সৌমিত্র সেন


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

রক্তের লাল আর বারুদের গন্ধ থেকে কি কখনও সুরের মূর্ছনা উঠে আসতে পারে? ভারী বুটের মন-থ্যাঁতলানো শব্দ বা একে ৪৭-এর শরীর-ছেঁড়া হিংস্রতা কি কখনও ঢেকে দেওয়া যায় রিনরিনে সুরের রণনে? কেউ কি কখনও এমন আশ্চর্য কাণ্ড হতে দেখেছেন, কেউ এটা করেও দেখিয়েছেন কখনও?


দেখিয়েছেন বইকি! এক-মাথা সাদা ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া চুল নিয়ে একটা লোক ছোট্ট একটা তারের যন্ত্রের উপর নিবিষ্ট ঝুঁকে পড়ে যন্ত্রটি থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে আনছেন গভীর কাশ্মীর-- বছরের পর বছর ধরে এমন একটা দৃশ্য তো অতি সহজেই দেখে এসেছেন শ্রোতারা।


দিনের পর দিন যিনি নিজের যন্ত্রের নিভৃত থেকে এই ভাবে সুর-ছন্দ-তাল তুলে এনেছেন, মুগ্ধ করেছেন, স্তব্ধ করেছেন, বিস্মিত করেছেন অসংখ্য মানুষকে, তিনি সন্তুর নামক যন্ত্রটির এক ও অদ্বিতীয় শিল্পী কিংবদন্তি পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের জগতে অপূরণীয় ক্ষত তৈরি করে দিয়ে যিনি সদ্য চলে গেলেন অন্য কোনও সুরলোকে। রেখে গেলেন সঙ্গীতের অনন্য লেগাসি।


মঞ্চে উপবিষ্ট মানুষটি চোখ বন্ধ করে হাতে ধরা দু'টি ধাতব কাঠি দিয়ে আপন মনে তৈরি করে চলেছেন ছন্দের নিঃসীম মায়ালোক। আর মর্মাহত তারগুলির কান্নাহাসির মধ্যে দিয়ে উঠে আসছে একটা গোটা প্রদেশ, একটা গোটা জনপদের আপাদমস্তক যাপন, যন্ত্রণা। লাবণ্যও! জম্মুর মানুষ শিবকুমারের বাজনায় সততই স্বরাট রূপসী কাশ্মীর। শিবের ছন্দকল্পনা ও সুররচনার মর্মে মর্মে যেন কাশ্মীরেরই হিমেল হাওয়া, পাহাড়ি নদীর কল্লোল, অরণ্যের উদ্ভাস। পাহাড়ে জন্ম বলেই কি শিবকুমারের সুরে এত বেশি বেশি করে নিবিড় ছায়া ফেলে যায় পাহাড়ি রাগের আবেশ-- পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা উচ্ছল নদীধারা, সবুজ উপত্যকার মাথায় সমাহিত গভীর সুনীল আকাশ, অরণ্যশিখরে আশ্লিষ্ট মেঘসম্ভার, বনঝরনার নমিত উচ্ছলতা?


এ সব তো আছেই। কিন্তু শুধু এটুকুতেই শেষ হয়ে যায় না যন্ত্রী শিবকুমার শর্মার অর্জন। তাঁর সব থেকে বড় কাজ-- অনেকটা সানাই-সম্রাট উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁর মতোই--নিছক এক লোকবাদ্যযন্ত্রকে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসরের কুলীন এক বাদ্যযন্ত্রে উত্তীর্ণ করা!


জম্মু-কাশ্মীরের এই বাদ্যযন্ত্রটি কয়েক দশক আগে পর্যন্ত পরিচিত ছিল আঞ্চলিক বাদ্যযন্ত্র হিসেবেই। শোনা যায়, প্রায় একশোটি তার থাকায় আগে এটিকে শততন্ত্রীবীণাও বলা হত। মাত্র গত শতকের গোড়ার দিকে যন্ত্রটির নামকরণ হয় 'সন্তুর'। তবে বাদ্যযন্ত্রবিদেরা বলে থাকেন, সন্তুর নামক যন্ত্রটি দেখতে গেলে ঠিক কাশ্মীরেরও নয়, এটি এসেছে পারস্য থেকে। আনুমানিক চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় ব্যবহৃত এক ধরনের তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র থেকেই সন্তুরের উৎপত্তি বলে ধারণা তাঁদের। একটা সময় পর্যন্ত সন্তুর কেবলমাত্র কাশ্মীর অঞ্চলের সুফি শিল্পীরাই ব্যবহার করতেন। 'সুফিয়ানা মওসিকি' নামে বিশেষ ধরনের এক গায়কিতেই যন্ত্রটি ব্যবহৃত হত।


কিন্তু সেই সুদূর মেসোপটেমিয়া থেকে শুরু করে যন্ত্রসঙ্গীতের চার হাজার বছরের মরমি ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে শিবকুমার কী সাবলীল ভাবেই না চলে আসেন আমাদের একালের টাইম-ফ্রেমে! ইদানীং শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্রের মাঝে সন্তুর যে অতুল মর্যাদা লাভ করেছে, তা শিবকুমারেরই সম্পূর্ণ একক দান (তাঁর বাবা কণ্ঠশিল্পী পণ্ডিত উমা দত্ত শর্মার কথা ভুলে গেলে অবশ্যই অন্যায় হবে, কেননা তিনিই প্রথম সন্তুর নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন; কিন্তু সেটাও তো শিবকুমারের নিজস্ব অর্জনেরই অন্তর্গত থেকে যায়, কেননা সেটা তো শিবের পারিবারিক ব্যাপার)। প্রকৃত শিল্পী তো তিনিই যিনি সঙ্গীত-ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ করেন; প্রচলিত সঙ্গীতের, প্রচলিত যন্ত্রের চলন-ধারণা সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে জন্ম দেন নব-বাস্তবতার! সন্তুরকে আঞ্চলিকাতার খোপ থেকে বের করে এনে শিবকুমারই একক ভাবে এটিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিয়েছেন।


কিন্তু শিল্প বা শিল্পীর ক্ষেত্রে এ-জাতীয় ইতিহাসধর্মিতার বাইরে আর যা থেকে যায়, তা হল বিশুদ্ধ 'এস্থেটিক্স'। সেখানেও শিবকুমার যথারীতি সুমহান! শিবকুমারের সন্তুরের শাশ্বত সুর যেন মনে চির-পবিত্রতা বুনে দেয়; যে কোনও মানসিক অবস্থাতেই তা প্রশান্তি ও মাধুর্যে ভরিয়ে দেয় অন্তস্তল। তিনি যেন চাইলেই অনায়াসে রচনা করে দিতে পারেন স্নিগ্ধ ভোর কিংবা মুগ্ধ সন্ধ্যা। তাঁর সন্তুরের মৃদুমদির ঝঙ্কার আমাদের যেন শুধু সমাহিতই করে, অতলান্ত ডুবিয়েই দেয়। সমস্ত উত্তেজনা দ্বেষ আলোড়নকে সযত্নে মুছে দিয়ে তা যেন আমাদের মনের মধ্য়ে জাগিয়ে তোলে স্বর্গীয় অনুভূতি। তিনি যেন তাঁর সঙ্গীতের মধ্যে দিয়েই সঘোষে জানিয়ে যান-- আতঙ্কের এই ভূস্বর্গ-ভূমি তাঁর অন্বিষ্ট নয়; এই মৃত্যু-উপত্যকা তাঁর দেশ না! 


আরও পড়ুন: Pandit Shivkumar Sharma Passes Away: প্রয়াত কিংবদন্তি সন্তুরবাদক পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা


(Zee 24 Ghanta App দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির লেটেস্ট খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Zee 24 Ghanta App)