসিয়াসের জাহাজের ধারণা দিয়ে। ক্ষুদ্র থেকে বৃহতের দিকে তার কেমন অনায়াস যাতায়াত। শুকনো পাতার উপরে হামাগুড়ি দিচ্ছে একটি পিঁপড়ে। তারই দেহ থেকে ছত্রাকারে শাখাবিস্তার করেছে এক বৃক্ষ। বৃক্ষের শাখা শিরায় শিরায় মিশে তৈরি হল মানুষের হাত। প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর যেন একটি একটি করে আঙুল মেলছে... এটাই শিপ অফ থেসিয়াসের পোস্টকার্ড ছবি। সারা শহরে কোথাও একটিও পোস্টার-গ্লোসাইন-টিজার পড়েনি। তবু মঙ্গলবার সিনেমাহলে ঢুকে ইংরেজি ভাষায় একটিই শব্দ মনে পড়ল- choc-a-block!

এমন প্রচারসর্বস্ব বহ্বাড়ম্বরপ্রিয় বলিউডে শেষ কোন ছবি সাহস করে এমন পাবলিসিটি পোস্টার তৈরি করেছে, স্মরণে আসে না। এবং তত্সত্ত্বেও সপ্তাহের প্রায় মধ্যভাগে এমন ভিড় দেখে সত্যিই বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। পরিচালক ও সহ-প্রযোজক আনন্দ গান্ধী যেখান থেকে ভাবনা শুরু করেছেন, সেই প্রাপ্তমনস্কতায় পৌঁছতে এখনও পারেনি ভারতীয় সিনেমা, একথাটা প্রথমেই বলে শুরু করা যায়। সমস্ত তর্ক, ভ্রুকুটি এবং উন্নাসিকতার দ্বার উন্মুক্ত করেই সগর্বে বলা যায়। এ ছবি কোন ধারায় পড়বে, বাণিজ্যিক না অফবিট না এক্সপেরিমেন্টাল, তা নিয়েও কোনও সংশয় আগেই খারিজ করে দেওয়া যায়। এক্সপেরিমেন্টাল বলে কোনও বর্গের অস্তিত্ব থাকলে এ ছবি সেই ল্যাবরেটরির এন্ড রেজাল্ট বের করে ফেলেছে, এক কথায় সেটাও বলা যায়। এবং সেটা যুগপ্রদর্শনকারী আবিষ্কার।
যে-কোনও আবিষ্কারে একটি বিজ্ঞানীর মনন থাকে। থিয়োরির বাক্যবন্ধ ভেঙে প্র্যাকটিক্যাল অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সের দিকে যাওয়ার নিরলস চেষ্টা থেকে। যে-বিষয় নিয়ে আনন্দ গান্ধী ভাবনা শুরু করলেন যা দিয়ে একটি পাঁচ মিনিটের অ্যাওয়ারনেস ডকুমেন্টারি বানানো হয়ে এসেছে এ-পর্যন্ত। উচ্চশিরে, অনমনীয়ভাবে ভাবনার উত্তুঙ্গ বিকাশ ঘটিয়ে যেখানে দাঁড়ি টানলেন, বলিউডের যে-কোনও পরিচালকের সুদূর ভাবনাতেও আসবে না, হলফ করে বলা যায়।
আবেগের গন্ডি পেরিয়ে যুক্তির ঘরে ঢোকা যাক। আনন্দ প্রথমেই যেটা করলেন, বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে মানব-অস্তিত্বের চারটি ভাগে ভাগ করে ফেলা। মাইন্ড, বডি, হার্ট অ্যান্ড সোল। নাঃ, চারটে আলাদা ছবির সমষ্টি নয়। ছবি যত এগোল, ততই যেন এই চার সত্তার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বাড়তে শুরু করল। কখনও সেই দৃষ্টিহীন সুন্দরী ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে তার বয়ফ্রেন্ডের, কখনও বৃষ্টির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চার্বাকের সঙ্গে মৈত্রেয়ের, কখনও তরুণ স্টকব্রোকারের সঙ্গে তার স্বাধীনতাসংগ্রামী দিদিমার...এমনি আরও কত সপ্রাণ ও প্রাণহীন চরিত্রের। জাতি-ধর্ম-ভাষা-জীবনচর্যার নানা ধাপ পেরিয়ে আনন্দ গান্ধী একটিই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন বলিউড ছবিকে। প্রাণ। বহুদিন চোখের পাতায় লেগে থাকবে আইদা এল-কাশফের অভিনয়। অন্ধ মহিলার চরিত্রে চোখ দিয়ে যে অভিনয়টা করলেন তার কাছে রানি মুখোপাধ্যায়ের ব্ল্যাক নেহাতই ফিকে লাগবে। অপূর্ব সুন্দরী আইদা দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার পর শুধু চোখের মণির ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে যে-অভিনয় করে গেলেন তাতেও মনে হল বলিউড ছবিকে যথার্থ দৃষ্টিদান করলেন তিনি। বাস্তবজীবনে এই মুহূর্তে তিনি তাঁর দেশেরই একটি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ছবির প্রোমোশনে আসতে পারেননি। ইতিমধ্যেই
বিদেশের ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নেওয়া এই তরুণী সম্পর্কে একটাই মন্তব্য করা যায়- বলিউডের শ্রেষ্ঠতম অভিনেত্রীও এঁর কাছ থেকে নতুন কিছু শিখবেন। মৈত্রেয়ের চরিত্রে নীরজ কবিও অসাধারণ। মন ছুঁয়ে যাবে সোহম শাহের আন্ডারঅ্যাক্টিং-ও। সারা ছবি জুড়ে আবহ হিসেবে জাহাজে নোঙর ফেলার এক যান্ত্রিক শব্দকে কেমন করে এত সুমিষ্ট করে তুললেন নরেন চন্দ্রভারকর, বেনেডিক্ট টেলর এবং রোহিত শর্মা, সেটা বড় জানতে ইচ্ছে করে!
আরও জানতে ইচ্ছে করে, কোন জাদুমন্ত্রে এডিটর আদেশ প্রসাদ এমন জটিল জীবনের ডিএনএ ভেঙেচুরে ১৪৩ মিনিট সময় বেঁধে হলভর্তি দর্শককে নার্সারি স্কুলের মতো পিনড্রপ সায়লেন্ট করে রাখলেন! মোবাইলের আওয়াজ তো দূর অস্ত, অসাবধানে পপকর্নের ঠোঙা উল্টে যাওয়ার শব্দেও বিরক্ত হতে দেখলাম একাধিক দর্শককে। শেষ কবে এমন মনোযোগী দর্শক দেখেছি মনেও পড়ে না।
এ ছবি রিলিজের আগেই শেখর কপূর, অনুরাগ কাশ্যপের মতো তাবড় পরিচালকেরা নিজেদের বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে বাণপ্রস্থে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। অনেক সপ্রশংস লেখালিখি পড়ে বেশ তৈরি মন নিয়েই ছবি দেখতে গিয়েছিলাম।
প্রচুর পুরস্কার ইতিমধ্যে পেয়েছে এই ছবি। বিদেশের বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালে। আগামী বছরে হয়ত পাবেও। তবু বোধহয় এ ছবির সঠিক মূল্যায়ন হবে না, কারণ চলচ্চিত্রে যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য কোনও নোবেল প্রাইজের ব্যবস্থা নেই!

.