সুমন মহাপাত্র: নিজেই নিজেকে বলতেন, “ভাঙা বুদ্ধিজীবী” অর্থাত্ ব্রোকেন ইন্টালেকচুয়াল।  কথা বলতে চাইতেন! নিজের কথা, দেশের কথা- দশের কথা। কিন্তু মানুষ বুঝতে পারেননি। কেউ কেউ বলতেন কী সব বানায়, কোনও ব্যাকারণ নেই! "আরে শালা ও ব্যাকারণ তৈরি করছে।" তাঁর সম্পর্কে এটাই ছিল লেখক নবারুণ ভট্টাচার্যের উক্তি। ভালবেসে সিনেমা করতে আসেননি, এসেছিলেন সিনেমার মাধ্যমে কথা বলতে। "কালকে বা দশ বছর পর যদি সিনেমার থেকে ভাল কোনও মাধ্যম বেরোয়, সিনেমাকে লাথি মেরে সেখানে চলে যাব।" এভাবেই নিজেকে বর্ণনা করেছেন বাংলার ‘ভবা’।  কখনও নীলকন্ঠ, কখনও নীতা সব চরিত্রের নেপথ্যে এভাবেই নিজের স্বল্প জীবদ্দশায় কথা বলে গেছেন ঋত্বিক ঘটক।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ছেলেবেলা থেকেই হাতে কলম তুলে নিয়েছিল ঢাকাই ভবা। "অভিধারা" পত্রিকায় লিখতেন ঋত্বিক। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় নিজের জন্মভিটে ছেড়ে রিফিউজি হতে হয় ঋত্বিককে। বাংলা ভাগের এই ব্যাথাই শান্তিতে থাকতে দেয়নি ঋত্বিক ঘটককে। "ওপারেই আমার দেশের বাড়ি। ওই যে ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে, এত কাছে। অথচ কোনও দিন আমি ওখানে পৌঁছতে পারব না। ওটা বিদেশ..." দেশভাগের কঠোর যন্ত্রণা ধরা পড়েছে তাঁর একের পর এক কাজে। কাউকে এপার বাংলা বলতে শুনলে চেঁচিয়ে উঠতেন, বাংলার আবার এপার-ওপার কী!


অভিনয় করেছেন উৎপল দত্তের "বিসর্জন" নাটকে রঘুপতির চরিত্রে। ১৯৪৮ সালে যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্যে। সে বছরই লেখেন নিজের প্রথম নাটক "কালো সায়োর।"  কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী ঋত্বিক কাজ করেছেন বের্টোল্ট ব্রেশ্টের "দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও" নাটকের অনুবাদ গ্যালিলিও চরিতে। ম্যাক্সিম গোর্কির "দ্য লোয়ার ডেপথস" নাটকের অনুকরণে কাজ করেছেন ‘নীচের মহল’ নাটকে।



দক্ষিণ কলকাতার প্যারাডাইস ক্যাফে, সেখানে মৃণাল সেন, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে আড্ডায় বসতেন ঋত্বিক ঘটক। ঘনঘন চা আর বিড়িতে টান দিতে দিতে ভবা সিদ্ধান্ত নিলেন ছবি বানাবেন। অকাট্য যুক্তি একটাই, থিয়েটারের থেকে বেশি মানুষের মনের কাছে পৌঁছানো যায় ছবির মাধ্যমে। পৌঁছে দেওয়া যায়, না-বলতে পারা কথা।


১৯৫০ সাল, শিয়ালদহ রেল স্টেশনে নিমাই ঘোষের সহকারী পরিচালক হিসেবে "ছিন্নমূল" এর শুটিং করছেন ঋত্বিক। তবে শিয়ালদহ স্টেশন কেন! হবে নাই বা কেন। কঠোর ব্যাথা বুকে এ স্টেশন দিয়েই তো কলকাতায়  প্রবেশ করত শরণার্থীরা। এই সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন ঋত্বিক। পরের বছরই শুরু করেন নিজের প্রথম ছবির কাজ। ছবি করতে তো পয়সা লাগে, কিন্তু পয়সা কই! মাঝপথেই অর্থাভাবে আটকে যায় ঋত্বিকের প্রথম সিনেমা "বেদিনী।" থেমে থাকেননি ঋত্বিক, নতুন গল্প ও চিত্রনাট্য নিয়ে শুরু করেন নতুন ছবি "অরূপ কথা।" সুবর্ণরেখা নদীর তীরে প্রায় ২০ দিন ধরে শুটিং হয়েছিল এই ছবির। কিন্তু বলা হয়নি "অরূপ কথা"। ক্যামেরায় ত্রুটির জন্য প্রকাশ পায়নি এই ছবি। পরের বছরই শুরু করেন "নাগরিক" ছবির কাজ। ভাগ্যের কী পরিহাস! আর্থিক কারণে তখন মুক্তি পায়নি এই ছবিও। পরপর তিনটি ছবি অপ্রকাশিত। হতাশ ঋত্বিক এসময় নিজের ভালবাসার লক্ষ্মী অর্থাৎ সুরমাকে বলেছিলেন, "আমি সুইসাইড করবো।"


১৯৫৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম সিনেমা "অযান্ত্রিক।" নিখুঁত প্রেমের গল্প, তবে মানুষ আর যন্ত্রের প্রেম। বিমলের সঙ্গে জগদ্দলের প্রেম। সুবোধ ঘোষের ছোট গল্প অবলম্বনে তৈরি এই সিনেমায় বিমলের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কালী ব্যানার্জি। ১৯৫৯ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয় এই ছবি। এই ছবি দেখে বিখ্যাত সমালোচক জর্জেস সাডৌল বলেছিলেন, "আমি জানি না অযান্ত্রিক মানে কী? পুরো গল্পটাও বলতে পারবো না কারণ সাবটাইটেল ছিল না। কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রথম থেকে শেষ অবধি দেখলাম।" ট্যাক্সি চালক বিমলের যে চরিত্র নির্মাণ করে গিয়েছিলেন ঋত্বিক, ভবিষ্যতে তার সঙ্গে মিল মেলে "অভিযান" সিনেমার চালক নারা সিংয়ের ও মার্টিন স্করসেসির পরিচালিত "ট্যাক্সি ড্রাইভার" সিনেমার চালক ট্রাভিস বিকেল চরিত্রের। এরপর কাঞ্চনের চোখে এলডোরাডো অর্থাৎ শহর কলকাতা দেখিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। শিবরাম চক্রবর্তীর মূল গল্পের অলম্বনে তৈরি করেন "বাড়ি থেকে পালিয়ে।"



১৯৬০ সালের ১৪ এপ্রিল, আজ থেকে ৬০ বছর আগে আজকের দিনটাই জীবন বদলে দিয়েছিল ক্ষ্যাপা ভবার। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার, মুক্তি পেয়েছিল "মেঘে ঢাকা তারা।" বাংলার এক গরিব মেয়ে নীতার একা লড়াইয়ের গল্প। জানালা দিয়ে আলো, জলে প্রতিফলিত হয়ে নীতার মুখে পড়ছে,  অসম্ভব সুন্দর একটি আবহ সঙ্গীত। সে দৃশ্য ভুলবার নয়। দুর্গারূপী নীতা পরিবারের সকলের বোঝা কাঁধে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে সকলকে এবং নিজেই হয়ে যায় পরিবারের বোঝা। প্রতারণা করে প্রেমিক সনৎ। অবশেষে নীতা চেঁচিয়ে বলে, "দাদা আমি বাঁচতে চাই, দাদা আমি যে বাঁচতে বড় ভালবাসি। দাদা আমি বাঁচবো।" নীতার চরিত্রে সুপ্রিয়া দেবীর অসাধারণ অভিনয় সর্বোপরি ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় এই ছবি বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার একটি মাইলস্টোন। এই ছবিতেই সনতের মুখে ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, "আদর্শ বলে একটা বস্তু হয়, যার জন্য মানুষকে সাফার করতে হয়।" তাঁর জীবনে ব্যাবসায়িক দিক দিয়ে সর্বাধিক সাফল্যও এনে দিয়েছিল এই সিনেমা। এরপর এক এক করে তাঁর পরিচালনায় মুক্তি পেয়েছে দেশভাগের জ্বালা নিয়ে "সুবর্ণরেখা", ভৃগু- অনুসূয়ার প্রেমের সঙ্গে বঙ্গভঙ্গের ব্যাথা জড়িয়ে "কোমল গান্ধার" এবং দুই বাংলার মেলবন্ধনের গল্প "তিতাস একটি নদীর নাম।" সবশেষে নিজেকে  নীলকন্ঠের চরিত্রে এঁকে গেছেন তিনি। মুক্তি পেয়েছে তাঁর আত্মজীবনীমূলক শেষ সিনেমা "যুক্তি তক্বো আর গপ্পো।"



কল্পনায় নিজের চরিত্রদের সঙ্গে কথা বলতেন ঋত্বিক। কখনও বিমল মাষ্টারকে বলতেন, "ও মাষ্টার আমায় পাবনা লয়ে যাবা।" আবার কখনও হরিপদ দাসের কাছে বুলবুল ভাজা চাইতেন। নীতা-সনতকে পাশাপাশি বসিয়ে ঝিকঝিক ট্রেনের আওয়াজে বলতেন না-বলা কথা। কিংবা এই বুদ্ধ বলে উঠতেন,"ভাবো, ভাবো....ভাবা প্র্যাক্টিস করো।" বাঙালি এই কথাটিকে মনে রাখলেও মনে রাখেনি পরের দুটি লাইন যেখানে ঋত্বিক বলছেন, "আমার তো হলো না, তোমরা ভাবলে কাজ হবে।" ঋত্বিকের হলো না নাকি হতে দেওয়া হলো না। ফ্যাতাড়ু অবশ্য বলেছেন ঋত্বিককে হত্যা করা হয়েছে। শত দর্শকের না বুঝতে পারাই ঋত্বিককে অবসাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অবসাদ থেকে বাংলা-চোলাই। নীলকন্ঠের মুখ দিয়ে ঋত্বিক বলেছেন, "দুগ্গা, টাকা থাকবে না কিন্তু কাজ থেকে যাবে। তুমি দেখে নিও মারা যাওয়ার পর সবাই আমাকে বুঝবে।" ভুল বলেননি ঋত্বিক! আজ তাঁর কাজ নিয়ে গবেষণা হয় দেশে বিদেশে। তাঁর সিনেমা মায়েস্ত্রো বিভাগে প্রদর্শিত হয় বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবে। এই ক্ষ্যাপাই বলেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথের কথা অনুযায়ী শিল্প সুন্দর হওয়া প্রয়োজন কিন্তু তারও আগে শিল্প সত্যি হওয়া প্রয়োজন।" তাই বারবার সিনেমাকে মাধ্যম বানিয়ে গর্জে উঠেছেন তিনি।


নিজেই পরিচালক, নিজেই প্রযোজক, নিজেই অভিনেতা। টাকা ছিল না কিন্তু নেশা ছিল হাতে টাকা পেলেই ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যেতেন শুটিংয়ের কাজে। বানিয়েছেন ৮ টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা। অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে একাধিক কাজ। রামকিঙ্কর বেইজ, ছৌ-নৃ্ত্য-সহ কাজ করেছেন একাধিক তথ্যচিত্রে। তাঁর স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবিতে অভিনয় করেছেন সুভাষ ঘাইয়ের মতো অভিনেতারা। লিখে গেছেন একাধিক নাটক।



আদপে ঋত্বিক ঘটক অথৈ সমুদ্র। যে সমুদ্রের ঢেউয়ের কোনও বিরাম নেই, অশেষ জলরাশি। পর্যালোচকরা বলেন ঋত্বিক তাঁর ছবিগুলিতে শেষ দৃশ্যে প্রথম দৃশ্য ফিরিয়ে এনে বৃত্ত সম্পূর্ণ করতেন। কিন্তু সত্যিই কী পরিহাস! নিজের জীবনেরই বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে পারেননি এই শিল্পী। অসম্পূর্ণ থেকে গেছিল "কত অজানারে", "বগলার বঙ্গদর্শন", "রঙের গোলাপ" না জানি আরও কত কী! কেউ কেউ বলেন সময়োপযোগী ছবি বানাননি ঋত্বিক, সময়ের থেকে প্রায় ১০ বছর এগিয়ে ছিলেন। আর তার জন্যই ঋত্বিকের অন্ধকার, অসম্পূর্ণ জায়গাগুলোই দুনিয়ার কাছে আজ আলোচ্য বিষয়। কলমের সবটুকু কালি খরচ করে যেতে পারেননি বলেই তাঁর সমুদ্রসম চিন্তাভাবনার ভাগীদার হতে আজও ঋত্বিক নিয়ে মেতে ওঠেন বিশ্বের বাঘা বাঘা গবেষকরা। অসম্পূর্ণতাতেই সম্পূর্ণ তিনি। কেউ কেউ বলেন, ঋত্বিক যেন অর্ধেক জলের গ্লাস। তাঁর ভরাট এবং শূন্যতা দুই জায়গাই এখন গবেষণার বিষয়। বেড়াজাল না-মানা, কাঁটাতার না-মানা ঋত্বিক এক অন্তহীন সময়।