সব্যসাচী চক্রবর্তী


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

Truth is singular. Its "versions" are mistruths.


সত্যিটা সত্যিই! কিন্তু কোনটা সত্যি, আমরা বুঝবো কী করে বলুন তো মশাই? যিনি সত্যি বলছেন বলে দাবি করছেন, তিনিও সত্যিটা, সত্যি সত্যি জেনেই বলছেন, তার কি মানে? ফলে সত্যির সব ব্যাখ্যা অসত্য মাত্র। সত্যিটা, সত্যই! অনেক সত্যিই আছে, যা আমরা কোনও দিনও জানতে পারবো না। এই সত্যি আর মিথ্যের মাঝেই কিন্তু রয়েছে ক্ষমতার লড়াই। ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই।


ছোটবেলায় একটা কথা শুনতাম। এ বাংলায় বামেরা নাকি, একই মিথ্যে এতবার বলত, যে মিথ্যেটাই সত্যিতে দাঁড়িয়ে যেত। যদি সত্যি তাই হত, তাহলে তো সেই ট্রাডিশন এখনও! সব রাজনৈতিক দলই একই পথের পথিক! আমরা শুধু গোগ্রাসে গিলি একরাশ মিথ্যেওয়ালা সত্যির আম-জাম-কাঁঠাল।


Spider-man Far From Home দেখে এলাম। সত্যি-মিথ্যের হিসেব এল তাই। বাস্তব-অতি বাস্তব-পরা বাস্তবের ঘুলমিলে মানুষ কীভাবে ওঠে বসে, দেখতে হলে একটু ঘুরে আসুন মার্ভেলের এ জগতে। মন্দ লাগবে না। এখনও পর্যন্ত যত স্পাইডারম্যান নিয়ে ছবি হয়েছে, ভাবনার উৎকর্ষতার দিক থেকে এ ছবি পয়লা নম্বরে। যা রোজ ভাবছেন, তা কতটা বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে, এ ছবি দেখলে তা নতুন করে ভাবতে পারেন বইকি। নাঃ, গল্প বলে স্পয়লার দিয়ে লাভ নেই। বরং বাস্তবের সত্যি-মিথ্যের গুলিয়ে ফেলা হাহাকারকে এ ছবি কতটা খামচি দিল, সেটা দেখা যাক। যাতে, যাঁরা ছবি এখনও দেখেননি, তাঁরা একটা ভাবনা নিয়ে নতুন ভাবে সে সব যাচাই করতে পারেন। আর যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা তাঁদের ভাবনার সঙ্গে একবার না হয় মিলিয়ে দেখে নেবেন। মিল না হলে অবশ্যই কমেন্ট বক্সে মেসেজ করবেন কিন্তু। আর মিলে গেলে, প্লিজ লাইক অ্যান্ড শেয়ার!


Illusion is the first of all pleasures.- Voltaire


যাঁরা বাস্তবের মধ্যে থেকে একটা আলাদা পরাবাস্তবের দুনিয়া তৈরি করেন, তাঁরা করেন আমাদের জন্য। তাঁরা জানেন, আমরা কী চাই, বা না চাই। আমাদের চাওয়া মিলে গেলে কী করি, না মিললে কতটা কী। বোঝাই যাচ্ছে, এই অ-বাস্তবচিত কাজকর্ম আসলে আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই। বাঁদর নাচ নাচব আমরা, ভাবনা তো তেমনই..!


গত মাসে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। হেডলাইনটা ছিল,
China’s Communist Party Is Making Its Own (Virtual) Reality
Propaganda is getting an upgrade with technological tricks.


শিরোনাম থেকেই বক্তব্য স্পষ্ট। চিনের কমিউনিস্ট পার্টির ভাবনাচিন্তা সবকিছু, সাধারণকে একেবারে গুলে খাওয়ানো যাবে, এরকম একটা দুনিয়া তৈরি করা হবে। সেখানে নিয়ে গিয়ে, চলবে মগজ ধোলাই।


পরাবাস্তবের দুই প্রক্রিয়া। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। আর অগমেন্টেড রিয়েলিটি। পার্থক্য কী? ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হল, আপনার চারপাশে যা, তার থেকে একটা সম্পূর্ণ অন্য দুনিয়া তৈরি করা। আর অগমেন্টেড রিয়েলিটি হল, আপনি যে বাস্তবে আছেন তাতেই থাকুন, শুধু সেই বাস্তবটাকে আরেকটু বেশ রঙচঙে করে দেওয়া হবে। ইচ্ছেমতো আপনার বাস্তবকে ভেঙেচুরে দেওয়া হবে!


আর এই কাজটিই তো হয়। আচমকা ধরুন বলা হল, কালো গোলাপে দেশ ছেয়ে গিয়েছে। কালো গোলাপে ক্যান্সার হয়। ভোটের সময় নেতা গোপীনাথ এসে বললেন, আমি ক্ষমতায় এলে সব কালো গোলাপ উপড়ে সাদা গোলাপ পুঁতে দেব। সাদা গোলাপ পুঁতলে আয়ু বাড়ে। প্রত্যেককে পনেরোটি করে সাদা গোলাপ ফ্রি। আদতে কিন্তু কিস্যু না। সব ভাঁওতাবাজি। কিন্তু এই ভাঁওতাবাজিকে ঢাকতে চলল নানা রকম খবর, তত্ত্ব, ভাবনা আর ফিসফাস। ধীরে ধীরে আপনি ওটিই বিশ্বাস করতে শুরু করলেন।


আদতে কী হল?  নেতা গোপীনাথ ক্ষমতায় এলেন। কালো গোলাপ তো তুললেন না, বরং তাতে সাদা রঙ লাগিয়ে কাজ সারলেন। আমরাও ভাবলাম বাঃ, এতো তোফা! কেউ কেউ বললেন, ওই যে পনেরোটি করে গোলাপ দেবেন বলেছিলেন? তখন আবার পাল্টা প্রচার চলল, তুমি গাছ থেকে ফুল ছেঁড়ার কথা বলছ! আচ্ছা আহাম্মক তো বাপু! গাছে ফুল থাকলেই তো সৌন্দর্যায়ন। আরে সাদা গোলাপের গন্ধেই তো আয়ু বাড়ে। বাড়ি নিয়ে গিয়ে করবেটা কি? এই প্রচারেও চলল নানা ফন্দিফিকির। আপনি সেটাও গিলে নিলেন।


স্পাইডারম্যানের এ ছবিতেও তাই। ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে মানুষের মনে ভয় ধরানো হল। মানুষ ভয় পেল। সে ভয় কাটাতে এল এক সুপারহিরো। ভয়টাতো একটা ভাঁওতাবাজি। তাই সুপারহিরো ইচ্ছেমতো সে ভয় কাটিয়ে দিল। মানুষ ভুল বুঝতে ভালোবাসে। সেই ভুল বোঝার ভালবাসাকে, ভুল বুঝিয়ে, প্রশ্রয় দিয়ে, ক্ষমতা দখল। এ কথা আজকের দিনে অন্তত প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে কোন খবর বা তথ্য ঠিক আর কোনটা ভুল, সবই যখন ঘেঁটে ঘ!


আসলে আমরা চারপাশটাকে তো জানি খবর দিয়ে! সেই খবর নিয়ে খেলা করে একটা পরাবাস্তবের জগত তৈরি করা হয়। আচমকা রটিয়ে দেওয়া হয়, এই অমুক জুজু এসেছে বাজারে। সবাই বটগাছের শিকড় চিবোন। ব্যাস, বটের শিকড়ের হাই ডিমান্ড। সমস্তটাই মস্তিস্ক প্রক্ষালন।  
মস্তিস্ক প্রক্ষালক যন্ত্র। যে যন্ত্র মস্তিস্কে রোপণ করে মন্ত্র।  
বাকি রাখা খাজনা মোটে ভাল কাজ না
ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেওয়া চাই


‘হীরক রাজার দেশে’ মনে আছে?
মন্ত্র ভরছে আপনার মগজে। খাওয়াচ্ছে যা খাচ্ছেনও তাই। সেই কবে মাণিকবাবু দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। সুপারহিরোচিত মারপিট-ঝাড়পিটের ছবিতে, সেই একই কথা ঘুরেফিরে।


স্পাইডারম্যানে অগমেন্টেড রিয়েলিটি দিয়ে দুর্দান্ত কাজ রয়েছে। যার কেন্দ্রে রয়েছে নতুন চরিত্র মিস্টিরিও। অ্যাভেঞ্জার্স এন্ড গেমের আটমাস পরের এই গল্প। যেখানে স্পাইডারম্যান খুব করে সাধারণ হতে চায়। গার্লফেন্ডকে প্রোপোজ করতে চায়। কিন্তু স্পাইডি কীভাবে বাস্তব আর পরাবাস্তবের ফাঁদে লটকে পড়ে, তা নিয়েই এই ছবি। এবং শেষ পর্যন্ত এই ছবি অগমেন্টেড রিয়েলিটির ভালো-খারাপের কথা বলে যায়। টেকনোলজি তো আছে। ভালো বা খারাপ, প্রায়োগিক দিক তো আমাদের হাতে। তাই না? স্পাইডারম্যান ফার ফর হোম, এন্ডগেমের দুর্দান্ত উপসংহার বলতে পারেন।


সবশেষে কিছু তথ্য দিয়ে রাখি। যতদিন যাচ্ছে, এই অগমেন্টেড রিয়েলিটির হাত কিন্তু ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। অ্যাপল, গুগল, ফেসবুক কিংবা স্ন্যাপচ্যাট হুড়মুড় করে আপডেট করছে নিজেদের। ভাবনা-চিন্তা-তত্ত্ব সমস্ত কিছু ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলবে একেবারে অন্যরকম ভাবে। আপনি না বুঝেও অজান্তে গিলে ফেলবেন সব। আস্তে আস্তে পাল্টে যাবেন। এ খুঁড়োর কল সামনে গাজর ঝুলিয়ে নাচাবে আমাদের। তার চেয়ে ভাল, ফার ফ্রম হোমের পিটার পার্কার হয়ে উঠুন। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে, নিজের ওপর ভরসা করে ঠিক-ভুলের সিদ্ধান্ত নিতে শিখুন। সোশ্যাল মিডিয়ার হুল্লোড়বাজি থেকে তফাৎ থাকার চেষ্টা করুন। সবথেকে বড় কথা অযথা মাথা গরম করা বন্ধ করুন।


আর ছবি নিয়ে যে তথ্য দেওয়ার। এই ছবিতে কিন্তু দুটো পোস্ট ক্রেডিট সিন। ছবি শেষে নামধাম দেখাতে শুরু করল, আর আপনি উঠে গেলেন, তাতে মজাটাই মাটি। কারণ ছবি শেষের ছবি, আপনাকে একেবারে কুপোকাত করে দেবে। একবার নয়, দু বার।


আর একটা বিষয়, আবার প্রমাণ হল। মার্ভেলের ট্রেলার মাথায় নিয়ে ছবি না দেখাই ভালো।