ঝুমুর দাস


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

কয়েকদিন আগেই মুক্তি পেয়েছে 'গ্রেট গ্র্যান্ড মস্তি'। ছবির পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছে গোটা শহর। শোনা যাচ্ছে, ছবিটি নাকি বিশেষ চলেনি। সিনেমা নিয়ে কথা বলছিলাম আমার সহকর্মী এবং ফ্রেন্ড ফিলোজফার গাইড স্বরূপ দা-র সঙ্গে। তাঁকে কমেডি ছবি নিয়ে জিজ্ঞাসা করায় তিনি যা যা বললেন, তা আগে বলি। তারপর কেন আজ এই প্রসঙ্গে তুললাম তা বলব।


কমেডি ছবি নিয়ে স্বরূপ দা যা বললেন, 'অতিথি তুম কব যাওগে'। আজকের যুগের সিনেমা। নিঃসন্দেহে ভরপুর হাসির সিনেমা। পরিবারের প্রত্যেকের সঙ্গে বসে ছবিটি দেখা যায়। ছবিতে, পরেশ রাওয়াল ছোট্ট বাচ্চাটিকে রাতে শুয়ে শুয়ে গল্প বলছেন। কী গল্প? আমাদের সেই অতিপরিচিত পূরাণের গল্প। কেন সিদ্ধিদাতা গণেশের পুজো অন্য সমস্ত দেবতার পুজো শুরু করার আগে করা হয়, সেই কাহিনিই শোনাচ্ছেন। কাহিনিতে যা শোনা যায়, ভগবান গণেশ এবং কার্তিকের মধ্যে কে বড় তার লড়াই হয়। দেবাদিদেব মহাদেব এবং দেবী পার্বতী বলেন, যে আগে বিশ্বভ্রমণ করে আসতে পারবে, সেই বড় প্রমাণিত হবে। বাবা-মায়ের কথা মতো কার্তিক ময়ূরে চড়ে বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েন। আর গণেশ তাঁর বাবা-মায়ের চারধারে সাত বার ভ্রমণ করেন। কারণ হিসেবে বলেন, তাঁর কাছে বাবা-মা-ই তো পৃথিবী। তাই বাবা-মায়ের চারপাশে ভ্রমণ করা, তাঁর কাছে বিশ্বভ্রমণেরই সমান। তারপর থেকেই ভগবান গণেশের পুজো সমস্ত দেবতার পুজো করার আগে করা হয়। এই কাহিনির মাধ্যমে শুধু ছবিতেই নয়, বাস্তবেও বাবা-মা আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা শেখাতে চেয়েছেন অভিনেতা।


আপনাদের মনে হতে পারে, আজ হঠাত্‌ বাবা-মায়ের গুরুত্ব কিংবা 'অতিথি তুম কব যাওগে' কিংবা কমেডি ছবি নিয়ে পড়লাম কেন? বলছি। তার আগে আরও কয়েকটা কথা বলতে চাই। আমাদের প্রত্যেকের কাছেই বাবা-মা ঈশ্বর। আর ঈশ্বর তো মন্দিরে থাকেন। তাহলে আমার বাবা-মা যে ঘরটিতে থাকেন, সেটাও মন্দির। সেই মন্দিরে এখন অনেক ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্র থাকে। তারই একটা টেলিভিশন। সেই যন্ত্রটির মাধ্যমে আমরা বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে জানতে পারি, দেখতে পারি, গান দেখতে পারি, সিনেমা, বলা ভালো, সব দেখতে পারি। আজকের যুগেরই ছবি 'অতিথি তুম কব যাওগে'। সেখানে শেখানো হচ্ছে বাবা-মা-রূপী ঈশ্বরের গুরুত্ব আর সেই আজকের যুগেরই ছবি 'গ্রেট গ্র্যান্ড মস্তি'। সেখানে খোলাখুলি যৌনতা। দুয়ের কোথাও কোনও মিল নেই!


এবার আসি মূল প্রসঙ্গ অর্থাত্ 'গ্রেট গ্র্যান্ড মস্তি'র বিষয়ে। এটিও আজকের যুগেরই সিনেমা। হাসির সিনেমা। কিন্তু পোস্টার দেখে ছবিটিকে শুধু কমেডি না বলে অ্যাডাল্ট কমেডি বলাই ভালো। অবশ্য এখন তো এটাই চলছে! কমেডি আবার অ্যাডাল্ট! পোস্টার আপনারা সবাই দেখেছেন নিশ্চয়ই? টেলিভিশন চ্যালেনগুলি খুললে এই ছবির গান, ট্রেলর কিংবা বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। যা ওই আগেই বলা মন্দিরে বসে ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা কোনওভাবেই সম্ভব হয় না, এমনই তার পোশাক-আষাক কিংবা অভিনেতাদের বাচনভঙ্গী বা অঙ্গভঙ্গী। এবার আপনার মনে হতে পারে, ২০১৬ সালের তথাকথিত আধুনিক যুগে এমন রক্ষণশীল কথাবার্তা কি সত্যিই গ্রহণযোগ্য? তাহলে নিজেই একবার ভেবে দেখুন, আপনি ছেলে হন কিংবা মেয়ে, এই সমস্ত ছবি যখন সিনেমা হলে গিয়ে দেখছেন, তখন নিশ্চয়ই বাবা-মা-কে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দেখছেন না? সিনেমা হলে ছবিটি যখন মুক্তি পাচ্ছে তখন একরকম। কিন্তু সিনেমা তো আর বছরের পর বছর সিনেমা হলে চলতে পারে না। সেটিকে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পরিচালক এবং প্রযোজক সংস্থাকে টেলিভিশনের দ্বারস্থ হতেই হয়। আর টেলিভিশন এমন একটা মাধ্যম, যার কোনও টার্গেট অডিয়েন্স থাকে না। বাড়িতে একসঙ্গে বিভিন্ন বয়সের মানুষ দেখেন। এবার এই ধরণের সিনেমা যখন টেলিভিশনে দেখানো হয়, তখন তা মোটেই বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্য কিংবা বাড়ির খুদে সদস্যটির সঙ্গে বসে একেবারেই দেখা যায় না।


আমি একটি মেয়ে। এই যুগেরই মেয়ে। স্বাধীনচেতা। আধুনিক নারী। আধুনিক সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলার মতো সমস্ত গুণই আমার মধ্যে রয়েছে। হতে পারি আমি অত্যন্ত আধুনিক নারী। সমাজ আজ যেভাবে নিজেকে মেলে ধরছে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারি। কিন্তু যখন আমি পরিবারের মানুষগুলোর সঙ্গে বসে টিভি দেখি, তখন আমার মধ্যে সেই রক্ষণশীলতা কাজ করে। তাই তো আধুনিক নারী হয়েও আজও যখন সিনেমায় যৌন দৃশ্য দেখানো হয়, তখন আমার ভিতরের রক্ষণশীল নারীটি আমাকে টিভির চ্যানেল বদলে দিতে বাধ্য করে। কোথাও যেন আজও মনে এটা কাজ করে যে, ওই সমস্ত দৃশ্য বাবা-মা কিংবা সন্তানের সঙ্গে বসে দেখা যদি উচিতও হয়, তাহলে জিনিসটা শুরু করব কীভাবে! আমার মনে হয়, এটা শুধু আমার একার মনের কথা নয়। আমার এই বক্তব্যের সঙ্গে নিশ্চয়ই অনেকেই একমত হবেন।


এবার পরিচালক-প্রযোজকদের উদ্দেশ্যে আমার কয়েকটি প্রশ্ন।


১) 'গ্রেট গ্র্যান্ড মস্তি' কিংবা 'মস্তিজাদে' (উদাহরণ হিসেবে) কিংবা এখন কমেডি ছবির তকমা দিয়ে যে সমস্ত অ্যাডাল্ট কমেডি ছবি তৈরি করা হয়, তাতে কি সত্যিই কোনও মজার উপাদান থাকে? নাকি শুধুই যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া, কাতুকুতু দিয়ে জোর করে হাসি উত্‌পাদনের চেষ্টা করা হয়?


২) ছবির নাম দেওয়া হচ্ছে 'গ্রেট গ্র্যান্ড মস্তি' কিংবা 'মস্তিজাদে'। কিন্তু ছবিতে 'মস্তি' আসলে কোথায়? এখন মস্তির মাধ্যম মানেই কি শুধুই যৌনতা?


৩) মানলাম সব ছবির আলাদা আলাদা টার্গেট অডিয়েন্স থাকে। তাহলে, টেলিভিশনে যখন ছবিটি দেখানো হয়, তখন কেন এমন কিছু করা হয় না, যাতে ছবিটি সবাই দেখতে না পারে?


৪) আজকের সমাজ খুবই খারাপ একটা অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রোজ বিভিন্ন জায়গা থেকে ধর্ষণের খবর পাওয়া যাচ্ছে। হাজার শাস্তি দিয়েও এই সংক্রামক রোগ বন্ধ করা যাচ্ছে না, এমনই মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। সেখানে এই ধরণের যৌন উসকানিমূলক ছবি তৈরি করে, বিকৃত মানসিকতাকে আরও খানিকটা কি উসকে দেওয়া হচ্ছে না? ধর্ষণের শিকার সেই সমস্ত মেয়েদের উপর অত্যাচারের খানিকটা দায় যে তাহলে এই ছবিগুলোর উপরও পড়ে যাবে। যদিও আমি বিশ্বাসী, যাই দেখানো হোক, তাতে মানুষ খারাপ কাজ করবে কেন?


৫) বিনোদনের নাম করে কি তরুণ সমাজের চিন্তাভাবনা আপনারা আরও বেশি করে বিকৃত করে দিচ্ছেন না? আপনাদের থেকে আরও একটু সংযম আশা করি।


যৌনতা আগে খুবই গোপন একটি বিষয় ছিল। সবাই এই বিষয়ে সবই জানতেন। কিন্তু এভাবে তা প্রকাশ্য মেলে ধরতেন না। ইন্টারনেট বা এই সমস্ত সিনেমার হাত ধরে আজ তা বড়ই খোলামেলা। ইন্টারনেট আসার পর থেকে আজ আর কিছুই গোপন নেই। হাতে হাতে মোবাইল ফোন কিংবা নিজের ঘরে কম্পিউটার। আর তাতে রয়েছে ইন্টারনেট। যৌনতা এখন আপনার হাতের মুঠোয়। তবুও সেখানে কিছুটা হলেও গোপনীয়তা থাকছিল। আপনার পরিবারের কেউ হয়তো তা দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু এভাবে সিনেমার মাধ্যমে সেই গোপনীয়তাকে এতটা প্রকাশ্য করে দেওয়া কি সত্যিই খুব প্রয়োজন? শেষ করতে চাইলে তো সবই একদিন শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের মনন যে শিখেছে, 'শেষ হইয়াও হইল না শেষ!' তাই আশাতেই থাকলাম। এসব মস্তি-টস্তির শেষে ঠিক একটু 'স্বস্তি' পাবে সমাজটা। আমি।