আট বছরের মহাকাব্যিক উপাখ্যান `গেম অব থ্রোনস`
এমন একটি টেলিভিশন সিরিজ, যার সাউন্ড ট্র্যাকটি পর্যন্ত মানুষ চুপ করে শোনে।
সব্যসাচী চক্রবর্তী
মহাকাব্য কাকে বলে? কী কী শর্তপূরণে মহাকাব্য বা এপিক, এপিক হয়ে ওঠে? সে কঠিন আলোচনা থাক। বরং আমাদের জীবদ্দশায় যে মহাকাব্যটি আট বছর ধরে গড়ে উঠল সেটি নিয়ে নাড়াচাড়া করা ভালো।
আসলে সিনেমা, সিনেমাচিত শর্তের সব অলিগলি ঘুরে মানুষকে যখন ভাব ভাবনাতে আছাড়-পাছাড় করাতে পারে, তখন তাকে এপিক আখ্যা না দিয়ে উপায় থাকে না। সিনেমাটিক এপিকের নিদর্শন কম নেই। কিন্তু একটা টিভি সিরিজ, ৮ বছর ধরে তার নিজস্ব টেনাসিটি ধরে রেখে, গোটা বিশ্বকে একটা আক্ষরিক অর্থেই যখন গ্লোবাল ইমোশনাল হাব বানিয়ে তুলতে সক্ষম হয়, তখন তাকে কুর্নিশ না করে উপায় থাকে না। ওয়েস্টেরস এবং ইসসের মতো একটা উপমহাদেশে ঘোরাফেরা করতে থাকা কাল্পনিক মধ্যযুগীয় গল্পগাথা। তাতে রাজনীতি আছে। হিংসা আছে। যৌনতা আছে। ভালোবাসা আছে। সম্পর্ক কিংবা পরিবারের বুনোট আছে। আছে মৃত্যুর ভয়ালুতা ছাপিয়ে জীবনের চূড়ান্ত প্যাশন। স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো গল্পের মোচড়। এপিসোড শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও, সে ফ্যান্টাসি থেকে রিয়েলিটি ফিরে আসতে সময় লাগে।
এমন একটি টেলিভিশন সিরিজ, যার সাউন্ড ট্র্যাকটি পর্যন্ত মানুষ চুপ করে শোনে। চেলোর গাম্ভীর্যের সে সুরের সূচনার মুহূর্ত হলেও থমকানো যায়। গেম অফ থ্রোনস। আক্ষরিক অর্থেই বিশ্ব টেলি সিরিজের ইতিহাসে জ্বলজ্বলে একটা নাম। মানুষকে ভাবিয়ে, থমকিয়ে, দুমড়িয়ে-মুচড়িয়ে দিতে পারার ক্ষমতাই এর ইউএসপি। যার প্রতিটা চরিত্র ভীষণ ভাবে জ্যান্ত দর্শকদের কাছে। জর্জ রেমন্ড রিচার্ড মার্টিন বা জর্জ আর আর মার্টিনের A Song of Ice and Fire উপন্যাসটিকে বলা হয় আধুনিক যুগের মহাকাব্য। গেম অফ থ্রোনস বা GoT, সেই উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করেই। যদিও পরের দিকে প্রোডাকশান হাউস নিজের মতো করে প্লট বানিয়ে নেন।
গেম অফ থ্রোনস নিয়ে রিসার্চ হয়। গল্পের প্লট এমনই, যে তা নিয়ে আলোচনায় বসেন তাবড় শিক্ষাবিদরা। ২০১৭-এ ব্রিটেনের হার্টফোর্ডশিয়ার ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বসেছিল প্রথম ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমিক গেম অফ থ্রোনস কনফারেন্স। কুড়িরও বেশি রিসার্চ পেপার পড়া হয়েছিল। ভিড় করেছিলেন দেশ-বিদেশের শিক্ষাবিদরা। আর স্বীকৃতি? অঢেল। এখনও পর্যন্ত ৫৯৬টি পুরস্কারের মনোনয়ন এই সিরিজের ঝুলিতে। জয় ৩০৮টি পুরস্কার।
এবার একটু ছোট করে, গল্পের প্লট। দুই উপমহাদেশ। ওয়েস্টেরস আর ইসস। মাঝখানে সমুদ্র। বারো হাজার বছর আগে ওয়েস্টেরসে বাস করত শুধুমাত্র জঙ্গলের বাচ্চারা, Children of the forest. মানুষের মতো দেখতে, কিন্তু তারা ম্যাজিক জানে। এরপর একদিন ইসস থেকে আসে কিছু মানুষ বা First men। তারা সেই জঙ্গলের বাচ্চাদের ওপর শুরু করে অত্যাচার। একদিন এরকমই একজন First men-কে ধরে ফেলে জঙ্গলের বাচ্চারা। ম্যাজিক আর ড্রাগন গ্লাসের মাধ্যমে তাকে বানিয়ে ফেলে নাইট কিং। যে নাইট কিং তাদেরই সুরক্ষা করবে। অথচ সময় যত এগোয়, নাইট কিং উল্টে জঙ্গলের বাচ্চাদের তো শেষ করেই, উল্টে First men-দেরও পাকড়াও করতে থাকে। তৈরি করে নিজস্ব সেনা, হোয়াইট ওয়াকার্স। জম্বির মতো অর্ধমৃত জীব। এরপর চার হাজার বছর আছে First men আর জঙ্গলের বাচ্চারা মিলে নাইট কিং আর তার হোয়াইট ওয়াকার্সদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জিতে যায়। তাদের হাত থেকে বাঁচতে ওয়েস্টেরস আর শীতল উত্তরে তৈরি করে বিশাল বরফের দেওয়াল। এছাড়াও পাহাড়া দিতে দেওয়ালের কাছেই তৈরি হয় তিনটি দূর্গ। তাতে রাখা হয় Knights Watch নামে বিশেষ বাহিনীকে। জঙ্গলের বাচ্চারা অবশ্য উত্তরেই থেকে যায়। এদিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়। সময় এগোয়। ওয়েস্টেরসে অনেক রাজত্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দেওয়াল তৈরির হাজার ছয়েক পর ওয়েস্টেরসে ভেড়ে অন্ডাল গোষ্ঠীর কয়েকজন। First men আর অন্ডালদের মধ্যে মেলামেশা বাড়ে। বিয়ে হয়। জন্ম হয় স্টার্ক গোষ্ঠীর।
অন্যদিকে ইসস থেকে ওয়েস্টেরসে আসে টারগারিয়ানরা। তারা আবার ড্রাগন পোষে। সেটা ধরুন আড়াশো-তিনশো বছর আগে। ততদিনে অবশ্য স্টার্ক ছাড়াও ল্যানিস্টার, মার্টেল, ব্রাথিওনের মতো সাতটি স্বাধীন রাজত্ব গড়ে উঠেছে ওয়েস্টেরসে। টারগারিয়ন বংশের এগন টারগারিয়ন তার ড্রাগনকে নিয়ে সাত রাজত্ব জয় করেন। তৈরি করেন এক হাজার তরোয়াল দিয়ে তৈরি লোহার সিংহাসন। যাকে বলা হয় Iron throne. এই সিংহাসন দখলের লড়াইয়ের খেলাই এই সিরিজের মূল প্লট। সিরিজ অবশ্য শুরু হয় আরও একটু পর থেকে। যখন সিংহাসনের দখল ল্যানিস্টারদের হাতে। গল্প এগোয়ে, ইতিহাস আসে ঘুরেফিরে।
গেম অফ থ্রোনসের গল্পের ভিত্তিই ক্ষমতা আর রাজনীতি। কীভাবে ক্ষমতার লড়াই এক একটি পরিবারকে তছনছ করে। কীভাবে ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া যায়। তার দুর্দান্ত নিদর্শন এই সিরিজে। টিরিয়ন ল্যানিস্টার, সার্সেই, জেমি থেকে শুরু করে জন স্নো, আরিয়া স্টার্ক কিংবা ডেনেইরিস টারগারিয়ান। প্রতিটা চরিত্র এক একটি মহাকাব্যিক চরিত্র। যে চরিত্রে দর্শকরা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েন। কাঁদেন, হাসেন। GoT দর্শকদের আবেগ নিয়ে স্রেফ খেলা করে। গত আট বছর ধরে এই আবেগ নিয়ে খেলাটাইতো তাদের ইউএসপি।
গেম অফ থ্রোনস বা GoT-র বেশ কয়েকটি চরিত্রই বেশ জনপ্রিয়। তবে সবথেকে জনপ্রিয়তম বোধহয় দুটি- জন স্নো এবং ডেনেইরিস টারগারিয়ান বা খালিসি। এরপরেই আসে টিরিয়ন ল্যানিস্টার এবং আরিয়া স্টার্কের নাম। সিরিজে নেকড়ে আর ড্রাগনের ভূমিকাও কম নয়। জন স্নো, যে চরিত্র ডেস্টিনিতে সওয়াল করে। মানুষের হয়ে লড়াইয়ে যে মরে গিয়েও বেঁচে ফেরে। সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে যাকে ফিরিয়ে আনে ভাগ্য। আর সেই ভাগ্যই তাকে রাজ্যপাট থেকে দূরে ফিরিয়ে দেয় মানুষের মাঝে।
ডেনেইরিস টারগারিয়ান বা খালিসি। নারীত্বের আঁকবাঁকের সমস্ত কিছু লেখক তাঁর মধ্যে এঁকেছেন। কষ্ট আর লড়াইয়ের অজস্র রঙ দিয়ে প্রবল ভাবে জ্যান্ত করে তুলেছেন। এক নারীর এ হেন মহাকাব্যিক লড়াই বিরলতম।
আটটি পর্ব নিয়ে গেম অফ থ্রোনসের সিরিজ শেষ হল সম্প্রতি। শেষ পর্বটি পছন্দ হয়নি অনেকের। তাই লক্ষ লক্ষ ফ্যান পিটিশন দাখিল করছে গল্প পাল্টে নতুন ভাবে শেষ সিরিজটি নিয়ে আসার জন্য। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরলতম। আবেগ একাত্মতা কোন পর্যায়ে গেলে এই আবদার সম্ভব!
আগেই বলেছিলাম, চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতার কথা। গোটা বিশ্ব জুড়ে সে একাত্মতার অনেক গল্পই ছড়িয়ে আছে। বরং সে একাত্মতার নমুনা দিই এই শহরেরই একজনকে দিয়ে। পেশায় বাংলা টেলি সিরিয়ালের অভিনেত্রী। গত মার্চে সন্তানহারা হয়েছেন তিনি। মৃত সন্তান প্রসব। সামলে ওঠা কঠিন ছিল। কিন্তু অসম্ভব মনের জোরে সামলেছেন। এই সামলানোর রাস্তায় তাঁর সঙ্গে কে ছিল জানেন? এই গেম অফ থ্রোনসের ডেনেইরিস টারগারিয়ান। ডেনেইরিসও একসময়ে সন্তানহারা হন। স্বামীকে খুন করা হয়। সে কারণে ডেনেইরিসকে বলতে হত, ‘যদি আমি পেছনে ফিরে তাকাই, হারিয়ে যাব’। এক অভিনেত্রীর কাল্পনিক চরিত্র, আরেক অভিনেত্রীকে নতুন করে বাঁচার রসদ জুগিয়েছে। সামনে এগোতে সাহায্য করেছে। এ বাংলার সে অভিনেত্রীর ঘরে রয়েছে ডেনেইরিসের পোস্টার। তাতে ডেনেইরিসেরই একটি কোটেশন, Do you know what kept me standing through all those years in exile? Faith! Not in any Gods, not in myths and legends- in myself. In Daenerys Targaryen.
এটাই গেম অফ থ্রোনস। জীবন যাপনের চলতি ভাবনাকে সে সিরিজ পাল্টে দেয়। রোজকারের নৈতিকতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। ভালো থাকার রসদ জোগায়। খারাপ রেখে, নতুন করে ভাবনার খোরাক দেয়। মহাকাব্যের এও তো এক শর্ত বটে!