`তাসের ঘর`-এ সুজাতা আর স্বস্তিকা কতটা এক, নাকি অমিলই বেশি? খোলামেলা আড্ডায় স্বস্তিকা
রণিতা গোস্বামী
রণিতা গোস্বামী
লকডাউনের মধ্যে 'দিল বেচারা'তে শেষবার দেখা গিয়েছিল। কিজি বসুর মা স্বস্তিকা এখন 'তাসের ঘর' এর সুজাতা। গৃহবধূ। আবারও অন্যরকম ভূমিকায় নজর কাড়তে চলেছেন অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। তবে 'তাসের ঘর'-এর পোস্টার মুক্তি পাওয়ার পরই সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোলিংয়ের শিকারও হতে হয়েছে তাঁকে। সবকিছু নিয়েই Zee 24 ঘণ্টা ডট কমের সঙ্গে কথা বললেন 'সুজাতা' স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। 'তাসের ঘর'-এর প্রসঙ্গ ধরেই উঠে এল স্বস্তিকাকে নিয়ে আরও অনেক অজানা কথা।
তোমাকে এবার 'তাসের ঘর'-এ সুজাতার চরিত্রে দেখবো, 'সুজাতা' আর 'স্বস্তিকা' দুটি চরিত্রের মধ্যে কতটা মিল বা অমিল?
স্বস্তিকা : অমিলই বেশি গো। মিল খুবই কম। (হালকা হাসি) সুজাতা খুবই একা থাকতে ভালোভাসে। লোকজনের সঙ্গে কথা না বলেও দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে। স্বস্তিকা একেবারেই তেমনটা নয়। একা থাকাটা আমার কাছে অত্যাচার। যদিও জীবনটা এমন হয়ে গেছে, যে একা থাকা ছাড়া উপায়ও নেই। দ্বিতীয় অমিল, সুজাতার রান্নাবান্না করাটা ভীষণ পছন্দের। ও রান্না নিয়েই থাকতে পারলে বেঁচে যায়। আর আমি লকডাউনে চাপে পড়ে রান্নাটা করেছি, নচেৎ রান্না ঘরে ঢুকতেও চাই না। আর একটা সাংঘাতিক অমিল হল সুজাতা খুবই লম্বা চুল ভালোবাসে, লকডাউনের বাজারেও তেল, শ্যাম্পু সব দিয়ে চুলটাকে খুব সুন্দর করে রেখেছে। আর আমি তো পারলে ন্যাড়া হয়ে যাই। (হাসতে হাসতে)
আর মিলও আছে দুটো জায়গায়। সুজাতা সবকিছুর গন্ধ শোঁকে। গন্ধের প্রতি ওর একটা টান আছে। আর আমার গন্ধ নিয়ে বাতিক আছে। (বলেই হেসে ফেললেন) কেউ খেতে দিলে আমি প্লেট, চামচ, কাপ, সব শুঁকে নি। যদি আমি প্রচুর লোকের মধ্যেও থাকি, তাহলেও কায়দা করে এটা ঠিক করে নি। আমার সঙ্গে যাঁরা সবথেকে বেশি সময় কাটায়, সেই হেয়ার ড্রেসার, মেকআপ আর্টিস্ট, ওরা জানেন। অনেক জায়গায় খাবারটা নিয়ে আমি ওদের দিকে তাকাই, তার উত্তরে ওরা বলে, শুঁকে নিয়েছি দিদি, গন্ধ নেই (হাসতে হাসতে)। আমার আঁশটে গন্ধের বড় বাতিক। যে কারণে আমি ডিম ছুঁইও না। মাছ, মাংস খাই, তবে পিস নিয়ে আমরা প্রচুর স্পেসিফিকেশন আছে। মাছের আমি একরকম পিসই খাই, ওই তিনকোণা গাদার পিস। ইলিশ মাছেরও আমি শুধু আংটি পিসই খাই। চিকেন, মটনের ক্ষেত্রেও চৌকো মতো সলিড পিস পছন্দ। (হাসি) এসব ঝামেলার জন্য নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও গেলে মাছ, মাংস খেতে চাই না। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বিয়ে বাড়িতে গেলে মা আমার পছন্দের পিসটাই তুলে আনত, এখন তো আর সেটা সম্ভব হয় না। তার থেকে আমার না যাওয়া কিংবা না খাওয়াই ভালো।
যাইহোক, সুজাতার সঙ্গে স্বস্তিকার অবশ্য আরও একটা মিল আছে। সুজাতা খুবই রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালোবাসে, গায়। রবি ঠাকুর সুজাতা আর স্বস্তিকাকে মিলিয়ে দিয়েছে বলতে পারো।
'তাসের ঘর', নাম ও ট্রেলার দেখে মনে হচ্ছে এটা একটা অসুখী সংসারের গল্প, এই অসুখী সংসারের জন্য সুজাতা কতটা দায়ী, নাকি ও শিকার?
স্বস্তিকা : (একটু ভেবে) আসলে একটা সংসার দুজন মানুষ, দুটো পরিবারকে নিয়ে হয়। সম্পর্ক যদি অপ্রিয় হয়ে যায়, সেখানে দুজন মানুষেরই পারা, না পারা থাকে। আসলে কখনও People fall out of love। ভালোবাসার জায়গাটা নড়বড়ে হয়ে যায়। আমরা তো কত বাড়িতেই দেখি, ভালোবাসা নেই, শুধু অভ্যাসের দায়ে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থেকে গেছে। মানুষ আসলে অভ্যাসের দাস। ভালোবাসা নেই, বউয়ের সঙ্গে তিক্ততা। বাইরে একটা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কও রয়েছে। কিন্তু ওই আবার ডিভোর্স, একটা সংসার থেকে বের হয়ে অন্য সংসারে গিয়ে নতুন করে শুরু করা। এই খাটনিটা অনেকেই খাটতে চান না। সবসময় একটা সম্পর্ক খারাপ হওয়ার জন্য সম্পূর্ন একজনকেই দায়ী করা যায় না। সুজাতার ক্ষেত্রে ওর বরের কতটা দায়িত্ববোধ সেটা ছবিটা মুক্তি পেলেই দেখতে পাবে। আসলে ৪ দেওয়ালের মধ্যে ঠিক কী ঘটে সেটা সবসময় বাইরে আসে না। বাইরের লোকেরা ধারাণা করে মাত্র। আসলেই কী হয়েছে, সেটা শুধুই ওই দুটো মানুষ জানে।
আরও পড়ুন-''যা উঠে আসছে তাতে আত্মহত্যা বলে মনে হচ্ছে না'', সুশান্ত মৃত্যু নিয়ে বললেন স্বস্তিকা
তুমি তো পরিচালক সুদীপ্ত রায়ের সঙ্গে এটা ৩ নম্বর কাজ করলে, এর পরেও কি ওনার সঙ্গে কাজ করতে চাইবে?
স্বস্তিকা : হ্যাঁ, নিশ্চয় , সবসময়ই চাইব (হাসি)। আমার খুবই পছন্দের একজন পরিচালক। আমাদের টিউনিংটা খুব ভালো।
চুল কাটা নিয়ে বললে তোমার আর 'সুজাতা'র পার্থক্য, এই যে লোকজন তোমায় চুল কাটা নিয়ে ট্রোল করছে এটাকে কী বলবে?
স্বস্তিকা : যারা বলছে বলছে, আমার মাথা, আমার চুল, আমি যা খুশি করবো। লোকে কী বলল, তা নিয়ে কি আর বাঁচা যায়! নাকি বাঁচা উচিত? বলতেও ট্যাক্স লাগে, না, লিখতেও ট্যাক্স লাগে না। এখন যদি সরকার ট্যাক্স বসিয়ে দেয়, তাহলে দেখবে এটা বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষের সবকিছু নিয়ে এত সমস্যা, এত বক্তব্য। বাক স্বাধীনতা রয়েছে, যে যা পারে বলবে। আমি ৪টে চুল রাখবো, ন্যাড়া হবো, নাকি বেনী ঝোলাব। তা নিয়ে কারোর মাথা ব্যাথার দরকার নেই (উত্তেজিত হয়ে)। তবে হ্যাঁ, কথা উঠলে, যেটার জবাব দেওয়ার আমি দেবোই। হতে পারে, শ্যুটিংয়ের পর আমার সামনে যেটুকু চুল আছে ওটাও কেটে ফেলবো। কিন্তু আমার হেয়ার ড্রেসার তাহলে গঙ্গায় ঝাঁপ দেবেন, ওর ভয়ে আমি করতে পারি না। (হাসি) উইগ লাগানোর জন্যও তো অল্প একটু চুল দরকার পড়ে। রীতার কথা ভেবেই করি না। রীতা আমার সঙ্গে বহুবছর কাজ করছে। ওকে ছাড়া আমার একটুও চলে না। শ্যুটিংয়ের জন্য উইগগুলো কীভাবে বসাবে, তাই এই ৪টে চুল রেখে দিয়েছি। যদি দেখি আবারও একটা লম্বা লকডাউন হয়ে গেছে, আপাতত কোনও কাজ নেই, তাহলে ওই ৪টেও আমি উড়িয়ে দিতে পারি।
সব স্টাইলেই তো তুমি তোমার মত, খুব ভালো 'ক্যারি' কর...
স্বস্তিকা : আমার মনে হয় এটা নিজের আত্মবিশ্বাসের উপর নির্ভর করছে। আমি কেন সবাই করতে পারবে। আমাকে অনেকে মেয়ে লিখে পাঠায়, চুল ছোট করে কাটতে চাইছি, পারছি না, লোকে যদি বলে খারাপ দেখতে। আরে, তোমার চুল তুমি কাটবে, নিজের যদি ভালো লাগে, তাহলে লোকে কে কী বলল, তাতে কী যায় আসে। (উত্তেজিত হয়ে) আমাকে তো একজন লিখেছেন, আমায় নাকি খুব খারাপ লাগছে, আমি বলেছি বাঁচা গেছে। সবসময় অপ্সরার মতো লাগতে হবে এমন নিয়ম আছে নাকি? মাঝে মধ্যে একটু খারাপ দেখতে লাগা ভালো। আর চুলই তো, আবার গজিয়ে যাবে। একটাই জীবন, যা করতে ইচ্ছা করে, করে নেব।
'তাসের ঘর' এর পোস্টার বের হওয়ার পর অন্তর্বাস নিয়েও তো তুমি ট্রোল হয়েছ...
স্বস্তিকা : আজকাল সাধারণ বিষয়গুলোই তো অসাধারণ বিষয়। চাঁদে কে গেল, না গেল, তা নিয়ে মানুষের মাথা ব্যাথা আছে? অন্য গ্রহ নিয়ে যে গবেষণা হচ্ছে, সেটা নিয়ে কোনও মাথা ব্যাথা নেই। অতি সাধারণ বিষয়, মহিলাদের ব্রা, যেন কালকেই এটা সবাই জানলো। ওমা, মহিলারা ব্রা পড়ে বুঝি! আমার পোস্টারটা দেওয়ার পড়েই যেন মানুষ জানতে পেরেছে মহিলারা অন্তর্বাস পরে। এটা যে কোভিডের থেকেও বড় ঘটনা। কোভিড ২০-র পড়ে এটা ব্রা ২০। নতুন ভাইরাস। মানুষের তো এগুলো নিয়েই যত মাথা ব্যাথা। আমার শরীর, আমার বুক, আমার ব্রা, আমার স্ট্র্যাপ। যেরকম ইচ্ছা আমিও ওটাকে রাখব। কোথায় লেখা আছে অন্তর্বাস সেপটিপিন দিয়ে জামাকাপড়ের মধ্যে আটকে রাখতে হবে? ছেলেরাও তো স্যান্ডো গেঞ্জি পরে, শার্ট খুলে ঘুরে বেড়ায়। আমরা তো দেখি, দুতিনটা বোতম খোলা গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে। আমরা কি তা নিয়ে মিটিং মিছিল করি? আর ব্রা-এর স্ট্র্যাপ দেখা যাচ্ছে, তা নিয়েই যত আলোচনা। আমাকে একজন লিখলেন ৩ সেপ্টেম্বর দেখবো, কী গল্প। আরে ব্রা-এর সঙ্গেও গল্প থাকতে হবে! এটা তো একটা বাড়ির মধ্যে থাকা গৃহবধূর গল্প। বাড়িতে ব্রা পরে আছি, এটাই অনেক না! লকডাউনে বাড়িতে ব্রা পরে থাকবোই বা কেন? পরেছি এই অনেক। না পরা উচিত ছিল, এরপর থেকে আর পড়ব না।
বারবার তুমি ট্রোল হও, এটাকে কি তুমি পজেটিভ ভাবে নাও?
স্বস্তিকা : দেখো আমার কিছু যায় আসে না। কারণ আমি মরে গেলে কাজটাই থাকবে। কে কী কখন বলল, তা থাকবে না। কে কী লিখল, ফালতু কথা, তা নিয়ে কার মাথাব্যাথা? আমি উত্তর দি বলে আরও ৪ হাজারটা লোকের চোখের সামনে আসে। কিন্তু উত্তর দেবো নাই বা কেন? ছেলেরা ন্যাড়া হলে কেউ জিজ্ঞেস করে, দাদা আপনার ক্যানসার হয়েছে, নাকি ড্রাগ নেন? মেয়েরা ন্যাড়া হলেই ইতিহাস থাকতে হবে। যে কিছু তো নিশ্চয় হয়েছে! ছেলেরা করলে কুল। বলিউডে এই যে অক্ষয় কুমার, রীতেশ দেশমুখ ন্যাড়া হল, তাঁদেরকে তো কেউ জিজ্ঞেস করতে যায়নি। আর আমাকে কেউ বললে, আমি উত্তর দেবোই। আমি এখন উত্তর দিলে পরবর্তীকালে হয়ত ৪টে মেয়েকে উত্তর নাও দিতে হতে পারে। সেইটুকু ব্যবস্থা না করে গেলে সমাজে বাস করে কী লাভ!
স্বস্তিকা একা থাকতে ভালোবাসে না বললে, বাড়িতে তুমি কার সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি ভালোবাসো?
স্বস্তিকা : আমার বাড়িতে এখন কেউই নেই গো। আমার মা, বাবা আর নেই। আমার মেয়ে মুম্বইতে পড়াশোনা করে। লকডাউনে এসেও বোনের বাড়ি চলে গেছে। কারণ বোনের বাড়িটা বেশি হ্যাপেনিং। ওর ছোট ছেলে আছে, ৩-৪ খানা পোষ্য আছে। তাই ও খানেই থাকতে পছন্দ করে। আর এখন যেহেতু আমার কাজ শুরু হয়ে গেছে। তাই আমি যখন বাড়িতে নেই, আমি চাই না যে ও একা থাকুক। কাজ থাকলে তো ব্যস্ত থাকি, না হলে রীতা আমায় হেয়ার ড্রেসারকে বলেছি আমার সঙ্গে এসে থাকতে। আমরা রোজই শ্যুটিংয়ে যাই। তারপর একসঙ্গে বাড়ি চলে আসি। আর ফুলকি আছে বাড়িতে, ওর সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হয়। প্রাণের মনের।
তোমারে বলিউডেও দেখছি, এখানেও দেখছি, পরবর্তীকালে কোথায় বেশি দেখতে পাবো?
স্বস্তিকা : কাজটা কাজই, ওখানে যেটা ভালো লাগবে করবো, এখানে যেটা ভালো লাগবে করবো। হিন্দি বেশি করতে চাই, কিংবা বাংলা, তেমনটা নয়। তবে আগামী বছর যে কাজগুলো রয়েছে, সেটার সবই হিন্দি। অর্জুন দত্তের, 'গুলদস্তা' আর 'শ্রীমতী' মুক্তি পাবে হল খুললে। বাকি সব হিন্দি, সবই ওয়েব সিরিজ।
মূলত স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে 'তাসের ঘর', এই ছবিতে তিনিই নায়িকা, তিনিই সব। এখন দেখার ৩ সেপ্টেম্বর 'তাসের ঘর'-এর সুজাতাকে দর্শকরা কতটা পছন্দ করে।