সুভাষচন্দ্রের সংঘভুক্তি, নেতাজি প্রেমের নেপথ্য
সেই নেহেরুই জাপানের রেনকোজি মন্দিরে গিয়ে ভিজিটর্স বুকে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে একটি বাক্য তো দূর অস্ত, তাঁর নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। তাইহোকুতে নেতাজির মৃত্যু তত্ত্বে বিশ্বাসীদের ধারণা জাপানের রেনকোজি মন্দিরেই রয়েছে নেতাজির চিতাভস্ম ও দেহাবশেষ।
অনির্বাণ সিন্হা
বাংলা দখলে বিজেপির পরবর্তী অস্ত্র নেতাজি-আবেগ।বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২১ অক্টোবর দিনটিকে কার্যত দেশের প্রথম সরকারের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে জন মানসে
প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, মোদী-অমিত শাহ জুটি। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা ভোটের প্রচারেও নেহেরু-গান্ধী পরিবারকে নিশানা করেই আক্রমণ শানিয়েছেন মোদী। নামদার বনাম কামদার-এর সেই মোদী-ন্যারেটিভে ভোট বাক্সে সায় দিয়েছে জনতা। আর এখানেই বাংলা দখলের ব্লু-প্রিন্টে নেতাজি আবেগের মাহাত্ম্য। কে না জানে, বাঙালির আজও বিশ্বাস, স্বাধীন ভারতে কৌশলে কামদার সুভাষচন্দ্রকে সরিয়ে, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে পড়েছিলেন নামদার জওহরলাল।
স্বাধীনতা আন্দোলনের নির্দিষ্ট পর্বে সুভাষচন্দ্র বসু বনাম মহাত্মা গান্ধীর লড়াই, আর তার জেরে কংগ্রেস থেকে শেষমেশ সুভাষচন্দ্রের বিতাড়ন আজও বাঙালি স্মৃতিতে তিক্ত ভাবে জাগরুক। পরবর্তী সময়ে, বিশেষত স্বাধীনতার প্রাক-লগ্নে সুভাষের জন্য মহাত্মার হা-হুতাশ, গান্ধী সম্পর্কে বাঙালির তিক্ততা কিছুটা হলেও কমায়। কিন্তু, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে সংখ্যালঘু হয়ে পড়া সুভাষচন্দ্রকে যেভাবে গান্ধীর দোহাই দিয়ে সংকট কালে ছেড়ে যান জওহরলাল, তা একরকমের বিশ্বাসঘাতকতা বলেই আজও অধিকাংশ বাঙালির কাছে চিহ্নিত। বিশেষত, কংগ্রেসের ভিতরে বামপন্থী বলে তার আগে পর্যন্ত এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হত জওহরলাল-সুভাষের নাম।
কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত হওয়ার আরও বছর খানেক পরে সুভাষচন্দ্রের দেশত্যাগ। তারপর, বিদেশের মাটিতে রাসবিহারী বসু প্রতিষ্ঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নিয়ে সুভাষচন্দ্রের, নেতাজি হয়ে ওঠা... এসবের পরেও তাঁর সঙ্গে নেহেরুর বিরোধের অবসান হয়নি। আজাদ হিন্দ বাহিনীতে মহাত্মা গান্ধী, মৌলনা আজাদ-এর সঙ্গে নেহেরুর নামেও একটি ব্রিগেডের নামকরণ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। অথচ, সেই বাহিনীই যখন ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে লড়তে লড়তে ভারতের উত্তর-পূর্বতম প্রান্তে কোহিমার সীমানায় উত্তোলিত হয়, তখন ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার অজুহাতে খোলা তলোয়ার হাতে তাদের বিরুদ্ধে লাফিয়ে পড়ার আহ্বান জানান জওহরলাল।
স্বাধীন ভারতেও নেহেরুর, সুভাষ বিরোধিতা বজায় ছিল। ভুলাভাই দেশাই ও তেজবাহাদুর সপ্রুর সঙ্গে গায়ে কালো গাউন চাপিয়ে, আইএনএ-র বন্দি সেনাদের মুক্তির দাবিতে জওহরলালের সওয়াল করেন। নেহেরু বিরোধীরা বলেন, সেটা ছিল জওহরলালের স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব ভারতবাসীর, নেতাজির প্রতি আবেগকে আত্মসাত করার কৌশলী চেষ্টা। স্বাধীনতার পরে পরেই সেই কৌশল প্রকাশ পেয়ে যায়। সিঙ্গাপুরে আইএনএ-র ইত্তেফাক-ইতমদ-কুরবানির শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ, যুদ্ধরীতি ও নীতির তোয়াক্কা না করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্রিটিশ সেনার কম্যান্ডার মাউন্টব্যাটেন। স্বাধীন ভারতে তাকেই প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করেন নেহেরু। ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সদস্য ভারতের কাছে ওই ঘটনা নিয়ে আজ অবধি কোনও দুঃখপ্রকাশ করেনি ব্রিটেন।
নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য কিনারায় গঠিত শাহনওয়াজ কমিশনের রিপোর্ট মানেননি তাঁর ভাই, কমিশনের সদস্য, সুরেশচন্দ্র বসু। তবু তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর তত্ত্বেই পরোক্ষে সায় দিয়ে গিয়েছেন প্রথমে নেহেরু, পরে তার পরিবারের সদস্যরা। অথচ, সেই নেহেরুই জাপানের রেনকোজি মন্দিরে গিয়ে ভিজিটর্স বুকে সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে একটি বাক্য তো দূর অস্ত, তাঁর নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। তাইহোকুতে নেতাজির মৃত্যু তত্ত্বে বিশ্বাসীদের ধারণা জাপানের রেনকোজি মন্দিরেই রয়েছে নেতাজির চিতাভস্ম ও দেহাবশেষ।
এই অস্বীকার, অস্বীকৃতির ধারা বংশপরম্পরায় বহমান থেকেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজি ও তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীর অবদান কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও স্বীকৃতিই পায়নি। কেন্দ্রের বিভিন্ন মন্ত্রকের দেরাজে বন্দি নেতাজি সম্পর্কিত ফাইলগুলি পর্যন্ত মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত দিনের আলো দেখতে পায়নি। নেতাজি সম্পর্কিত ফাইল ডি-ক্লাসিফাই করে প্রথম চালটি দিয়েছিলেন মোদী। তারপর গত বছর, আন্দামানে গিয়ে আজাদ হিন্দ সরকার এর প্রতিষ্ঠা দিবস পালন, শহিদ ও স্বরাজ নামে নেতাজির নামকরণ করা দুটি দ্বীপের ভারতের ম্যাপে প্রত্যাবর্তন--বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ে নেতাজি তন্ত্রীতে দোলা দিতে একটু একটু করে এগোচ্ছিলেন সংঘ পরিবারের চোখের মণি। অবশেষে আসতে চলেছে নেতাজিকে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপ। নিঃসন্দেহে বাংলা জয়ে উন্মুখ বিজেপির জন্য মাস্টার স্ট্রোক। কিন্তু, এহ বাহ্য। কেবল গান্ধী-নেহেরু পরিবারকে, কংগ্রেস রাজনীতিকে, ইদানিং কংগ্রেসের স্বাভাবিক মিত্র বামেদের বিড়ম্বনা ও প্রশ্নের মুখে ফেলে তাদের প্রতি আম বাঙালির ক্ষোভকে উসকে দিতেই এই পদক্ষেপ নয়। এখানেও রয়েছে নেতাজিকে আত্মসাত ও ইতিহাস নতুন করে লেখার এক চেষ্টা।
১৯৪৩-এর ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা একটি ঐতিহাসিক সত্য। আরও একটি ঐতিহাসিক সত্য হল, ১৯৫১-র ওই একই দিনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জনসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়। জনসংঘ, অর্থাত্ বর্তমান বিজেপির রাজনৈতিক উত্তরসূরী। নেতাজির মতো এবং নেতাজির পরে সর্বভারতীয় স্তরে সবচেয়ে বিতর্কিত ও বঞ্চিত বাঙালি রাজনীতিক শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুও রহস্যময়। আর সেখানেও জনপ্রিয় বিশ্বাসে, ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত সেই নেহেরু। নেহেরু ও তাঁর 'নামদার' পরিবারের হাতে লাগাতার 'অবহেলিত' 'কামদার' নেতাজি ও শ্যামাপ্রসাদকে, একাসনে বসানোর এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে তা বাংলা জয়ে রাজযোটক যেমন হতে পারে তেমনই ডিভিডেন্ড দেবে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের 'পপুলার' কথনে।
কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর, দেশ ছাড়ার আগে সুভাষচন্দ্রের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক আন্দোলন অক্টারলোনি মনুমেন্ট অপসারণের দাবিতে আন্দোলন। সেই আন্দোলনে যোগ দেননি শ্যামাপ্রসাদ। আবার প্রায় একই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম উপাচার্যের মদতে হিন্দু ছাত্র ও অধ্যাপকদের স্বার্থ এবং সার্বিক ভাবে মুসলিম লিগ শাসনে হিন্দুদের স্বার্থ আহত হওয়ার অভিযোগে আন্দোলনে নামেন শ্যামাপ্রসাদ। ব্যাক্তিগত ভাবে সুভাষচন্দ্রকে বাড়িতে গিয়ে এই আন্দোলনে যোগদানের অনুরোধ জানান তিনি। কিন্তু, সরাসরি সাম্প্রদায়িক কোনও দাবিতে আন্দোলনে নামতে অস্বীকার করেন সুভাষচন্দ্র। হিন্দু মহাসভা সম্পর্কে তাঁর বিরুদ্ধ মনোভাবও ছিল প্রকাশ্য ও সর্বজনবিদিত।
পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা যে দীর্ঘকাল শাসন করেছেন তার রাজনৈতিক ফ্যাক্টরগুলির বাইরে বাঙালি জনতার কেন্দ্র ও বিশেষত কংগ্রেস বিরোধী আবেগ ছিল একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আসলে সেই আবেগ ছিল কংগ্রেস বিরোধী। কারণ,এ রাজ্যে বামেদের শাসনকালের অধিকাংশ সময়, কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস আর তার চালিকাশক্তি ছিল নেহেরু-গান্ধী পরিবার। আজ, ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে বাঙালির সেই চিরাচরিত কংগ্রেস ও নেহেরু-গান্ধী পরিবার বিরোধী আবেগেই আরও একবার বাজি ধরতে চায় বিজেপি ও সংঘ পরিবার। আর কে না জানে সে কাজে বাঙালির দুর্বলতম গ্রন্থি নেতাজি। সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদকেও একাসনে বসানোর সুযোগ। জীবদ্দশায় না-হোক, অমর্ত্যলোকে দু'জনের এই রাজনৈতিক মিলনের কি ফল ফলবে তা তাঁরাই জানেন। তবে মোদী আর বিজেপির নজরে কেবলই মর্ত্যলোকের এই বাঙালি রাজ্য। আপাতত তাই জয়তু নেতাজি।