সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

‘Where were you so long?' she asked, and more/ With her bird's-nest eyes, Banalata Sen of Natore'-- বোঝাই যাচ্ছে জীবনানন্দের বিখ্যাত কবিতা 'বনলতা সেন'। কিন্তু ইংরেজিতে। স্বয়ং কবিরই অনুবাদ? নাকি অন্য কোনও কবি বা কাব্য-সমালোচক বা কাব্যানুবাদকের? সহজ প্রশ্নগুলি ভিড় করা স্বাভাবিক। কিন্তু উত্তর হয়তো অজানাই। কেননা, এ চরণগুলির অনুবাদক এমন একজন মানুষ যিনি মূলত ফিল্মজগতের।


'ফিল্মজগতের' শব্দটাতে হেঁয়ালি না কমে বরং বাড়ল। কেননা 'চিদানন্দ দাশগুপ্ত' এই নামটিকে বাঙালি চট করে ফিল্মজগতের সঙ্গেই-বা জোড়ে কী করে! কথাটায় সারবত্তা আছে। ইনি কি অভিনয় করেছেন, না ছবি বানিয়েছেন? না, অভিনয় ইনি করেননি, তবে ছবি বানিয়েছেন, ছবির সঙ্গীতও করেছেন। কিন্তু তাঁর সব চেয়ে বড় পরিচয়-- তিনি ফিল্ম-সমালোচক, ফিল্ম-তাত্ত্বিক, ফিল্ম-হিস্টোরিয়ান, চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত গদ্যের রচয়িতা। এ বিষয়ে এ দেশে তিনি প্রায়-পথিকৃৎ এবং সেটা করেছেন একেবারে আন্তর্জাতিক মানে। আন্তর্জাতিক মানের ফিল্মপত্রিকা 'সাইট অ্যান্ড সাউন্ড'-য়ে দিনের পর দিন তাঁর লেখা বেরিয়েছে।


এ হেন গুণী মানুষটির শতবর্ষ চলছে। ১৯২১ সালের ২০ নভেম্বর শিলংয়ে জন্ম চিদানন্দ দাশগুপ্তের। পেশাগত জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে শিক্ষকতায়। কলকাতার সিটি কলেজে আর হাজারিবাগে। এক সময়ে 'ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিস্টিকসে' প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের সান্নিধ্যেও কাজ করেছেন। আবার বিজ্ঞাপনী জগৎও টেনেছিল তাঁকে। ক্রমে সেখান থেকেই ফিল্মমুখী যাত্রা। সত্যজিৎ রায়, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্তের সঙ্গে ১৯৪৭ সালে 'ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি' প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়, বিজয়া ম্যুলে প্রমুখের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন 'ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটি'।


তৈরি করেছেন কয়েকটি তথ্যচিত্র ও ছবি। এর মধ্যে 'পোর্ট্রটে অব আ সিটি', 'ডান্স অফ লর্ড শিবা' উল্লেখযোগ্য। ১৯৭২ সালের 'বিলেত ফেরত' আর ১৯৯৬ সালের 'আমোদিনী' তাঁর মনে রাখার মতো কাজ। কন্যা অপর্ণা সেনের 'সতী' ছবির সঙ্গীতের দায়িত্বও সামলেছেন।


তবে এ সবের সঙ্গেই নিরন্তর চালিয়ে গিয়েছেন ফিল্ম-সংক্রান্ত লেখালেখি। সিনেমা নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনা, ভারতীয় ও বিশ্ব চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব-সহ আরও নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন নিয়মিত। সিনেমাবিষয়ক লেখালেখির একটা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তাঁর ও সত্যজিৎ রায়ের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় 'ইন্ডিয়ান ফিল্ম কোয়ার্টার্লি'। তবে শুধু পত্রিকাতেই লেখেননি, বইও লিখেছেন। তাঁর 'বই নয়, ছবি' খুবই উল্লেখযোগ্য বই। এ ছাড়াও 'টকিং অ্যাবাউট ফিল্মস', 'সিয়িং ইজ বিলিভিং', 'সিনেমা অফ সত্যজিৎ রায়'ও তাঁর কলম থেকে বেরনো মনে রাখার মতো কাজ। শেষতম বইটি তো সত্যজিতের ছবির সমাজ ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে লেখা অন্যতম সেরা বই হিসেবে স্বীকৃত।


তবে এখানেই লেখক চিদানন্দের কৃতির শেষ নয়। একদা চিন্দানন্দ-সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দলহরী তুলেছিল জীবনানন্দের কবিতাও। অনুবাদ করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাও।


তাই নিছক চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র সমালোচক, চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদ ইত্যাদি কেজো তকমার মধ্যে দিয়ে চিদানন্দের মতো এক মননশীল ব্যক্তিত্বের সম্যক পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। ফিল্মের শিল্পিত সংবেদন থেকে কবিতার দীপিত দহনে তাঁর অনায়াসযাত্রা। আর এই বর্ণিলতাই তাঁকে এক বিরল বাঙালিতে পরিণত করেছে। যে-বাঙালির সংখ্য়া ইদানীং ক্রমশ কমছে; যে-গোত্রের বাঙালির লেগ্যাসি আর একালে কেউ সেভাবে বহন করে না; যে-বাঙালির আবেগকম্পিত মন একদা তুঙ্গস্পর্শী মননকে সঙ্গে নিয়ে একাকী পথ হাঁটতে পারত!