রোশনি কুহু চক্রবর্তী


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

ন বিদ্যা সঙ্গীতাত্ পরা
সঙ্গীতের মতো বিদ্যা আর কিছুই নেই


প্রাচীন ঋক বেদ বলছে, রীতির সঙ্গে পারফর্মিং আর্টস এবং সঙ্গীতের যোগসূত্র রয়েছে। রয়েছে তালের কথা। সাম বেদের স্তোত্র এবং তা সুরে আবৃত্তির রীতির কথাও বহুশ্রুত। তারও আগে ভীমবেঠকার গুহা চিত্র মিলেছে, যেটির বয়স প্রায় ৩০ হাজার। সেই চিত্রে নাচের ভঙ্গী ধরা পড়েছে। অর্থাত্ এ দেশে সঙ্গীতের সূত্রপাত সেই কোন প্রাচীন কালে। অপ্সরাদের নৃত্যগীত, গন্ধর্বদের গান, বীণা, তন্ত্রীর মতো একাধিক বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখও প্রাচীন গ্রন্থেই রয়েছে। প্রাচীন হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে রাগের একটা সম্পর্ক রয়েছে। কখনও বা মোক্ষ লাভ কখনও বা বিনোদনের জন্য সঙ্গীতের ব্যবহারের কথা উল্লেখ প্রাচীন শাস্ত্রে। সর্বশ্রেষ্ঠ সাধনাই হল সঙ্গীত, একাধিক প্রাচীন পুঁথিতে এ কথা বলা হচ্ছে। এদিকে নাট্যশাস্ত্রেরও একটা বড়সড় ভূমিকা রয়েছে ভারতীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে। 


মন্ত্রোচ্চারণের সময় স্বরের ওঠা নামাই যে পরবর্তীতে সঙ্গীতের রূপ নিচ্ছে, এ কথাও অস্বীকার করেননি প্রাচীন পণ্ডিতেরাও। চোদ্দোশ শতকের অহমিয়া কবি মাধব কান্দালিরর রামায়ণেই  মার্দালা, খুমুচি, ভেমাচি, দাগার, গ্রাতাল, রামতাল, বীণা, রুদ্রবীণার উল্লেখ ছিল। ১৩০০ শতক থেকেই ভারতীয় সঙ্গীত পরিণতিপ্রাপ্তির দিকে এগোতে শুরু করে। একই সঙ্গে মুঘল-পারসিকদের প্রভাবে ধীরে ধীরে আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠল এ দেশের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য। দক্ষিণাংশের সঙ্গীতের থেকে যদিও উত্তরের সঙ্গীতের সঙ্গেই তাঁর মেলবন্ধন।


তেরো-চোদ্দ শতকের আশপাশে তাই কর্নাটকি সঙ্গীতের থেকে তাই স্বতন্ত্র ছিল খানিকটা হলেও। অন্য়দিকে, কর্ণাটকি সঙ্গীতের খোঁজ পাওয়া যায় চোদ্দো-পনেরো খ্রিস্ট শতক এবং তার পর থেকে। বিজয়নগর সাম্রাজ্য শাসনের সময়কালে দক্ষিণ ভারতে এই সঙ্গীতের উন্মেয় ঘটে। শক, হুণ, দল, পাঠান, মোঘল এক দেহে লীন হওয়ার কারণেই তাই সঙ্গীতে মিশল নানা রং। শ্রুতি, স্বর, অলঙ্কারের সঙ্গে মিশল রাগ, জুড়ল তাল।
ভারতীয় সঙ্গীত চিরকালই সমস্ত-সীমা-লঙ্ঘন-করা শক্তির জন্য সারা বিশ্বের কাছে সমাদৃত। ধর্মের পাঁচিলকে  ভেঙে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের রচিত সঙ্গীত কণ্ঠে তুলে নিলেন। বহুত্ববাদ এসে মিলল একে, অথবা উল্টোটা। বহুত্ববাদ এবং সহিষ্ণুতায় বিশ্বাসকে দৃঢ়তর করে তুলল সঙ্গীত। এক দেশের যন্ত্র অন্য দেশে এসে পড়েছে হয়তো বা দখলদারির হাত ধরেই। এক জাতির সুর মিশেছে অন্য জাতির ঈশ্বরের স্তুতিতে।
‘মারের সাগর বিষম ঝড়ের বায়ে’ পাড়ি দেওয়া তাই বোধহয় বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাবের গলায় ‘হরি ওম তৎ সৎ’। সুরের এই ভ্রমণ, সুরেরই এই উদার প্রতিপন ঘটে  ‘তহজীব-এ-মৌসিকী’-তে। পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের গানজীবনী। এই সঙ্গীত সংস্কৃতি বা ‘তহজীব-এ-মৌসিকী’ আসলে তাঁর জীবন ধর্ম, যে ধর্ম বিভাজনে বিশ্বাস করে না। যে ধর্ম সঙ্গীতের।


আরও পড়ুন: World Music Day: নাকে অক্সিজেন নল, মৃত্যুর ৩৭ দিন আগের রবিশঙ্করের অন্তিম সুরমূর্ছনায় মুগ্ধ নেটিজেন


সুরের আকাশে তাই কেউ বহিরাগত নন। গেয়ে গান, নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা লিখলেন অতুলপ্রসাদ সেন। সেই অতুলপ্রসাদই ১৮৯০ সালে ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিলেন। জাহাজে ভেনিস হয়ে আসার পথে গন্ডোলা-চালকরা একটা গান গাইছিল। সেই সুরই অতুলপ্রসাদকে দিয়ে লিখিয়ে নিল ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী, উঠ আদি জগৎজনপূজ্যা/ দুঃখ-দৈন্য সব নাশি, কর দূরিত ভারতলজ্জা...’ 
অন্যদিকে, ওয়াজিদ আলির ‘রহস’ বস্তুত অপেরা, যেখানে তিনি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব কত্থকের কম্পোজিশন মিলিয়ে দেন। আর তাই এদেশেও নানা সুরের সাঙ্গীতিক ভ্রমণ চলতেই থাকে। বাবা আলাউদ্দিন খান ব্রিটিশ ভায়োলিনকে নাম দেন বাহুলীন, শিল্পীর বাহুতে লীন হয়ে থাকে যে। জোহান সেবেস্টিয়ান বাখের ফিউগ ও পুরিয়া ধানেশ্রী রাগে ফিউশনের ভাবনার জন্ম নেয়। প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় সঙ্গীত যে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের শিকড়সন্ধান, যে শিকড় ছড়িয়ে সারা বিশ্বে। রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে/রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জেগে উঠে।’ ভবা পাগলা বলে ওঠেন, ‘সঙ্গীত সাধনা করো শক্তি পাবে মনে/মহাশক্তি বসিবেন হৃদয় আসনে।’