স্বরূপ দত্ত


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

দেখতে দেখতে আজ ১০টা দিন হয়ে গেল। কীসের? রিও অলিম্পিক শেষের। আসলে তো পুজোর মতোই। আসছে, আসছে বলে কত স্বপ্ন থাকে চোখে। যাঁরা খেলতে আসেন, তাঁরা স্বপ্ন দেখেন জেতার। যাঁরা আয়োজন করেন, তাঁরা স্বপ্ন দেখেন, ভালোয় ভালোয় অলিম্পিককে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার। প্রত্যেক মানুষ আলাদা আলাদা করে স্বপ্ন দেখে অলিম্পিককে ঘিরে। আর তারপর একদিন সব শেষ হয়ে যায়। চারটে বছর পর আসে অন্য অলিম্পিক। কিন্তু পুরনো অলিম্পিকটার খবর কেউ রাখে না। আমাদের নতুনের প্রতি এত আগ্রহ যে, পুরনোকে মনে করার সময় কোথায়?


কদিন ধরে খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম আগের অলিম্পিকগুলোর। আর সেগুলো ঘাঁটতে গিয়ে মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। সিদ্ধান্তে এলাম, আসলে কাজ হয়ে গেলে, ছুঁড়ে ফেলা শুধু আমাদের মানে ভারতীয়দের অভ্যাস নয়। মনের এ সমস্যা সারা বিশ্বের। বহু ক্ষেত্রেই বছরের পর বছর ধরে দেখছি, ব্রিগেডে একটা মিটিং হওয়ার পর ময়দানটার কী হাল হয়! যখন অনুষ্ঠান হয়, তখন সেজে ওঠে চারপাশ। অনুষ্ঠান হয়ে গেলে আর কেউ ফিরেও তাকায় না পাড়িয়ে আসা ঘাসগুলোর দিকে।


জানি না অমন সৃষ্টি করে লাভ কী, যাকে ভালোবাসা যায় না বা যত্ন করে রাখা যায় না! ২০০৮-এ অলিম্পিকের আগে চিন সরকার যেন দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল যে, প্রযুক্তিতে, আড়ম্বরে, আয়োজনে গোটা বিশ্বের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে। দুর্দান্তভাবে তারা বানিয়েছিল অলিম্পিকের মূল স্টেডিয়াম। নকশাটা পাখির বাসার অনুকরণে তৈরি বলে সেই স্টেডিয়ামের নামও তারা দিয়েছিল বার্ড নেস্ট। আজ থেকে আট-ন'বছর আগের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে, এখনও বোধকরি, ঠিক কতটা রোমাঞ্চিত হতাম এগুলো শুনে।


নিজেকে অভাগা ভাবতাম। কারণ, চিনের মানুষরা কী সুন্দর ভেবেছেন। মানুষের সঙ্গে পাখিদের সম্পর্কে চিরকালের। অর্ধেক মানুষই আজও উত্তর দেন, তাঁরা পরের জন্মে মানুষ না হলে পাখি হয়ে জন্মাতে চান। পাখির ওই ডানা দুটো, ওড়ার ক্ষমতা, স্বাধীনচেতা মনোভাব যে, মানুষের বড় ভালোলাগার। ছেলেবেলায় লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত লেখক আলেকজান্দার বোলায়েভ তো পাখির মতো উড়বার জন্য নিজের বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দিয়ে হাতই ভেঙে ফেলেছিলেন! আর লাতিন আমেরিকা থেকে অনেক দূরের আমরা বাঙালিরা তো পাখিঅন্ত প্রাণ। আমাদের বাড়িতে থাকে পাখি। আমরা বাড়ির মেয়ের নাম রাখি পাখি। আমাদের সিরিয়ালের নাম হয় পাখি। আমরা বাবুইয়ের বাসা দেখে হিংসে করি, যদি এমন বাঁসা আমরাও একটু বাঁধতে পারতাম। নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা...সুর ভেসে আসলে আজও আমরা আনমনা হয়ে যাই। রক্তের সম্পর্ক নয়, মনের সম্পর্ক আমাদের পাখির সঙ্গে।


তা সেই পাখির বাসাকে এতটা গুরুত্ব দিল চিন! দেখে-শুনে গর্ব হয়েছিল চিনাদের জন্য। খারাপ লেগেছিল, নিজেরা এমন করতে পারি না বলে। আজ মনে হচ্ছে, আমরা অনেক ভালো। আমাদের তবু মন আছে। চিনারা এগিয়ে অনেক হতে পারে। কিন্তু ওদের সব জিনিসই সৃষ্টি 'ইউজ অ্যান্ড থ্রো' করার জন্য! কারণ, ২০০৮-এ যে বার্ড নেস্ট ঝলমল করত, যে বার্ড নেস্ট গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিত, সেই বার্ড নেস্ট আজ যেন বাংলায় ফিরে এসে পাখির বাসা হয়ে গিয়েছে। অত বড় স্টেডিয়ামটা দেখলে এখন আপনার মনটা খাঁ খাঁ করবে। তাতে আলো নেই। ঢোকার জন্য চারপাশে কালো মসৃণ রাস্তার প্রলেপ আর নেই। যা কিছু আজ আপনি খুঁজবেন, তার সবকটার একটাই উত্তর-আগে ছিল। এখন আর নেই। ছবিদুটো দেখেই নিন না। একটা ২০০৮ এর বার্ড নেস্ট। আরেকটা এখনকার।




হায় রে অলিম্পিক। হায় রে চিন। হায় রে বেজিং। তোমরা শুধু বর্তমানে বাঁচো। ভবিষ্যত পরিকল্পনা করো। তোমরা কখনও পিছনে ফিরে তাকিয়ে সেই দিনগুলোকে মিস করো না। সেই শরীরগুলোতে আর মনটাকে একবারও খোঁজার চেষ্টা করো না। ব্যক্তিগতভাবে বুক পকেট থেকে একটা পুরনো পেন পড়ে গেলেও মনে হয়, বুক থেকে যেন হৃত্পিণ্ডটাই খসে গেল। এই হল আমার মানসিকতা। আমি কোনও ব্যতিক্রমই চরিত্র নই। বাঙালির বেশিরভাগই আজও একটু আবেগপ্রবণ। নষ্টতে আমাদের বড় কষ্ট। আমরা না থাকা মানিয়ে নিতে পারি। কিন্তু থাকা জিনিস চলে গেলে চোখের জল ধরে রাখতে পারি না।


কষ্ট কী তবে আমারই হল? অনেকক্ষণ ভেবে মনে হল-বেজিংয়ের ওই পাখিগুলোর আজ কতটা মন খারাপ! ওদের মস্তিষ্ক থাকলেও তা প্রখর নয় হয়তো আমাদের মতো। কিন্তু ওদের মন নেই আর তাতে কষ্ট হয় না কে বলল? বেজিংয়ের পাখির বাসা আজ তাই খাঁ খাঁ করছে কবরস্থানের মতো। আর তার থেকে অনেকদূরে নিজেদের ভূতুড়ে বাসস্থানের পরিণতি দেখে চোখ ফেলছে পাখিগুলো। আসলে মানুষ ভালো'বাস'তে পারে। কিন্তু পাখির মতো 'ভালোবাসা'তে পারে না।তাই তো কোনও মানুষ আর কেউ পোষে না, দাস করে রাখে! চিনারা বড্ড খারাপ। পাখিগুলো ওদের কখনও ক্ষমা করবে না। কিন্তু ওরা মানুষের মতো এতটা খারাপও নয় যে, মানহানির মামলা করবে।


আরও পড়ুন জেনেই হোক অথবা না জেনেই, নীল আলো শহরে বসানোর জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই মুখ্যমন্ত্রীকে