`পথের পাঁচালী দেখুন`, `পথের পাঁচালী দেখা আমাদের কর্তব্য`; মিছিলের সামনে তরুণ
সেই রাতে গুটিকয় তর্কবাগীশ বন্ধুর ধারণা ছিল পথের পাঁচালি হয়ত মুখ থুবড়ে পড়বে সিনেমা হলে। কিন্তু তাদের উপলব্ধিতে এটাও ছিল যে এই সিনেমার জন্য কিছু করা অবশ্যই প্রয়োজন।
অনুষ্টুপ রায় বর্মণ: সোমবার সকালে 'পলাতক' হলেন 'জীবনপুরের পথিক' তরুণ মজুমদার। তরুণ মজুমদার সুস্থ রুচির স্নিগ্ধ স্বাদের এমন এক ধাঁচের ছবি চিরকাল বানিয়ে গিয়েছেন, যা টলিউডে একটা আলাদা ঘরানা তৈরি করেছে।
এহেন তরুণ মজুমদার শুধুমাত্র সিনেমার মধ্য দিয়ে মানুষের মন ছুঁয়েছেন তাই নয়, অন্যান্য সিনেমার পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রেও তিনি নিয়েছেন অগ্রণী ভূমিকা। সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' ভারতীয় সিনেমার জগতে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালীর মুক্তির পরেই সেই নিয়ে পথে নামেন তরুণ মজুমদার। নিজের বইয়ে তরুণ মজুমদার জানিয়েছেন পথের পাঁচালীর সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়ের গল্প। নাইট শোয়ের গল্প এবং আলতা দিয়ে লেখা প্ল্যাকার্ডের গল্প।
পুরনো কলকাতার বিখ্যাত চায়ের আড্ডাগুলির কথা প্রায় সকলেই জানেন। আর জানেন সেই আড্ডা থেকে উঠে আসা বহু কিংবদন্তির কথা। এমনই এক আড্ডায় তরুণ মজুমদারের সঙ্গে প্রথম পরিচয় পথের পাঁচালীর। ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা দেখে আসা এক বন্ধুর কাছে প্রথমবার পথের পাঁচালীর কথা শোনেন তিনি। বন্ধুর দাবি ছিল, সিনেমাটা খারাপ না হলেও সিনেমাটি চলবে কীনা সেই বিষয় যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন তিনি।
বলা বাহুল্য সেই রাতেই সবাই মিলে সিনেমা দেখা হয় নাইট শোয়ে। নিজের লেখায় তরুণ মজুমদার জানিয়েছেন গভীর রাতে সিনেমা শেষ করে বেরিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন সকলেই। কলকাতার অন্ধকার রাস্তায় শুধু মাত্র শোনা যায় তাদের হাঁটার শব্দ। রাতের ফাঁকা শহরে সত্যজিৎ-এর পথের পাঁচালী যে সেই কয়েকজন বন্ধুকে নিশ্চিত ভাবিয়ে তুলেছিল তাঁর প্রমাণ পরের দিন সকালের মিছিল।
সেই রাতে গুটিকয় তর্কবাগীশ বন্ধুর ধারণা ছিল পথের পাঁচালী হয়ত মুখ থুবড়ে পড়বে সিনেমা হলে। কিন্তু তাদের উপলব্ধিতে এটাও ছিল যে এই সিনেমার জন্য কিছু করা অবশ্যই প্রয়োজন।
পরবর্তীকালে বাংলা সিনেমাকে দেশের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তরুণ মজুমদারের বহু অসামান্য কাজের আগেই সিনেমার জন্য অত্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজটির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেই রাতেই। পরেরদিন সকালে দেশপ্রিয় পার্কের গেট থেকে শুরু হয় পথের পাঁচালীর সমর্থনে মিছিল।
সেই মিছিলে ছিলনা স্লোগান, চিৎকার অথবা বিতর্ক। শুধু ছিল পোস্টার, সেখানে লেখা, 'পথের পাঁচালী দেখুন', 'পথের পাঁচালী দেখা আমাদের কর্তব্য'। পরবর্তীকালে সিনেমার মাধ্যমে বহু মানুষকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলা তরুণ মজুমদার তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সেই সকালে পথের পাঁচালীর সমর্থনে জোগাড় করে ফেলেন প্রায় ৭০ জন মানুষ। সিনেমার মাধ্যমে মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়ার যে ক্ষমতা তরুণ মজুমদার দেখিয়েছিলেন তা যে শুধু তাঁর সিনেমাতেই আটকে ছিল না তার অন্যতম প্রমাণ এই ঘটনা।
আরও পড়ুন: Tarun Majumdar Death: সেদিন তরুণ মজুমদারের ভাগ্যের দরজা এক হ্যাঁচকায় খুলে দিলেন উত্তম
সত্যজিৎ-এর জন্য পথে নামা পূর্ণতা পায় যখন সত্যজিৎ নিজে তরুণ মজুমদারের সিনেমা বিদেশে পাঠানোর কথা বলেন। পরিচালক অনীক দত্ত জানান, "সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন যে ওঁর যে সংসার সীমান্তে সিনেমাটি বিদেশের সব বড় ফেস্টিভালে পাঠানো উচিত। সুতরাং আমরা ওঁর মূল্যায়ন করার যোগ্যই নই। যারা যোগ্য ছিলেন তাঁরা ওকে একটি বিশেষ জায়গা দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে।"
পরিচালক অনীক দত্তর তাঁর স্মৃতিচারনায় জি ২৪ ঘণ্টাকে জানিয়েছেন তরুণ মজুমদার তাঁকে এই মিছিলের সম্পর্কে বলেছিলেন। তিনি বলেন, "পথের পাঁচালী যখন প্রথম মুক্তি পায়, তখন সেই সিনেমা দেখে পরেরদিন ওঁরা একটা মিছিল করেছিলেন। প্ল্যাকার্ড সহ মৌন মিছিল। এখন সেটা ভাবা যায়? অন্তত দেখিনা তো এখন। এই ছবিটা দেখা উচিত, আরও অন্যান্য জিনিপত্র, রাজনৈতিক দাবিদাওয়া থাকেই। কিন্তু যেখানে কোনওভাবেই কারোর স্বার্থ জড়িত নয় এবং ওই একই ফ্রেটারনিটির লোক অথবা অল্প বয়সী অন্য যারা সংস্কৃতি সচেতন মানুষ এরকম একটা জিনিস করবেন।"
অনীক দত্তর মতে তরুণ মজুমদারের প্রয়াণে একজন অভিভাবক চলে গেলেন। যিনি সোজাসাপ্টা কথা বলতেন, যিনি নিজের অনুগত্য কিলোদরে বিক্রি করেননি. এখন তো সেরকম লোক পাওয়া খুবই মুশকিল। সেই রকম আরেকজন চলে গেলেন যাকে শ্রদ্ধা করতেন।
অনীক দত্ত জানিয়েছেন যেকোনও প্রতিবাদে তাঁকে ফোন করলে পাওয়া যেত। তিনি জানান প্রথমবার যখন তাঁর ছবি ব্যান করা হয় তখন তরুণ মজুমদার নিজেই আসেন এবং সেখান থেকেই তাদের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে বলেও জানান তিনি।