স্বরূপ দত্ত


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

 


নিজের নাম শুধু সই করতে পারি তা নয়, বাবা-মায়ের অনেক কষ্টের পর এই সমাজে চলতে গেলে যেটুকু ন্যুনতম বিদ্যের প্রয়োজন আছে, সেটা আমার আছে। পাশাপাশি আমি সাবালকও সে অনেক বছর থেকে। সেইজন্যই ২৪ এপ্রিল ২০১৬-র দিনটা তাই কোনওদিন ভুলতে পারব না।না, এই দিনে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেনি। ২৬/১১ কিংবা ৯-১১-র মতো সন্ত্রাসবাদী হামলাও এমন কিছু হয়নি যাতে এই দিনটা মনে রাখতে হবে। তা সত্ত্বেও একজন শিক্ষিত, পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বেদনার, ভয়ের এবং খারাপ লাগার সেরা ছবিটা দেখলাম ২৪ এপ্রিল ২০১৬-তে। তাই লেখাটা লিখতে বসা।



সবার আগে ছবিটা দেখে নিন। হ্যাঁ, রবিবারের ছবি। হয়তো অনেকবার দেখে ফেলেছেন। সেটাই স্বাভাবিক। এটাও জানেন যে, ছবিটিতে যাঁকে দেখা যাচ্ছে, তিনি টি এস ঠাকুর। পুরো নাম তীরথ (তীর্থ) সিং ঠাকুর।বয়স ৬৪ বছর। আর তিনি আমাদের দেশের প্রধান বিচারপতি। এই ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, তিনি বক্তব্য রাখতে রাখতে কেঁদে ফেলেছেন। তাই জনসমক্ষে নিজের চোখদুটো মুছছেন।


নয়াদিল্লির বিজ্ঞান ভবনে রবিবার বক্তব্য রাখছিলেন বিচারপতি ঠাকুর। সেখানে উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রীও। দেশের বিচার ব্যবস্থার পরিকাঠামো এতটাই ভেঙে রয়েছে, সেটাই বোঝাতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু অনেকদিনের বাস্তব ক্ষোভ, দুঃখ, অসবহায়তা, আর্তি, সব যেন এক হয়ে গিয়ে তাঁর চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়েছে মুহূর্তে। জন্মগতভাবে তিনি কাশ্মীরের মানুষ। এ দেশের রাজনৈতিক কারণেই অন্তত এই রাজ্যের মানুষরা বোধহয় একটু বেশিই শক্তপোক্ত হন। তার উপর তিনি আবার প্রধান বিচারপতি। ভঙ্গুর মনের মানুষ, এমন ভেবে নেওয়ার কোনও কারণই নেই। অথচ, সেই লোকটা বিজ্ঞান ভবনে প্রধানমন্ত্রী সহ দেশের অনেক সম্মাণীয় মানুষের মাঝে কেঁদে ফেললেন! ছবিটা দেখে চমকে উঠেছিলাম। সারা রাতেও ভুলতে পারিনি টি এস ঠাকুরের কান্না ভেজা ওই চোখদুটোকে। ভেবেছি, এ কোন দেশে বেঁচে আছি আমি, আমরা! না, নিজে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছি, দেশটা জাহান্নামে চলে গিয়েছে, এমনটা ভাবছি না এখনও। অন্য কাউকে বলারও চেষ্টা করছি না যে, দেশটা রসাতলে চলে গিয়েছে। তবে, একটা জিনিস বুঝি-রোগ হলে বলা ভালো। তাতে ডাক্তার, বদ্যি, ঈশ্বর, পরিবার, পরিজন, শুভাকাঙ্খী কেউ না কেউ অন্তত একটু চিকিত্সা করে সারানোর চেষ্টা করবেন। রোগী সুস্থ হবেন। না, বলে লুকিয়ে রাখলে রোগের প্রকোপ আরও জাঁকিয়ে বসবে। সেই কাজটাই করছি লেখার মাধ্যমে।


প্রধান বিচারপতি যদি দেশের বিচার ব্যবস্থার দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন এক ঘর লোকের সামনে, তা তো ভাবার বিষয়! প্রধান বিচারপতি অসহায় হয়ে কাঁদছেন! এ দেশের ১২৫ কোটি মানুষের তাহলে রাতের অন্ধকারে চোখের জল ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে কী! তাঁর কান্না দেখার জন্য তো প্রধানমন্ত্রীও নেই। সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরাও নেই! তাহলে...! এ কোন পথের দিকে অনেকটা এগিয়ে এসেছি আমরা? এখান থেকে ফেরার পথ কী? আর তা যদি না থাকে, তাহলে পথটা ঠিক কোথায় গিয়ে ফেলবে আমাদের! ভাবনা তালগোল পাঁকানোর জন্য যথেষ্ঠ।


টি এস ঠাকুর পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন, ৪৩৪ শূণ্যপদ রয়েছে! নিয়োগ নেই প্রায় গত তিন দশক ধরে! ভাবুন একবার, বড়রা চিরকাল বলে এলো, সমাজে খারাপের সংখ্যা বাড়ছে। এটাই যদি মেনে নিই, তাহলে? মানে, চোর বেড়েই যাচ্ছে। অথচ, তাঁর বিচার করার জন্য এখনও সেই একই সংখ্যক বিচারক রয়েছেন! কোন বাস্তব বুদ্ধিতে বলবেন যে, ঠিক বিচার মানুষ পাবে! বিচারকও তো মানুষ। তাঁরও তো শিরায় রক্ত বয়। স্নায়ু তাঁকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বার্তা পাঠায়। ২৪ ঘণ্টার দিনে তাঁরও ঘণ্টা পাঁচ-ছয়েক ঘুমোনোর প্রয়োজন হয়। তাঁর কথা অনুযায়ী দেশের সমস্ত আদালতে ৩৮ লক্ষ মামলা পড়ে রয়েছে! হাইকোর্টেই পড়ে রয়েছে ৩৬ লক্ষ মামলা! এ মামলার রায় কবে বেরোবে! কীভাবে বেরোবে! দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১২৫ কোটি। আর বিচারকের সংখ্যা মাত্র ২১ হাজার! প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের মধ্যে অপরাধী কত হতে পারে ভেবে নিন। আর সেটা বিচার করার জন্য বরাদ্দ মাত্র ১৫ জন! মাথা, বিবেক সব ঘেঁটে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ পরিসংখ্যানটা।


এই তথ্যটা দিলে আরও চমকে উঠবেন। এ দেশের একজন বিচারপতি গড়ে ২৬০০ মামলার নিষ্পত্তি করেন! দু হাজার ৬০০ মামলা একাই! তারপরে পেন্ডিং অত! আর আমাদের দেশের নেতারা চিরকাল এগিয়ে যাওয়া দেশের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে বোঝাতে চেষ্টা করেন, ভারত কত এগিয়ে যাচ্ছে। তাই আরও একটা তুলনা টানলাম। আমেরিকায় প্রতি ৮১ জন মানুষ পিছু ১ জন বিচারক। আমাদের দেশে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ পিছু একজন বিচারক! সব রাজনৈতিক দলই সরকারে আসে। আবার চলে যায়। কিন্তু বিচারব্যবস্থার কথা কে ভাববে? মানুষের জীবনে সারা দিনটা যেমন কাটুক, রাতে যে তাঁর ঘুমোনোর আগে নিজেকে নির্দোষ ভেবে ঘুমোতে যাওয়ার দরকার হয়। না হলে কী আর চোখে স্বপ্ন আসে? জানি না, কথাটা কাকে বলতে হয়। কাদের বলতে হয়। কাউকে দোষারোপ করা নয়। বাস্তবটায় মনের ভিতরে কষ্ট হচ্ছে। টি এস ঠাকুর তো কেঁদে ফেললেন। মনটা হালকা হল তাঁর। কিন্তু এ দেশের হাজার হাজার অভিযুক্ত আজও গরাদের ভিতর থেকে সূর্যের এক ফালি আলো দেখে কল্পনা করার চেষ্টা করে, পৃথিবীটা ঠিক কেমন। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা স্বপ্ন দেখে, কোনওদিন নির্দোষ হয়ে ফিরে আসলে আবার একসঙ্গে গোল হয়ে বসে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় শুতে যাবে শুধু ক্লান্ত শরীরটায় চার্জ দেওয়ার জন্য নয়। একটু স্বপ্ন দেখার জন্য। নতুন করে বাঁচার জন্য। টি এস ঠাকুর কিন্তু অশনি সংকেত দিয়ে গেলেন। আমার-আপনার সত্যিই এবার রোগ সারানোর কথা ভাবা উচিত। না হলে আমাদের সন্তানরা যে আমাদের জন্য কোনও ভালো বিচারের বাণী রাখবে না। মান্না দে সেই কবে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তবে কেন পায় না বিচার নিহত গোলাপ...। মানুষটা আর নেই। থাকলে বুঝতেন, মানুষও বিচার পাবে, এমন সম্ভাবনাও যে দিন দিন ক্ষীন হয়ে যাচ্ছে। যাতে আপাতদৃষ্টিতে কারও দোষ হয়তো নেই। শুধু সিস্টেমটা সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটু চাঙ্গা করতে হবে। আমাদের সমাজ, দেশ, আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে গেলে, সবাইকে যে হাতে হাত লাগাতে হবে এবার। ঠাকুরের কান্নাই আমাদের নতুন পথ দেখাক।