Brahmastra: `ভিসুয়াল স্পেক্টাকল` মোনালিসা হলে অয়ন মুখোপাধ্যায় ভিঞ্চি!
ফ্যান্টাসি সিরিজের নামেই ডিসি-মার্ভেলের ছবি দেখতে ভারতীয় দর্শকরা হল ভরান, তাহলে অয়নের এই ছবি দেখতে মানুষ হলমুখী হবেন তা বলাই যায়। হলিউডের সঙ্গে তুলনা নয়, তবে বলিউডের হলিউড হয়ে ওঠার প্রয়াস কুর্নিশযোগ্য।
শুভপম সাহা: 'ওয়েক আপ সিড' (Wake Up Sid), সাল ২০০৯। বাঙালি ছেলে অয়ন মুখোপাধ্যায়ের (Ayan Mukerji) প্রথম বলিউড ছবি। নতুন পরিচালক বার্তা দিয়ে রাখলেন যে, ভারতীয় ছবির আকাশে, নক্ষত্রখচিত পরিচালকদের মধ্যে আগামীতে তাঁর নামও জুড়তে পারে! নতুন নক্ষত্র জন্ম নিয়েছে। কাপুর পরিবারের 'চিরাগ' রণবীর কাপুরকে (Ranbir Kapoor) নিয়ে অভিষেকেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ছিলেন অয়ন। দর্শকের মনের সঙ্গেই জিতেছিলেন 'ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ডেবিউ ডিরেক্টর' (Filmfare Award for Best Debut Director)। পান স্ক্রিন ও স্টারডাস্ট অ্যাওয়ার্ডস। চার বছর পর ফের ক্রিজে এসেছিলেন অয়ন। নন-স্ট্রাইকার এন্ডে ফের তাঁর 'লাকি চার্ম' রণবীর। বানালেন 'ইয়ে জাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি' (Yeh Jawaani Hai Deewani)। দেশের ইউথ জেনারেশন অয়নকে বলে দিলেন 'আপনি থাকছেন স্যার'! বিগত ৯ বছর এই সিনেমা নিয়ে বিভিন্ন সময় চর্চা হয়েছে। কাট টু ২০২২। কমেডি ড্রামা ও রোম্যান্টিক কমেডির ঘর ছেড়ে অয়ন একেবারে ঢুকে পড়লেন ফ্যান্টাসি অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চারে। প্রায় ছ'বছর নিজের ড্রিম প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করার পর অবশেষে অয়ন ভারতীয় সিনেমায় নিক্ষেপ করলেন মৌলিক 'ব্রহ্মাস্ত্র' (Brahmastra)! সিরিজের প্রথম ছবি 'ব্রহ্মাস্ত্র পার্ট ওয়ান: শিবা' (Brahmastra Part One: Shiva) মুক্তি পেল গত শুক্রবার। সোশ্যাল মিডিয়ায় যাঁরা মোটামুটি নিয়মিত, তাঁরা 'ব্রহ্মাস্ত্র'-এর ক্রেজ ট্রেলার রিলিজের পরেই বুঝে গিয়েছিলেন। ভীষণ ভাবে আলোচনায় ছিল, যে, অয়ন হতাশ করবেনই না। হয়ে যাক 'ফার্স্ট-ডে, ফার্স্ট-শো'।
একশো-দুশো, এমনকী তিনশো কোটিও নয়, একেবারে ৪১০ কোটি টাকা! যে ছবির জন্য় এই পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ করা হয়, সেই ছবির ওপর প্রত্যাশার পারদ মহাকাশচুম্বী নয়, একেবারে অন্তরীক্ষস্পর্শী হয়। এখন প্রশ্ন কী করলেন অয়ন? এমনটাও বলা যেতে পারে যে, তিনি ঠিক কী কী করলেন না! 'ব্রহ্মাস্ত্র'-র প্রথম অস্ত্রই ভিএফএক্স ওরফে স্পেশ্যাল এফেক্টস। দক্ষিণী ছবির ভিএফএক্স যেখানে বলিউডের ছবিকে বছরের পর বছর বলে বলে গোল দিয়েছে, অয়নের 'ব্রহ্মাস্ত্র' কিন্তু একবার নয়, একশবার ভাবাবে দক্ষিণ ভারতের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকেও। গোটা ছবিতে ভিএফএক্স-এর কাজ এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরাতে দেবে না। দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে। চেনা সিনেমা হল বদলে যাবে কোনও প্ল্যানেটেরিয়ামে। চোখের সামনে কসমিক ইউনিভার্স। 'ভিসুয়াল স্পেক্টাকল' মোনালিসা হলে অয়ন ভিঞ্চি। এই কাজ 'আন্তর্জাতিক মানের' নয়, আন্তর্জাতিকই। ফেলে দিতে হবে মান শব্দটি। কারণ করণ জোহরে প্রযোজক সংস্থা 'ব্রহ্মাস্ত্র'-এর জন্য হাত ধরেছিল ইন্দো-ব্রিটিশ ভিএফএক্স সংস্থা ডিএনইজি-র। যাঁদের ঝুলিতে রয়েছে সাতটি অস্কারজয়ী সিনেমা। ডিএনইজি-র ক্লায়েন্ট ফক্স স্টুডিও এবং ডিজনি। ক্রিস্টোফার নোলানও এই সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন। মুম্বইয়ের প্রাইম ফোকাস লিমিটেড (ভিডিয়ো পোস্ট প্রোডাকশন কোম্পানি) ও ডিএনইজি-র যুগলবন্দি ভিএফএক্সকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে তা বলিডউ এর আগে কখনও দেখেনি। চোখে চমক লাগবে আরামের আশকারায়।
এবার আসা যাক প্লটের কথায়। ফ্যান্টাসি, ভারতীয় পুরাণ ও দর্শন। অবশ্যই এর সঙ্গে মিশেছে অয়নের প্রিয় সাবজেক্ট রোম্যান্স। এক ভয়ংকর ককটেল! এখানে দেখানো হয়েছে সৃষ্টির আদিকালে ব্রহ্মশক্তি থেকে তৈরি হওয়া একাধিক সব মারাত্মক অস্ত্র- বানরাস্ত্র, পবনাস্ত্র, কবজাস্ত্র, মায়াস্ত্র, নন্দী অস্ত্র এবং অগ্নি অস্ত্র! যুগের পর যুগ ধরে এই সব শক্তিশালী অস্ত্র রক্ষা করে আসছে রক্তমাংসেরই কিছু সাধারণ মানুষ। তারা সকলেই এই ব্রহ্মাংশের অধিকারী। এই সব অতিপ্রাকৃতিক অস্ত্রের অধিকারী যারা, তারা প্রত্যেকেই একেকজন সুপারপাওয়ারের অধিপতি। কলি যুগে ব্রহ্মাংশের বর্তমান গুরু অমিতাভ বচ্চন। 'ব্রহ্মাস্ত্র' সকল অস্ত্রের সেরা। যে এই অস্ত্রগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। সর্বশক্তিশালী 'ব্রহ্মাস্ত্র'-এর অধিকারী হওয়ার জন্যই সিনেমা জুড়ে ধুন্ধুমার। মারকাটারি লড়াই। 'ব্রহ্মাস্ত্র' তিনটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এর একটি খণ্ড রয়েছে ব্রহ্মদেবের একনিষ্ঠ উপাসক জুনুন-এর কাছে। এই চরিত্রে বাংলার মৌনী রায়। জুনুনের জীবনে একটাই লক্ষ্য। 'ব্রহ্মাস্ত্র'-এর বাকি দু'টি টুকরো জড়ো করে 'ব্রহ্মাস্ত্র'-এর অধিকারী হওয়া এবং তা ব্রহ্মদেবকে ফিরিয়ে দেওয়া, বলা ভাল তাকে জাগিয়ে তোলা। জুনুন তার জন্য যে কোনও কিছু করতে পারে। জুনুন 'ব্রহ্মাস্ত্র' পাওয়ার জন্য নিজের মতো তিন সদস্যের দল বানিয়েছে। তাদের একটাই মিশন 'ব্রহ্মাস্ত্র' পুর্নগঠন। এর জন্য সবার আগে 'ব্রহ্মাস্ত্র'-এর বাকি দু'টি টুকরো যাদের কাছে আছে, তাদের খুঁজে বের করে, তাদের থেকে হাতিয়ে নেওয়া।
অভিনয়ের কথায় আসা যাক। রণলিয়া (রণবীর ও আলিয়া) জুটি এই মুহূর্তে দেশের অন্যতম প্রিয় পাওয়ারকাপল। রিল এবং রিয়াল লাইফে তাঁদের এক সঙ্গে দেখতে যে ভীষণই সুন্দর লাগে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুয়ের অভিনয় ক্ষমতাও বহুবার পরীক্ষিত এবং প্রশংসিত। তবে এই ছবিতে যেভাবে গল্প বলা হয়েছে, সেখানে গল্পটিই প্রধান চরিত্র। বাকিরা চরিত্রের জন্য। দেখতে গেলে রণবীর-আলিয়ার অভিনয়ের সেই সুযোগ ছিল না। যেহেতু রণবীরকে ঘিরে গল্প আবর্তিত হয়েছে, সেহেতু রণবীরের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। সিনেমায় রণবীরের মা-বাবা মারা গিয়েছেন ছোটবেলায়। সে অনাথ। পরে রণবীর বুঝতে পারেন যে, সে বাকিদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা, কারণ আগুন তাঁকে ছুঁতে পারে না। এমনকী সে নিজেই আগুন-অস্ত্র! তবে রণবীর ওরফে শিবা খানিক পরগাছা সুপারপাওয়ারধারী। শিবার সঙ্গে তাঁর প্রেমিকা ঈশা (আলিয়া) থাকলেই তিনি জ্বলে উঠতে পারেন। নচেত না! মানে প্রেমের দেশলাইয়ে শিবার আগুন জ্বলে! যদিও বাকি অস্ত্রধারীরা নিজের ইচ্ছায় জ্বলে উঠতে পারেন। রণবীর পারেন না। যেহেতু অয়নের প্রিয় বিষয় রোম্যান্স, সেহেতু ফ্যান্টাসি অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চারেও অয়ন প্রেম-ভালবাসাকে ঢুকিয়েছেন। তবে এই রোম্য়ান্স কোথাও খাপছাড়া লেগেছে, সত্যি বলতে রণবীর-আলিয়ার প্রেম এখানে বেমানানই ঠেকিয়েছে। মনে হয়েছে প্রেমকে বিশেষ অতিথি করে আনা হয়েছে, কিন্তু তার জন্য কোনও যথাযথ আসনের বন্দোবস্ত করা হয়নি। বাস্তবে থেকে ফ্ল্যাশব্যাকে ফেরার ট্রান্জিশনও মাঝে মধ্যে ঝাঁকুনি দেবে। অয়নের ছবিতে গান আলাদা জায়গা করে নেয়। হিট গানের ঝুলি উপচে দেন তিনি। এখানেও অরিজিৎ সিংয়ের গলায় ‘কেশরিয়া’ আর ‘দেবা দেবা’ অসাধারণ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গানের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হয়েছে। যা তাল কেটেছে।
শাহরুখ খান, নাগার্জুন এবং ডিম্পল কাপাডিয়া ছোট্ট ক্যামিওতে যথাযথ। অতিথী শিল্পীরাও স্টার মার্কস পেয়েছে। অভিনয়ের কথা আলাদা করে বলতে গেলে বলতেই হবে মৌনীর কথাও। বঙ্গতনয়া টেলিভিশনের জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘নাগিন’ করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁর মধ্যে খলনায়িকা হয়ে ওঠার গুণও আছে। তবে 'ব্রহ্মাস্ত্র'-এ অয়নের মাস্টারস্ট্রোক মৌনী। নিঃসন্দেহে জুনুন তাঁর ভিতরের আগুন দেখিয়েছেন। 'ব্রহ্মাস্ত্র'-এ অয়ন ইচ্ছা করেই কিছু প্রশ্ন রেখে দিয়েছেন। দ্বিতীয় পর্ব 'দেব'-এর জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। কারণ শিবা যে, আগুনাস্ত্রের অধিকারী হয়েছেন, তা কী তিনি ব্রহ্মদেবের থেকেই পেয়েছেন? কারণ আগুনের অধীশ্বর ব্রহ্মদেবই। তাহলে শিবা কি ব্রহ্মদেবেরই সন্তান? ব্রহ্মদেবের সঙ্গে শিবার মার (দিপীকা পাড়ুকোন, যাঁকে কয়েক সেকেন্ডের ) সম্পর্কের রয়ায়ন ঠিক কী ছিল, কেন হয়েছিল এই পরিণয়। ব্রহ্মদেবের ভূমিকায় রণবীর সিংকে দেখা যাবে বলেই কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, উত্তর হয়তো মিলবে কিছুদিন পর। তবে অয়নকে শুধু তাঁর প্রচেষ্টার জন্য দশে অন্নত নয় দেওয়াই যায়। কারণ এমন সাহস দেখানোর সাহস তিনি দেখিয়েছেন। নিজের ঘরানা ছেড়ে বেরিয়ে নতুন ঘরানায় ঢুকেছেন। অবাস্তব ও অতিবাস্তব ছবি ভারতীয় দর্শকদের মন আলাদা জায়গা করে নেয়। ফ্যান্টাসি সিরিজের নামেই ডিসি-মার্ভেলের ছবি দেখতে ভারতীয় দর্শকরা হল ভরান, তাহলে অয়নের এই ছবি দেখতে মানুষ হলমুখী হবেন তা আশা করা যায়। হলিউডের সঙ্গে তুলনা নয়, তবে বলিউডের হলিউড হয়ে ওঠার প্রয়াস কুর্নিশযোগ্য। প্রথম দিনের বক্সঅফিস রিপোর্ট করণ জোহর ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করেছেন, তিনি বলেছেন যে, এই ছবি প্রথম দিনেই বিশ্ববাজারে ৭৫ কোটি টাকা ঘরে তুলেছে। সাতদিনের মধ্যে কিন্তু ছবিটা আরও পরিস্কার হয়ে যাবে। মাস্টারপিস কিনা তা হয়তো সময় বলবে, তবে আ পিস টু রিমেম্বার বলা যায় নিঃসন্দেহে।