নিজস্ব প্রতিবেদন: এই স্মৃতি যেন আর না ফিরে আসে। যদিও প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন, তবু কেরল থেকে কলকাতায় ফেরার অভিজ্ঞতা আক্ষরিক অর্থেই দুঃস্বপ্ন। গত ৬ অগস্ট দক্ষিণ ভারত ঘুরতে গিয়েছিলেন রানিকুঠীর ষাটার্ধো দম্পতি প্রেমাঞ্জন লাহিড়ী এবং শাশ্বতী লাহিড়ী। কন্যাকুমারী হয়ে ৯ তারিখ তাঁরা পৌঁছন কেরলের কোবালাম ও আল্লেপিতে। তখনও পর্যন্ত বিপদের ভয়াবহতা টের পাননি এই বাঙালি দম্পতি। প্রেমাঞ্জনবাবুর কথায়, “পেরিয়ার আসার পরই এক টানা বৃষ্টি পাই আমরা।”


COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

টানা বৃষ্টির জেরে পেরিয়ারে তখন ভয়াবহ পরিস্থিতি। নদীর জলস্তর অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় ততক্ষণে পেরিয়ারে বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। জলের তোড় গোগ্রাসে গিলছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট! প্রেমাঞ্জনবাবু বলছিলেন, “আমাদের পরিকল্পনা ছিল, পেরিয়ার অভয়ারণ্যের সাফারি বোটে করে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাশ্ববর্তী এলাকা ঘুরে দেখব। কিন্তু পেরিয়ার নদী যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল, সেই পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়।”



আরও পড়ুন- মত্সজীবীর পিঠ প্রাণ বাঁচাল কেরলের দুর্গতদের, দেখুন ভিডিও


এরপর পেরিয়ার থেকে প্রায় ৮৪ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে ১৪ তারিখ মুন্নারে পৌঁছন তাঁরা। সেখানে গিয়েই বুঝতে পারেন, তাঁরা মৃত্যু গহ্বরে এসে পড়েছেন। এক নাগারে চলছে মুষল ধারে বৃষ্টি। এমন দুর্যোগের মধ্যেও মুন্নারে এসে কেরলের বিখ্যাত মার্শাল আর্ট এবং কথাকলি নৃত্য প্রদর্শনী দেখতে যান ভ্রমণপিপাসু এই দম্পতি। এ দিন সন্ধ্যায় শো দেখে তাঁদের হোটেল ‘মিষ্টি মাউন্টেন’-এ এসে যখন পৌঁছন, তখনও অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। পরের দিন ১৫ অগস্ট।  স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে হোটেলের তরফে কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। কিন্তু সকাল হতেই যে ভয়াবহতার সম্মুখীন হতে ভাবতে পারেননি লাহিড়ী দম্পতি। হঠাত্ হোটেলের জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে ঘরবাড়ি, ল্যাম্পপোস্ট। পাশের হোটেলটিও তলিয়ে যায় জলের মধ্যে। ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ছে বেশ কয়েকটি গাড়ি। রাস্তায় যাঁরা এই ধ্বংসলীলা চাক্ষুস করেছিলেন, দিশাহারা হয়ে তাঁরাও পড়ে যান খাদের নীচে। এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে শাশ্বতীদেবীর গলা ধরে আসে। তিনি বলেন, “মুন্নারে যেতে বারবার বারণ করেছিল আমাদের সহকর্মীরা। কিন্তু কীসের টানে যে এখানে এসেছিলাম জানি না।”



তবে, শাশ্বতীদেবী শোনালেন এমন দুর্যোগেও তাঁদের গাড়ির চালক কীভাবে সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে গিয়েছেন সেই কাহিনী। বাচ্চা ছেলে কিন্তু চালকের সাহস এবং দায়বদ্ধতা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছেন শাশ্বতীদেবী। তিনি বলেন, “দুর্গম রাস্তা জলের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছে। কোথাও বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমাদের চালক কোন কৌশলে কীভাবে নিরাপদে পৌঁছে দিলেন এখনও ভাবতে অবাক লাগছে। ওর মা থাকেন কোচিতে। সেখানেও সব ভেসে গিয়েছে। আমি নিজে মা হয়ে বুঝতে পারছি, তার মন পড়ে রয়েছে সেখানে। তবুও তার কর্তব্যে এতকটুও অবহেলা দেখিনি।”


আরও পড়ুন- কেরলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, চলছে উদ্ধার



এ দিকে প্রেমাঞ্জনবাবু জুড়লেন হোটেলে তাঁদের ভয়াবহ কাহিনির কথা। হোটেলের কর্মীরা তাঁদের এসে জানিয়ে যায়, দশ মিনিটের মধ্যে তলিতল্পা গুছিয়ে ফেলুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই হোটেলও ধস নামতে পারে। হাতে সময় কম। এরই মধ্যে কোনওরকমে সব গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। হোটেলের লোকই নিজেদের গাড়ি করে মুন্নার কুইন নামে অন্য একটি হোটেলে পৌঁছে দেয়। তুলনায় নিরাপদ এই হোটেল। কিন্তু দুদিন ধরে নেই কোনও বিদ্যুত্। পানীয় জল নেই। হোটেলের খাবার যতটুকু আছে সেখানকার কর্মীদের জন্যই তা বরাদ্দ। তবুও, তাঁরা পর্যটকদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে দিন কাটিয়েছেন। কিন্তু এভাবে আর ক’দিন! প্রেমাঞ্জনবাবু জানাচ্ছেন, হোটেল কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করেছে পর্যটকদের নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার। কারণ, তাঁদের কাছে মজুত খাবার আর সেভাবে ছিল না।  মহারাষ্ট্র থেকে আসা এক দল যুবক এবং আমরা একটি গাড়ি ভাড়া করে মাদুরাইয়ে দিকে যাত্রা শুরু করি। কিন্তু কিছুটা রাস্তা যেতেই দেখা যায় ধস নেমেছে। কোথাও রাস্তা দু’ভাগ হয়ে কলকলিয়ে বইছে জলস্রোত। শাশ্বতী দেবী বলেন, সেনা এবং স্থানীয় বাসিন্দারা কীভাবে মরণপন লড়াই চালাচ্ছেন, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।


আরও পড়ুন- কেরলে বৃষ্টি থামার পর জলবাহিত রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা


তবে লাহিড়ী দম্পতির মতো যাঁরা এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়নি, তাঁরাও বাইরে অনুভব করছেন অকুতোভয় সেনাদের সাহসিকতা। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ভিডিওয় দেখা গিয়েছে, আর্ত মানুষের হাহাকার। ভিটে হারানো মানুষের চোখের জল।


ঘণ্টা পাঁচেকের রাস্তা বারো ঘণ্টা যাত্রা করে মাদুরাই পৌঁছন দম্পতি। তারপর বেঙ্গালুরু হয়ে গতকালই কলকাতায় পৌছেছেন তাঁরা। কিন্তু এখনও বন্যা-আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে দম্পতিকে। কানে বাজছে অসহায় মানুষের হাহাকার।