`অপরাজিত` সত্যজিৎ আমাদের মজ্জায় ঢুকে পড়েছেন
জন্মশতবর্ষের ২ মে তো `রায়-দিবস` হয়ে দাঁড়াল।
অনীক দত্ত
সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কোনও কথা বলার আগে আমি বাংলা ছবির দর্শকদের একটা খবর দিতে চাই। আমার নতুন ছবি 'অপরাজিত'। এই ছবি সত্যজিতের বায়োপিক নয়, বরং 'দ্য মেকিং অফ পথের পাঁচালি'কে একটা ট্রিবিউট বলা যায়। সত্যজিৎ রায়কে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের একট চেষ্টা। তাই ছবির নাম 'অপরাজিত।' কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করবেন আবীর চট্টোপাধ্যায়, ছবিতে তাঁর নাম অপরাজিত রায়। গল্পের প্রেক্ষাপট ১৯৫৫ সাল। অন্যধারার ছবি করতে চান অপরাজিত। বেশ কয়েকজনকে নিয়ে মেতেও পড়লেন। ছবির নাম হবে 'পথের পদাবলী'। এই একটি ঘোষণা জি ২৪ ঘণ্টা ডিজিটালের পাঠকদের কাছে আমার করার ছিল।
কিন্তু, সত্যজিতের সঙ্গে আমার প্রথম চেনা সিনেমা দিয়ে নয়। প্রথম চেনা ওঁর আঁকা-লেখা দিয়ে। প্রথমেই আসে 'সন্দেশ'-এর কথা। প্রত্যেক সংখ্যায় রং পালটে যেত। এছাড়া নানা রকম অসাধারণ সব ইলাস্ট্রেশনে ভরা ছিল পত্রিকাটি। আর ছিল একটা দারুণ টান। সত্যজিতের অনুবাদে সেখানে পেতাম এডওয়ার্ড লিয়রের লিমেরিক, ছবি-সহ। আর একটা জিনিস ভাল লাগত। দুটো পাতা জুড়ে বড় একটা ইলাস্ট্রেশন, ধরুন মাঠে পিকনিক হচ্ছে, কিংবা একটা বৈঠকখানা। উনি করতেন কী, ছবির একটা অংশ কেন্দ্র করে প্রশ্ন করতেন, আচ্ছা 'ব' দিয়ে আরম্ভ হয় এমন কী কী জিনিস ওখানে হতে পারে? আমরা ভাবতাম। ওই ব্য়াট, বল, বই ইত্য়াদি আর কী! এর পর তো বোমা ফাটল। এল ফেলুদা। আমাদের ছোটবেলাটা জুড়ে এর কী গভীর প্রভাব!
ছোটবেলায় শুনেছি, আমাকে নাকি 'পথের পাঁচালী' দেখানো হয়েছিল। মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম। তা, আমি নাকি কেঁদে-কেটে একশা হয়ে বলেছিলাম, আমি আর বাংলা ছবি দেখব না। তার অনেক পরে একটু বড় হয়ে দেখলাম 'গুপী বাইন বাঘা বাইন'। মনের ওপর একটা অনপনেয় ছাপ রাখল এই ছবি। এতটাই যে, আমরা বন্ধুরা মিলে এটা করেও ফেললাম মঞ্চে। আমি 'ও মন্ত্রীমশাই' গানটি সেজেগুজে স্টেজে গেয়েওছিলাম। মোটেই ভাল গাইনি। তবে সকলে নাটকের চরিত্রের পোশাক-আশাকের মানে, কস্টিউম ডিজাইনের প্রশংসা করেছিলেন। ওটা আমার করা ছিল।
আরও পড়ুন: সত্যজিৎ আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সূর্য ছিলেন, অন্যদের আলোকিত করেছিলেন তিনি
পরে-পরে এহেন সত্যজিৎ আমার মনে আরও বড় আকার নিলেন। তখন আস্তে আস্তে ওঁর ছবিগুলো দেখছি--- 'পথের পাঁচালী', 'অপরাজিত'। 'অপরাজিত' আমার মনে প্রচণ্ড ছাপ ফেলেছিল। পরবর্তী কালে আমি ঠিকই করে ফেলেছি, আমিও ছবি করব। উনি সম্ভবত একমাত্র ফিল্মমেকার যাঁর সব কাজ আমি দেখেছি। 'সিকিম' পর্যন্ত। এমনিতে আমি কিন্তু খুব সিনেমা দেখি না। কখনও দেখিনি। বিশ্বের বড় বড় পরিচালকের ছবি আমাকে দেখতেই হবে, এমন কখনও আমি ভাবিনি। আমি বার্গম্যানের ছবি কয়েকটা দেখেছি। তবে এটা বলব, যাঁরা ফিল্মমেকার, তাঁরা যদি খুব চেষ্টাও করেন যে, না, কোনও ভাবেই সত্যজিতের প্রভাব নেবেন না, সেটা কঠিন। আমিও কখনও ঠিক এভাবে ভাবিনি যে, আমার কাজে ওঁর প্রভাব আটকাব। তার মানে, আবার নকলও করিনি। আসলে সুনীল গাঙ্গুলিরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন, প্রথমদিকের লেখায় করেওছিলেন হয়তো, কিন্তু পরে ওঁরাই বলেছিলেন যে, না সেটা সম্ভব নয়, রবীন্দ্রনাথ আসলে ভেতরে ঢুকে রয়েছেন। ওই সত্যজিতের ব্যাপারটাও তেমন।
আমার প্রথম ছবি দেখে সকলে 'সত্যজিৎ-সত্যজিৎ' করতে শুরু করেন। তখন আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমার বিনয় নয়, কিন্তু একথাও ঠিক, আমি এর যোগ্যও নই, আর আমি কেন সত্যজিতের উত্তরাধিকার বহনের চাপটা নেব? কিন্তু এটাও দেখেছি, কাজ করতে-করতে প্রভাবটা ঠিক চলে আসে। যেমন ধরুন 'ভূতের ভবিষ্যৎ'। আমি একটি চরিত্রের মোবাইলে রিংটোন রেখেছিলাম গুপী গাইন বাঘা বাইনের ভূতের গলাটা। এটা স্পষ্ট চিহ্ন। সূক্ষ্ম প্রভাবও ছিল। জলসাঘরের মিউজিকের একটা অংশও ওই ছবির এক চরিত্রের মাধ্যমে ব্যবহার করেছি। তার পরে তো আমার নানা ছবিতে নানা ক্ষেত্রে নানা ভাবে ওঁর রেফারেন্স এসেছে।
এবারটা খুবই খারাপ লাগছে, ওঁর জন্মশতবর্ষের দিন ভোটের রেজাল্ট বলে। এমনিতেই কোভিড চলছিল, তারপর আবার নির্বাচন-পর্ব। এদিন আবার ফলপ্রকাশ। আমি আমার বৃত্তের মধ্যে ওই ২ মে-তে ভোটের রেজাল্টের বিষয়টি নিয়ে আপত্তি করছিলাম। তা কেউ কেউ রসিকতা করে বলল, আরে ওটা তো 'রায়-দিবস'।
ভোটের রায় বেরোবে কিনা, তাই দিনটা 'রায়-দিবস'।
আরও পড়ুন: সত্যজিৎই প্রথম এদেশের বিজ্ঞাপনে ভারতীয় বাঙলিয়ানার ছোঁয়া নিয়ে এলেন