শর্মিষ্ঠা গোস্বামী চট্টোপাধ্যায় : মঞ্চে মিস শেফালি। বাংলা বোর্ড থিয়েটারে তখন ক্যাবারে নতুন সংযোজন। তাঁর নামে রংমহল, সারকারিনা চত্বরে আলাদা করে পোস্টার পড়ত। শহর কলকাতার সান্ধ্য জীবনের সেনসেশন তিনি। হঠাত্‍ই হলে দর্শকাসনে এসে বসলেন মহানায়ক। উত্তম কুমারকে দেখে একটু কি বুক কেঁপেছিল? তাঁর শিল্পে মুগ্ধ উত্তম। তারিফ করলেন সোজা গ্রিনরুমে গিয়ে। আপ্লুত মিস শেফালি। সেদিনের অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। কোনও দিন কি আহিরীটোলার ঘিঞ্জি বাড়িতে থাকা আরতি ভেবেছিলেন, জীবনে এমন মোড় আসবে ? এরপরেও মাঝে মাঝেই তাঁর নাটকের শোয়ে আসতে লাগলেন উত্তম কুমার। নিয়মিত দেখাও হতে থাকল তাঁদের। সে দেখা হয়ত মঞ্চ আর গ্রিনরুমের চৌহদ্দি পেরোতে পারেনি, কিন্তু এক শিল্পীর প্রতি অন্য আরেকজনের সম্ভ্রম, শ্রদ্ধা, বিনোদনের প্রতি সততা আজও মনে রাখার মতই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ কালচারাল টেক্সটস অ্যান্ড রেকর্ডসের আর্কাইভের জন্য এক সাক্ষাত্‍কারে বসে অফ-ক্যামেরা এই গল্প শুনিয়েছিলেন মিস শেফালি। পরিচালক উত্‍সব মুখোপাধ্যায়ের কাছে এখনও জ্বলজ্বলে সেই স্মৃতি। ‘এর একটা আফটার-স্টোরি অবশ্য আছে, কিন্তু সেটা বরং থাক, আজকের দিনে সেটা জরুরি নয়’, বলছিলেন পরিচালক।


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

সমাজের প্রচলিত নিয়মে হাঁটেননি। জীবন হাঁটতে দেয়নি। কিন্তু তাই নিয়ে বিশেষ ক্ষোভ ছিল না। তার অবকাশও অবশ্য ছিল না। অভাবী সংসার, একগাদা মুখ, রোজগার করতেই হত। একটা সময়ে পাড়ার দিদিকে দেখে নার্স হবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু ‘ম্যান প্রোপোসেস গড ডিসপোসেস’। অন্যের বাড়িতে কাজ করতে করতে পর্দার ফাঁক দিয়ে এক নতুন ডান্স ফর্ম চোখের সামনে আসে তাঁর। মন দিয়েই শিখলেন নতুন আর্ট ফর্ম। নৃত্যের তালে তালে শরীরে এক নতুন বিভঙ্গ। পশ্চিমি এই নৃত্যশৈলী তখনও তেমন দেখেনি শহর কলকাতা। খুব বিত্তশালী ক্লাবগুলোতেই কেবল ছিল তার কদর। জন্মসূত্রে পাওয়া অপূর্ব দেহভঙ্গি আর নিরলস পরিশ্রম, খানিকটা লাক-ফ্যাক্টর জন্ম দিল এক নতুন ব্র্যান্ডের। সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। সান্ধ্য আসরে হাতে পানীয়ের গ্লাসে মিস শেফালির লাস্য মিশে যে মৌতাত তৈরি করত, সাতের দশকের কলকাতা মজে ছিল তাতেই। তার উপর তাঁর এই পারফরম্যান্স যখন মুগ্ধ করল পরিচালক সত্যজিত্‍ রায়কে, তখন তিনি ক্লাউড নাইনে। প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির ঐ ক্যাবারে দৃশ্যের নান্দনিকতা ফিল্মের ছাত্রের কাছে চিরকালীন স্টাডি মেটিরিয়াল। ‘অবিশ্বাস্য স্ক্রিন প্রেজেন্স ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বীর ঐ দৃশ্যে মিস শেফালির থেকে চোখ সরানো যায় না আজও’, মু্ম্বই থেকে ফোনে বলছিলেন পরিচালক বৌদ্ধায়ন মুখোপাধ্যায়।এমন টানটান নির্মেদ শরীর রাখার জন্য বাড়তি কী করেন, প্রশ্নের উত্তরে একগাল হেসে বলতেন, ‘আমি কিন্তু তিনবেলা ভাত-ডাল-তরকারি খাই। তবে নাচের প্রতি অধ্যবসায়ই হয়ত আমাকে এমন নির্মেদ, টানটান রেখেছে’J অথচ, তাঁর এই নাচের শৈলীকেই পরবর্তীকালে স্বীকার করেনি সমাজ। আশ্চর্যের বিষয়, এই ক্লাবগুলিতে যাঁরা যেতেন, তাঁরা সম্পূর্ণ আর্বান, শহুরে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে নানা সংস্কৃতির এক্সপোজার আছে তাঁদের। তবু এই আর্ট ফর্মকে তাঁরা স্থান দিতে পারেননি তাঁদের ড্রয়িংরুম কালচারে। ক্যাবারে বরাবর মুখ লুকিয়েছে শহুরেপনার ফিসফিসে।
সদ্য পরিচালক অরিন্দম শীলের ছবি  ‘মায়াকুমারী’র শুটিং শেষ করলেন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ‘তদন্ত’ নামের একটা বাংলা ছবিতে মিস শেফালির আদলে এক ক্যাবারে নর্তকীর ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। মায়াকুমারীর শুটিং চলছিল মিনার্ভায়। দুদিনের শুটিংয়ে তাঁর বারবার মনে পড়েছে শেফালিকে, বলছিলেন ঋতুপর্ণা। এমনকি খবর এই যে, মিস শেফালির বায়োপিকেও না কি অভিনয় করবেন তিনি! ঋতুপর্ণা জানালেন, ‘মিস শেফালির তেমনই ইচ্ছে ছিল।তিনি বলতেন, ঋতুর আর তাঁর নিজের বডি টাইপটা একই রকমের।’ ঋতুপর্ণা অবশ্য বলছিলেন অন্য কথা। শেফালির ক্রাফ্টের প্রতি তার অসীম শ্রদ্ধা। যে বিনোদন দিয়ে তিনি একটা সময়ে দর্শকের মনোর়ঞ্জন করেছিলেন, সেই দর্শককুল তাঁকে মনে রাখেনি। দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ায়নি। অসুস্থতায় ইন্ডাস্ট্রিও সেভাবে মুখ তুলে তাকায়নি তাঁর দিকে। রেনাল ফেলিওরে যখন দক্ষিণ কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে একা বেডে শুয়ে, তখন ঋতুপর্ণা ছাড়া তাঁর পাশে বিশেষ কেউ ছিলেন না। আসলে, অনেকেই বিতর্কে জড়াতে চাননি। রাজনৈতিক বিতর্কের আবর্তে জড়িয়ে পড়া, শেফালির গোপন জবানবন্দি, ক্যাবারে ও বার-নর্তকীদের উপর নতুন আইন, নতুন ক্লাব-নিয়ম এসব থেকে সকলে দূরেই থাকতে চেয়েছিলেন।
বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক নিমাই ঘোষ, মিস শেফালির বেশ কিছু ছবি তুলেছিলেন।তার কয়েকটা প্রকাশ্যে এলেও, অনেকগুলিই এখনও নিমাইবাবুর ডার্করুমেই রয়ে গেছে। বেশ কিছু ছবি বেশ খানিকটা আন-সেন্সরডও বলা যায়। তাই হয়ত সেই সব ছবি প্রকাশ করেননি তিনি। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির শুটিংয়ের জন্য সত্যজিতের নির্দেশে শেফালির ছবি তুলতে যান বংশী চন্দ্রগুপ্ত, ভানুবাবু ও নিমাই ঘোষ। ছবির মুড কীরকম হবে, তার একটা ব্রিফও দিয়েছিলেন মানিকবাবু। তেমন ছবি তুলে নিয়ে আসার পর, তা পছন্দ হয়নি সত্যজিতের। নিমাই ঘোষকে বলেন, কলরাডের মত ছবি তুলতে। কলরাড সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না নিমাইবাবুর। সত্যজিত্‍ তখন তাঁকে বোঝান, কোন পোজে কী ছবি তুলতে হবে। মিস শেফালিকে আলোর বিপরীতে দাঁড় করিয়ে তেমন ছবি তুলে নিয়ে আসেন ফটোগ্রাফার। সেদিনের কথা স্মরণ করতে করতে, খানিকটা যেন হারিয়ে যা্চ্ছিলেন তিনি। বলছিলেন, ‘পরে আমার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয় ওঁর, যার ফল আমার কাছে জমিয়ে রাখা অপ্রকাশিত ছবিগুচ্ছ। কোনও প্রকাশনা সংস্থা এখন যদি তা ছাপতে চায়, তবে আমি দিয়ে দেব। ছবিগুলি প্রকাশিত হলে, শরীরী সৌন্দর্যের পরিভাষা বদলে যাবে। আমার শরীর ভাল নেই, আপনি বাড়িতে এসে ডেস্কটপে ছবি দেখে যান’, বলে ফোন কেটে দিলেন নিমাই ঘোষ।