সুমন মহাপাত্র


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

"বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না।" যদি বিপ্লব জন্মায় রাজবলে ভেঙে দাও সে বিপ্লবের কোমর। পাঠিয়ে দাও "যন্তর মন্তর" ঘরে, চলুক "মগজ ধোলাই।" যুগ যুগ ধরে একই পন্থা। তবে পর্দার হীরক রাজের এই "রাজ আদেশ" বারবার ভেঙে দিয়েছেন রিয়েল লাইফের উৎপল দত্ত। তাঁর এক একটা সৃষ্টি যে রব তোলে প্রোসেনিয়ামের বেড়াজাল পেরিয়ে তা আছড়ে পড়ে প্রদীপ জ্বলা কোনও নির্জন গ্রামের কুঁড়েঘরে। তিনি নাটকের জোরে কখনও শান দেন "টিনের তলোয়ারে" কিংবা চিনাকুড়ির কয়লাখনির আগুন "অঙ্গারের" মাধ্যমে মিনার্ভা থেকে ছড়িয়ে পড়ে মহানগরের রাজপথে। 


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: এখনও বারুদের গন্ধ মেলে বিপ্লবীদের 'বোমা বাঁধার ঠিকানা' ২৭ নম্বর কানাই ধর লেনে


অদৃশ্য শত্রু গিলে খাচ্ছে। শিয়রে শমন, প্রাণ বাঁচাতে ছেঁড়া জুতো, চিনি আর রুটি খেয়ে হেঁটে চলেছে একদল মানুষ। তাঁদের ক্লান্তি নেই, "ঘুম নেই।" উৎপল বাবু থাকলে কি নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতেন? সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য অনেকটাই লুকিয়ে তাপস সেনকে সঙ্গী করে লেখা তাঁর অঙ্গার নাটকের কয়লাখনির কালো অন্ধকারে। বড়েধামির কয়লাখনিতে বিনা ল্যাম্পে শট ফায়ার করতে গিয়ে প্রাণ হারায় দীনু মুখুজ্যে ও সহকারী কালু সিং। শাসকের রক্তচক্ষুতে বিকৃত হয়ে যায় দুটি দেহ, বেঁচে যায় ক্ষতিপূরণের টাকা। কিন্তু অন্যায় হলে প্রতিবাদ তো অবশ্যম্ভাবী। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার পড়ে "দীনু মুখুজ্যের হত্যাকারীদের শাস্তি চাই।" প্রতিবাদে সোচ্চার হয় কুদরতের ইউনিয়ন। 



কিন্তু পেট কি প্রতিবাদ বোঝে? সে বোঝে ভাত। তাই ৫০০ টাকা স্পেশাল বোনাসের লোভে বন্ড সই করে খনিতে নামে বিনু, হরি, মোস্তাক, জয়নুলরা এবং  সুবাদার মহাবীর। খনিতে নামার পরেই বেজে ওঠে সাইরেন। বিস্ফোরণে বয়ে আসে ট্রাজেডির গন্ধ। শ্রমিকদের প্রাণের কথা না ভেবেই খনিতে জল ছেড়ে দেয় মালিকপক্ষ। নিভে যায় বেঁচে ফেরার শেষ শিখাটুকু। "এ আল্লা দয়া নি করিবা আল্লা রে" গান ধরে বন্যার জলে ভেসে যাওয়ার আগে বিনু চেঁচিয়ে বলে, "মা আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম, মা।" অঙ্গার নাটকের এই শেষ দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয়তো হয়েছিল আজকের ঔরঙ্গাবাদে। সেখানেও হয়তো ট্রেনে চাপা পড়ার সময় পরিযায়ীদের অন্তর চেঁচিয়ে বলেছিল, "আমরা বাঁচতে চেয়েছিলাম।" 


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: জহরের কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে সুচিত্রা সেন বলেছিলেন, তুমি চলে গেলে চার্লি!


তবে উৎপল কিন্তু শিল্পী নন। তিনি নিজেই বলেছেন, "আমি প্রপাগান্ডিস্ট।" তবে নট-নাট্যকার বললেও তাঁর আপত্তি নেই। হবেই বা কেন! মাত্র ৬ বছর বয়সে গড়গড় করে বলে দিতেন শেক্সপিয়ারের নাটকের সংলাপ। তাঁর অভিনয় দেখে "অতিমানব" রত্ন চিনতে ভুল করেননি জিওফ্রে কেন্ডাল। তারপর দ্য শেক্সপিয়ারানা হয়ে কিউব পেরিয়ে লিটল থিয়েটার গ্রুপ। তবে ৮-১০ মাস কেটেছে গণনাট্যতেও। সেখানে অভিনয় করেছেন পানু পালের "ভাঙা বন্দর," "ভোটের ভেট," ঋত্বিক ঘটকের "দলিল"-এ।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: নিজেকে হিন্দু না বলে, মুসলমানের সঙ্গে সমস্ত প্রভেদ উচ্ছেদ করে দিই তাহলে...


এরপর মিনার্ভায় একের পর এক শো। "নীচের মহল" নাটক দেখে নাটকে সঙ্গীত দিতে এগিয়ে এসেছিলেন রবিশঙ্কর। তারপর একের পর এক নাটক যা আজকের নাট্যজগতে মিথ হয়ে বেঁচে আছে। নৌ-বিদ্রোহের ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় খুলে দেয় তাঁর "কল্লোল" নাটক। তাঁর কল্লোলে নতিস্বীকার করেনি নৌ-বিদ্রোহ। স্বভাবতই রাজরোষে পড়েন উৎপল, কল্লোলের বিজ্ঞাপন ছাপা বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সব পত্রিকা। তাপস সেন পোস্টার লেখেন "কল্লোল চলছে চলবে।" তবে গ্রেফতার হতে হয় উৎপল দত্তকে, মিনার্ভা নাকি কমিউনিস্টদের বেলাল্লাপনার আখড়ায় পরিণত হয়েছে, ভেসে এসেছিল একথাও। তবে তাঁর মুক্তির দাবিতে সরব হয়ে উঠেছিলেন দেশ-বিদেশের বুদ্ধিজীবিরা। তাঁর মুক্তির পর ময়দানে ঘটা করে পালিত হয়েছিল "কল্লোল বিজয় দিবস।"



"বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস!" সময়টা ৬৭, চারিদিকে কান পাতলেই শুনতে মেলে নকশাল, নকশাল। সেই আগুনে গা ভাসিয়েছিলেন উৎপল। ব্রিগেডে সভা করতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। পাশেই এক উদ্যানে মিটিং করেছিলেন উৎপল। নকশাল আন্দোলনকে উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর “তীর” নাটক। ফের তাঁর নামে জারি হয় গ্রেফতারির ফরমান। মুম্বইয়ের তাজ হোটেল থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিস। ইসমায়েল মার্চেন্টের সহযোগিতায় মুচলেকা দিয়ে রাজনৈতিক নাটকের অংশ না হওয়ার শর্তে মুক্তি পান উৎপল।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: সে দিন মিটু থাকলে বায়োস্কোপে প্রথম যৌন হেনস্থার শিকার হয়তো কাননদেবীই


কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাঁর "মানুষের অধিকারে" নাটক নিয়ে নকশালদের নিশানায় পড়েছিলেন উৎপল। জন্ম নিল নতুন নাট্যদল "পিওপলস লিটল থিয়েটার।" "ওরা হার্মাদ, জলদষ্যু, এসেছে লুঠ করতে, নারী সতিত্ব নাশ কইরে, সোনার ভারতরে ছাড়খাড় কইরে চলে যাবে সপ্তডিঙা ভাইস্যে।" নাটকের নাম "টিনের তলোয়ার।" মেথরের কাছে "বামুন আর বাবু দুই ভাঙা মঙ্গলচন্ডী।" নাটকের ইতিহাস থেকে জন্ম নিয়েছিল এই নাটক। তারপর "সূর্যশিকার" করে "ব্যারিকেড" গড়েছেন। "টোটা" দিয়ে "দুঃস্বপ্নের নগরী" পেরিয়ে "তিতুমির" এর হাত ধরে "স্তালিন ১৯৩৪," সবশেষে "একলা চলো রে।"



‘‘কান পেতে শুনুন, চারিদিকে ঢক্কা নিনাদ, দেশ স্বাধীন হয়েছে বিনা রক্তপাতে, অহিংস সংগ্রামের দৌলতে! দেশ নাকি স্বাধীন হয়েছে খদ্দর পরার ফলে, আমরা একমনে চরকা কেটেছি বলে! রাইফেল পালা দিয়ে চিৎপুরের চৌহদ্দিতে পা রাখেন উৎপল। ইন্টালেকচুয়াল নাটক সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু না। যাত্রা দিয়ে মানুষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার লোভ সামলাতে পারেননি "গ্যালিভার।" তাই পঞ্চু সেনের মতোই তিনি হয়ে উঠলেন চিৎপুরের শেষ কথা।


আরও পড়ুন- গল্পস্বল্প: “বিধান তুমি থাকতে আমার শ্যামা ভুল চিকিৎসায় মারা গেল”


"নাটক ও যাত্রা আমাকে সৃষ্টির আনন্দ দিলেও চলচ্চিত্র দিয়েছিল বেঁচে থাকার রসদ, মানে টাকা" তবে তাঁর "বিগ স্ক্রিনের" প্রায় সব চরিত্রই কালজয়ী।  “হিরকের রাজা” আজও ভগবান, “মগনলাল মেঘরাজের” দরবারের জটায়ূর উপর অর্জুনের খেল এখনও হা করে গেলে সিনেপ্রেমীরা। “মনমোহন মিত্র” এই বুঝি শ্রী কৃষ্ণের ১০৮ টা নাম জিজ্ঞেস করলো, ভোলা যায়না “হোসেন মিঞাকেও।" “ভুবন সোম” থেকে “যুক্তি তক্কো আর গপ্পো”,  সর্বত্র বিচরণ করছেন উৎপল। 


নাটক দিয়ে বিপ্লব হয়, প্রোসেনিয়ামের জাদুতে হয় “দিন বদলের পালা।" সারা বিশ্বের নাট্যজগতে অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক উৎপল।