Mohiner Ghoraguli | Tapas Bapi Das: প্রয়াত বাপি! এরপর আর কোনও ঘোড়াই চরবে না `পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে`...
Tapas Bapi Das Passes Away: `এই সব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে`ই তো এগিয়েছে অন্যধারার বাংলাগান, এগিয়ে চলবেও নিয়ত। `এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায়` ভেসে আসবে আস্তাবলের ঘ্রাণ! ভেসে বেড়াবে `পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে-হতে` কিংবা `কখন তোমার আসবে টেলিফোনে`র উল্লাস ও বেদনামাখা সুর।
সৌমিত্র সেন: কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে আর ঘাস খাবে না মহীনের কোনও ঘোড়াই! কেননা, মহীনের ঘোড়াগুলিই তো আর নেই! কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরের বিষণ্ণ ঘাসের রাজ্য ছেড়ে এবার চিরকালের জন্য চলে গেলেন মহীনের শেষ ঘোড়াটিও বাপি-- তাপস দাস (Tapas Das)। 'মহীনের ঘোড়াগুলি' (Mohiner Ghoraguli) ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ছিলেন গীতিকার, গায়ক, বাদকও। বাজাতেন গিটার। সত্তরের দশকে আস্তে আস্তে তৈরি হয়ে উঠছিল নতুন এক সাংগীতিক আদর্শ। বাংলার প্রথম রক ব্যান্ড 'মহীনের ঘোড়াগুলি'! এক এক করে চলে গিয়েছেন 'মহীনের ঘোড়াগুলি'র প্রতিষ্ঠাতা-শিল্পীরা। শেষ ঘোড়া ছিলেন তাপস দাস। কলকাতার গানদুনিয়া তাঁকে বাপিদা নামেই চেনে। অসুস্থই ছিলেন। লাং ক্যানসার হয়েছিল। চলছিল কেমো। চলে গেলেন তিনি।
আরও পড়ুন: Mohiner Ghoraguli | Tapas Bapi Das: এক যুগের অবসান, প্রয়াত ‘মহীনের’ শেষ ঘোড়া বাপিদা!
'মহীনের ঘোড়াগুলি' ১৯৭৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাংলা স্বাধীন রক ব্যান্ড। ভারতেরও প্রথম রক ব্যান্ড এটি, যা ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে তার শিল্প-যাত্রা শুরু করে। গৌতম চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন ঘোষাল, আব্রাহাম মজুমদার, তাপস দাস ও তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায়-- এই সাতশিল্পী শুরু করেন অভিনব এই সংগীতাাভিযান। বাংলা রক গানে তাঁরা অনেকটা আঁভা-গার্দ হিসেবে স্বীকৃত। আমেরিকান, লাতিন, রক, জ্যাজ, বাংলার বাউল আর কখনও কখনও শাস্ত্রীয় সংগীতের কিছু কিছু উপাদান-- সব রকম সঙ্গীতধারা মিলেমিশে যায় মহীনের ঘোড়ার ছন্দে-তালে-সুরে। যে-কারণে 'মহীনের ঘোড়াগুলি'কে অনেকেই লোক-রক ব্যান্ড বলেন। মহীনের মধ্যে প্রভাব ছিল বিটল্স, বব ডিলান, বেটোফেন, রবিশঙ্কর, আলি আকবরেরও।
সত্তরের দশকে গড়ে উঠলেও প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় 'মহীনের ঘোড়াগুলি'। সময়ের কিছুটা আগেই আসলে এসে গিয়েছিল তারা। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল-- এই সময়পর্বে 'সংবিগ্ন পাখিকূল ও কলকাতা বিষয়ক' (১৯৭৭), 'অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব' (১৯৭৮) এবং 'দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি' (১৯৭৯)-- এই তিনটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। তখন খুব সাড়া ফেলেনি এগুলি। তবে প্রাপ্য স্বীকৃতি ও সম্মান 'মহীনের ঘোড়াগুলি' পেল নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯৫ সালে সমসাময়িক বিভিন্ন শিল্পীদের নিয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায় 'আবার বছর কুড়ি পরে' শিরোনামে 'মহীনের ঘোড়াগুলি'র একটি কভার সংকলন প্রকাশ করেছিলেন।
রাজনীতি, দারিদ্র্য, অর্থনীতি, সামাজিক অন্যায়-অবিচার সঙ্গে বিপ্লব, ভালোবাসা, একাকিত্ব, স্বাধীনতাচেতনা-- ইত্যাদি নানা বিষয় গান হয়ে ওঠে মহীনের আস্তাবলে। বাংলা সংগীতমহলের একাংশের দাবি, কবীর সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন দত্তের মতো শিল্পীরা হয়তো আসতেনই না, যদি 'মহীনের ঘোড়াগুলি' না হত! মহীনের ঘোড়াগুলি তৎকালীন সাধারণ বাংলা গানের চেনা গন্ডির বাইরে গিয়ে সংগীতের নতুন ধারার সূচনা করেছিল। আশির দশকের শুরুর দিকে ব্যান্ডটি ভেঙে যায়। পরে সদস্যরা যেযার মতো কর্মজীবন বেছে নেন।
কিন্তু তাতে কী? 'এই সব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে'ই তো এগিয়েছে অন্যধারার বাংলাগান, এগিয়ে চলবেও নিয়ত। প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া হয়তো আর ঘাসের লোভে চরে বেড়াবে না পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে। তবে মহীনের সংগীত-ঐতিহ্যকে ভেতরে ধারণ করেই বাংলাগানের স্রোতধারায় কেবলি দৃশ্যের জন্ম হবে। আর 'এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায়' ভেসে আসবে আস্তাবলের ঘ্রাণ! ভেসে বেড়াবে 'পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে-হতে' কিংবা 'কখন তোমার আসবে টেলিফোনে'র উল্লাস ও বেদনামাখা সুর। আসলে তাপসদের সংগীতসাধনা কখনও মিথ্যে হয় না!