মোদীর 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া', ফেসবুকে তেরঙা প্রোফাইল পিকচার, কেন সমর্থন নয়...

প্রধানমন্ত্রীর 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া'-র ঘোষণায় উৎফুল্ল 'টেকস্যাভি' ইন্ডিয়া। সরগরম ফেসবুক। জুকারবার্গের পথ অনুসরণ করে নিজের প্রোফাইল পিকচার তেরঙা করার কম্পিটিশন চলছে পুরোদমে। (কজন বুঝে, কজন  ঝোঁকে এই ছবির তেরঙাকরণে মেতেছেন সে প্রশ্ন থাক না হয়)। প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব উক্তি অনুযায়ী রোটি, কাপড়া, মাকান নয়  এ দেশের যুবসমাজের মূল ভাবনাই নাকি এখন উনডোজ, অ্যানড্রয়েড বা আইওএস-এ সীমাবদ্ধ। কোনটা ছেড়ে কোনটা বেছে নেবে তা নিয়েই নাকি ভারী ব্যস্ত নেক্সট জেন ইন্ডিয়া। যদিও, এদেশের মাত্র ১৯% মানুষ এখনও পর্যন্ত অন্তর্জালের সুবিধাভোগ করেন। 'ইন্ডিয়া'-র বাইরে ভারতের বাকি ৮১% মানুষই (যার মধ্যে একটা বড় অংশই যুব সমাজ) যারা হয়ত খুব বেশি হলে নাম শুনেছেন ইন্টারনেটের, কিন্তু জানেনই না এটি খায় না মাথায় দেয়, তাদের সম্পর্কে, তাদের খাদ্য, বাসস্থান, জীবীকার রোজকার, দাবি, চাহিদা নিয়ে মন্তব্য করে খুব একটা সময় নষ্ট করেননি তিনি। নষ্ট করেননি সিলিকন ভ্যালির ঝাঁ চকচকে 'পরিবেশ'।   

Updated By: Sep 29, 2015, 05:13 PM IST
 মোদীর 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া', ফেসবুকে তেরঙা প্রোফাইল পিকচার, কেন সমর্থন নয়...

ওয়েব ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রীর 'ডিজিটাল ইন্ডিয়া'-র ঘোষণায় উৎফুল্ল 'টেকস্যাভি' ইন্ডিয়া। সরগরম ফেসবুক। জুকারবার্গের পথ অনুসরণ করে নিজের প্রোফাইল পিকচার তেরঙা করার কম্পিটিশন চলছে পুরোদমে। (কজন বুঝে, কজন  ঝোঁকে এই ছবির তেরঙাকরণে মেতেছেন সে প্রশ্ন থাক না হয়)। প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব উক্তি অনুযায়ী রোটি, কাপড়া, মাকান নয়  এ দেশের যুবসমাজের মূল ভাবনাই নাকি এখন উনডোজ, অ্যানড্রয়েড বা আইওএস-এ সীমাবদ্ধ। কোনটা ছেড়ে কোনটা বেছে নেবে তা নিয়েই নাকি ভারী ব্যস্ত নেক্সট জেন ইন্ডিয়া। যদিও, এদেশের মাত্র ১৯% মানুষ এখনও পর্যন্ত অন্তর্জালের সুবিধাভোগ করেন। 'ইন্ডিয়া'-র বাইরে ভারতের বাকি ৮১% মানুষই (যার মধ্যে একটা বড় অংশই যুব সমাজ) যারা হয়ত খুব বেশি হলে নাম শুনেছেন ইন্টারনেটের, কিন্তু জানেনই না এটি খায় না মাথায় দেয়, তাদের সম্পর্কে, তাদের খাদ্য, বাসস্থান, জীবীকার রোজকার, দাবি, চাহিদা নিয়ে মন্তব্য করে খুব একটা সময় নষ্ট করেননি তিনি। নষ্ট করেননি সিলিকন ভ্যালির ঝাঁ চকচকে 'পরিবেশ'।   

কিছুদিন ধরেই নেট নিউট্রালিটির স্বপক্ষে সরব হয়েছিলেন এদেশের টেকস্যাভি মানুষরা। ফেসবুকের দাবি এদেশে তাদের ইন্টারনেট ডট অর্গ নাকি এই নেট নিউট্রালিটির পথই প্রসস্থ করবে। কিন্তু কতটা সত্যি সেই দাবি? একবার বুঝে নেওয়া যাক... 

ইন্টারনেট ডট অর্গটা আসলে কী? উন্নয়শীল কিছু দেশে ফেসবুক কিছু টেলিকম প্রোভাইডারের সঙ্গে গাটছড়া বেঁধেছে। এদেশে তাদের সঙ্গী রিলায়েন্স কম্যুনিকেশন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এই বন্ধন তৈরি হয়েছে। কী হবে এর ফলে? গ্রাহকরা কিছু নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের ফ্রি অ্যাকসেস পাবেন। যেমন আজ তক, টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া টুডে ইত্যাদি। পাওয়া যাবে কিছু শিক্ষামূলক সাইট (যেমন উইকিপেডিয়া, ইন্টারনেট বেসিক)।  এছাড়া থাকবে ফেসবুক, মাইক্রোসফটের ব্লিং ও রিলায়েন্স অ্যাস্ট্রোলজি। আর বাকি সাইটগুলো? না, সে বিষয়ে জুকারবার্গ অবশ্য বিস্তারিত কিছুই জানাননি। এই প্রকল্পের একটি গালভরা নামও আছে 'জিরো রেটিং স্কিম'। 

ফেসবুকের দাবি এভাবেই নাকি এদেশের যে মানুষরা ইন্টারনেট পরিষেবা থেকে বঞ্চিত তাদের কাছে সহজেই পৌঁছে যাবে এই পরিষেবা।  

এবার একটু বুঝে নেওয়া যাক নেট নিউট্রালিটি কাকে বলে। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের ইণ্টারনেটের সমস্ত ট্রাফিককে একই ভাবে সুবিধাপ্রদান করতে হবে। নেট নিউট্রালিটির মূল বক্তব্য এটাই।  ইন্টারনেট পরিষেবার জন্মলগ্নে 'বাইডিফল্ট' কিন্তু এই নিয়মই চালু ছিল। 

ইন্টারনেট ডট অর্গের সমস্যাটা তাহলে কী? মদ্দাকথায় জুকারবার্গের ইন্টারনেট ডট অর্গ ধ্বংস করছে নেট নিরপেক্ষতা বা নেট নিউট্রালিটি। ক্লিনট্রিপ বা এনডিভি কিন্তু এই কারণেই ইন্টারনেট ডট অর্গের সঙ্গে ছিন্ন করেছে সম্পর্ক। 

ইন্টারনেট ডট অর্গের স্বপক্ষে ঢাক পিটিয়ে জুকারবার্গ কিন্তু বেশ কয়েক কলম লিখে ফেলেছেন। তাঁর দাবি ইন্টারনেট ডট অর্গের মাধ্যমে তাঁরা এ দেশে কমিয়ে দেবেন এদেশে ইন্টারনেট পরিষেবার খরচ। মানুষের মধ্যে বাড়িয়ে তুলবেন ইন্টারনেটের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জ্ঞান। নিজের আর্টিকালে 'অ্যাকসেস' শব্দটি 'মাত্র' ১৪ বার ব্যবহার করেছেন ফেসবুকের সিইও। 

কিন্তু, সেখানেই আসল রহস্যটা বোধহয় লুকিয়ে আছে। ইন্টারনেট ডট অর্গের মাধ্যমে ইন্টারনেট সুবিধার খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে পাওয়া যাবে। পূর্বনির্ধারিত কিছু ওয়েবসাইট ছাড়া ইউসাররা অন্তর্জালের একটা বড় অংশ থেকেই বঞ্চিত থেকে যাবেন। ফলে আসলে ধ্বংস হবে নেট নিউট্রালিটি। 

ফেসবুক হয়ে উঠবে মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের নিয়ন্ত্রক। ইন্টারনেট ডট অর্গ যাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেধেছে সেই রিলায়েন্সের ব্যবসায়িক স্বার্থ নিয়ে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা। প্রাথমিকভাবে 'বিনামূল্যে' পরিষেবার নামে তারা মানুষকে আসতে আসতে নিজেদের উপর নির্ভরশীল করে তুলতে চাইবে। বাড়বে ফেসবুক ইউসারের সংখ্যাও। পাল্লা দিয়ে বাড়বে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার সংখ্যাও। ফলে আখরে কোষাগার ভরবে কার? উত্তরটা বড়ই প্রতীয়মান। 

তবে শুধু, ফেসবুক নয়, ওই একই পথে হেঁটে বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানির সঙ্গে বন্ধন গড়ছে গুগল, টুইটারও। বিনামূল্যে নিজেদের অ্যাপ ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা। বিতর্কিত এয়ারটেল জিরোও কিন্তু জিরো রেটিং স্কিমের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। 

ইতিমধ্যেই, চিলি, স্লোভেনিয়ার মত দেশগুলি নিষিদ্ধ করেছে জিরো রেটিং স্কিল। একই পথে হাঁটতে চলেছে বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশও। 

পৃথিবীতে টেকনোলজির জন্ম ও তার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত। কিন্তু টেকনোলজির জন্য মানুষ নাকি মানুষের জন্য টেকনোলজি। এর জবাব অবশ্যই দ্বিতীয়টা। 

এই মুহূর্তে ইন্টারনেটের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। কিন্তু, অন্তর্জালের মূল লক্ষ্যইতো যে কোনও ধরণের জ্ঞান, খবরের প্রসার বা সম্প্রসারণ। জ্ঞান অর্জনের অধিকার মানুষের জন্মগত। সেই অধিকারকে 'স্বল্পমূল্য', বেশি মূল্যের ধোঁয়াটে জালে সত্যিই কী আবদ্ধ রাখা যায়? নেট নিউট্রালিটির  প্রাথমিক দাবিই তো বিনামূল্যে ইন্টারনেট পরিষেবার অধিকার। সেই অধিকার রক্ষিত হচ্ছে কি আদৌ? নাকি প্রদীপের তলার অন্ধকারে আসলে চাপা পড়ে যাচ্ছে দেশের অধিকাংশটাই। সত্যি সত্যি ডিজিটাল ভারত গড়তে, সত্যি সত্যি ইন্টারনেটের প্রসার ঘটাতে, বদ্ধ হলঘর নয়, প্রয়োজন উন্মুক্ত সীমাহীন আকাশ... 

এবার আশা যাক, অন্য এক প্রশ্নে। ধরুণ আপনার ইচ্ছা হল বিপণীতে যাবে, কেনাকাটা করতে। দুটি রাস্তা আছে। একটি রাস্তা যায় বহুমূল্য বিপণীর দিকে। অন্যটি অনেক কম খরচের অনান্য দোকানপাটের দিকে। আপনাকে বলা হল, দামি বিপণীতে যেতে আপনার খরচ হবে ১০টাকা, আর কম দামিগুলোতে পৌঁছতে ১২টাকা। খরচ কম হওয়ার আনন্দে আপনি পথ ধরলেন দামি বিপণীর। অবহেলা  করলেন কম দামি দোকানগুলি। কীহল ফলাফল? কম খরচে পৌঁছলেন বটে দামী বিপণীতে দরজায়। কিন্তু ভিতরে ঢুকে গচ্চা গেল অনেক অনেক বেশি টাকা। অন্যদিকে, পথের খরচ বাঁচাতে আপনি যে দোকানগুলি অবহেলা করলেন, খদ্দেরের অভাবে শেষপর্যন্ত বন্ধই হয়ে গেল সেগুলি। কর্মহীন হলেন বহু মানুষ। ধরে নিলাম তাতেও আপনার 'বয়েই গেল।' কিন্তু ওই দোকান গুলো বন্ধ হওয়ায় তৈরি হল বড় বিপণীর মনোপলি। এবার ইচ্ছামত তারা দাম বাড়াতে শুরু করলো। আপনিও নিরুপায়। সেখানে যাওয়া ছাড়া গতান্তর নেই। অতএব, দিনের শেষে ঠকলো কে?       

আচ্ছা, মহারাষ্ট্রের যে চাষি দুবেলা দুমুঠো খাবারের অভাবে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন মোবাইলে 'স্বল্পমূল্যের' ইন্টারনেট সার্ভিস তাঁর কোন প্রাথমিক চাহিদাটা মেটাবে? যে ছেলেটি উচ্চশিক্ষা শেষ করেও পরিবারের মুখে দু'বেলা অন্ন জোটেতে ভোর ৭টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাত দশটায় ফিরেও মাসগেলে ৫ হাজারের বেশি কামাতে পারে না, ডিজিটাল ইন্ডিয়া কী তার উপার্জন এক টাকায় বাড়াতে পারবে? যে মেয়েটি নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে দিবারাত্র দশ বাড়ি টিউশনি করে বেড়ায় এই ডিজিটাল ইন্ডিয়া তার ঠিক কী কাছে লাগবে? দেশের যে গ্রামগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার বদলে রোজ মরছে মানুষ ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় সেরে যাবে তাদের অসুখ? অথবা, যে লোকটি কলকাতায় রাস্তায় চা বিক্রি করে বিহারের গ্রামের বড় সংসারকে চালান 'স্বল্পমূল্যের' ইন্টারনেট পরিষেবা কী তাঁর জীবনযাত্রা এক লহমায় পালটে ফেলতে পারবে? পালটে ফেলতে পারবে সেই ভদ্রমহিলার জীবন যিনি ভোর চারটের  লোকাল ট্রেন চেপে কলকাতা আসেন। পাঁচ বাড়ি কাজ করে গবীর রাতে বাড়ি ফেরেন ডিজিটাল ইন্ডিয়া কী তাঁর অক্লান্ত প্ররিশ্রমে খানিকটা লাগাম পড়াতে পারবে? যে শিশুটি ফুটপাতে জন্মায়, ফুটপাতেই যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়, আমলাশোলে খিদের জালায় যারা পিঁপড়ের ডিম খায়, যে কিশোরী ডাস্টবিনে তন্নতন্ন করে খোঁজে, যদি দুটো খাবার মেলে, যে শিশুর পিঠে নিজের ওজনের ভারী বস্তা, ডিজিটাল ইন্ডিয়া কি তাদের দুবেলা গরম ভাতের সন্ধান দিতে পারবে? উত্তরটা এককথায় না। শুধুই না। 

তাহলে কার স্বার্থে এই ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ঘোষণা? সিলিকন ভ্যালিতে যে ভারতের কাহিনী প্রধানমন্ত্রী শুনিয়ে এসেছেন, সেই ভারত বাস করেন কতজন ভারতবাসী? নাকি তারা শুধুই এখন 'না' মানুষ?   

ডিজিটাল ভারতের আগে বোধহয় অনেক অনেক প্রয়োজনীয় দেশের প্রত্যেক মানুষের অন্নসংস্থান আর বাঁচার জন্মগত অধিকার সুরক্ষিত করা। 

প্রধানমন্ত্রীর দাবি যাই হোক না কেন, এখনও পর্যন্ত দেশের যুব সম্প্রদায়ের অধিকাংশই কিন্তু ঐ 'না' মানুষের দলেই পরেন। আর তাদের কিন্তু সত্যিই আইওস, উনডোজ বা অ্যানড্রয়েড নিয়ে বিতর্কে অংশগ্রহণ করার বিলাসিতা করার অবকাশটুকু নেই।

তাই, ডিজিটাল পরিষেবা সত্যি সত্যি বাড়ুক দেশে, কিন্তু তারও বহু আগে, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার আগে, ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার রঙিন হওয়ার আগে, সত্যিকারে রঙিন হোক দেশের আম জনতার জীবন, বেশি নয় বেঁচে থাকুক তারা, দুবেলা অন্তত দুমুঠো গরম ভাতের সন্ধান পাক সবার পাত। 

 

 

 

 

 

.