অসম থেকে ফিরছি পর্ব ২: 'জোয়ানদের তুলে নিয়ে গেল পুলিস,' আশঙ্কার প্রহর নেলির রোজনামচায়

৮৩ সালের পর থেকে আশঙ্কার দোলাচলে দিন কাটাচ্ছে নেলি। গ্রাউন্ড জিরো থেকে কলম ধরলেন জি ২৪ ঘণ্টার প্রতিনিধি। 

Updated By: Aug 5, 2018, 06:57 PM IST
অসম থেকে ফিরছি পর্ব ২: 'জোয়ানদের তুলে নিয়ে গেল পুলিস,' আশঙ্কার প্রহর নেলির রোজনামচায়

কমলিকা সেনগুপ্ত

গুয়াহাটির কালাপাহাড় থেকে আমাদের গন্তব্য নেলি। অসমের নওগাঁয়ের নেলির বীভত্সা শুনেছিলাম। ১৯৮৩ সালে মাত্র ৬ ঘণ্টায় জাতিবিদ্বেষের হামলায় মৃত্যু হয়েছিল ২,১৯১ জনের। তবে সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি বলে মত অনেকেরই। আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল সেই নেলির দিকে। 

গাড়িতেই নেলি নিয়ে মনে আসছে হাজারো কথা। আর অশান্ত হয়ে উঠছি। ছোট ছোট পাহাড় পেরিয়ে এগিয়ে চলল গাড়ি। গুয়াহাটি থেকে ডিব্রুগড়ের দিকে যত ছুটে চলেছি, পরিবেশটা যেন গুমোট হয়ে উঠছে। নেলিতে পৌঁছে মনে হল, তা আরও খানিকটা বাড়ল। আমার গাড়ি দাঁড়াল একটা মসজিদের সামনে। সংবাদমাধ্যমের গাড়ি দেখে একজন বেরিয়ে এসে বললেন, ''গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের নামই ওঠেনি নাগরিকপঞ্জিতে। আপনে যাইবেন''? 

গাড়ি কিছুটা দূর এগিয়ে যেতেই দেখলাম চায়ের দোকানের সামনে একটা জটলা। দাঁড় করালাম গাড়ি। সাংবাদিক পরিচয় দিতেই কথা বলতে এগিয়ে এলেন কয়েকজন। দেখলাম, একজন নথিপত্র হাতে উদভ্রান্তের মতো ঘুরছেন। দেখতে পেয়ে খানিকটা স্বগতোক্তির ঢঙেই বললেন,'আমি ডি ভোটার। আমারে কি ক্যাম্পে রাখবে ওরা? ২০১১ থেইক্যা ভোট দিতে পারি না। বউটারে পুড়াই দেছিল ৮৩ সালে। আমারে তুইল্যা নিয়ে গ্যালে মাইয়াটার কি হইব, কহেন'? আয়েব আলির মুখ থেকে কথাগুলো শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল! পেশার টানেই ছুটে আসা, তবে সে সব ছাপিয়ে পরিবার হারানোর বেদনা গ্রাস করছে। আয়েবের মতো Doubtful বা সন্দেহজনক ভোটার তালিকায় নাম রয়েছে এখানকার বহু মানুষের।

চায়ের দোকানের জটলা ছেড়ে এগিয়ে চলল গাড়ি। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানতে পারলাম, সন্দেহজনক ভোটাররা নাগরিকপঞ্জির সমীক্ষায় নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের সুযোগই পাননি। তাঁদের কাউকে প্রমাণপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি। আর একটু এগিয়ে দেখলাম, মাটির ঘরগুলির মধ্যে বিরাজমান নিস্তব্ধতা। একবার ঘর পুড়েছে, নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর সিঁদূরে মেঘ দেখছে নেলি!         

চলতে চলতে পড়ল একটা মাঠ। জানতে পারলাম, এই মাঠেই ৮৩ সালে বহু নিরীহতে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। স্থানীয়রা জানালেন, নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের আগে গ্রামের কয়েকজন যুবককে ডিটেনশন ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গিয়েছে পুলিস। গ্রামের একজন বললেন, 'দিদি তরতাজা জোয়ান পোলাগুলারে তুইল্যা নিয়ে গেসে?' বুঝলাম নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের আগেই অনেকের ঠিকানা ডিটেনশন ক্যাম্প। নেলি ছাড়ার আগে অশীতিপর এক বৃদ্ধ বিড়বিড় করে বললেন, 'পুলিশ আইলে মনে হয় নিয়া যাইবো আমাগো। খুন, চুরি করি নাই গো দিদি'!

৮৩ সালের পর থেকে নেলি কতটা বদলে গিয়েছে, তা জানতে এসেছিলাম। মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল একরাশ প্রশ্ন। কঠিন বাস্তব দেখার পর উত্তর খোঁজাটা অনর্থক। ভাল নেই নেলি। সন্দেহজনক হয়েই বেঁচে আছে সে।

আরও পড়ুন- অসম থেকে ফিরছি পর্ব ১: নাম আছে? অসমজুড়ে একটাই প্রশ্ন

.