ভারতে প্রায় ৭০ হাজার তরুণ Radicalisation-এর অন্তর্ভুক্ত? কী বলছে সদ্য প্রকাশিত `আমি কমান্ডো`
যুব সম্প্রদায়কে যথাযথ ভাবে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, তাদের দাবি-দাওয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে।
নিজস্ব প্রতিবেদন: কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখলেন প্রাক্তন এনএসজি কম্যান্ডো দীপাঞ্জন চক্রবর্তী। প্রকাশিত হল তাঁর 'আমি কমান্ডো' বইটি। বইটিতে কাহিনির চালে ভারতে মৌলবাদী চক্রের কাজকর্ম নিয়ে একটা তথ্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ আছে। আছে বিষয়টি কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, তা নিয়ে তাঁর মূল্যবান কিছু পরামর্শও।
এ বিষয়ে আমাদের মনে সব থেকে বেশি ওঠে এই প্রশ্নটিই-- কেন জেহাদের অন্ধকারে পা বাড়াচ্ছে দেশের নতুন প্রজন্মের একটা অংশ?
আসলে একটা শাশ্বত ক্ষোভ থেকে তৈরি হওয়া বদ্ধমূল বিদ্বেষই তাদের এই পথে নিয়ে যায়। অন্তত পর্যবেক্ষণ তেমনই বলে।
এক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুষঙ্গের কথা উঠেই পড়ে। কিন্তু এ কথা ঠিক, শুধু হিন্দু বা শুধু মুসলমান এই পথে প্ররোচিত নয়। স্থানবিশেষে উভয় সম্প্রদায়ই এই জেহাদ-পথে অগ্রসরমাণ।
কিন্তু মৌলবাদ হোক, জেহাদ হোক কিংবা 'র্যাডিক্যালাইজেশন'-- কেন ঘটে এসব?
মূলটা সামাজিক। সমাজের একটা অংশ বিচারব্যবস্থার উদাসীনতার জন্যেই হোক বা অন্য কোনও এই জাতীয় ঘটনার জেরে শেষপর্যন্ত এক নিরাময়হীন বঞ্চিত জীবনের শরিক হয়ে পড়ে। অনেক সময় গোটা জীবনটাই তাদের নষ্ট হয়ে যায়। এবং রাষ্ট্রের হাতে লাঞ্ছিত-নিপীড়িত হয়ে স্বদেশ-সমাজ-সরকার ইত্যাদির উপরে এক সময়ে তাদের মনে জন্ম নেয় ঘোরতর এক বিবমিষা।
সাধারণ একজন ছেলে বা মেয়ে কেন বেছে নেয় মৌলবাদের পথ? এর নানা কারণ-- অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মানসিক, ঐতিহাসিক এবং মতাদর্শগত। এই নানা কারণের অন্তর্সংঘাত চরম সীমায় পৌঁছে দেয় কিছু মানুষকে। আর তখনই তারা চরমপন্থা অবলম্বন করে ফেলে। করে ফেলার প্ররোচনা পায়। এবং তখন হিংসাত্মক প্রতিরোধকেই প্রতিবাদের একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নেয়।
এবং এটা যে শুধু সাম্প্রতিক সময়-পর্বেই ঘটছে, তা নয়। উদাহরণস্বরূপ চম্বলের কথা বলা চলে। সেখানেও এই ব্যাপারটা ঘটেছিল, অনেক দিন ধরে ঘটছিল, তবে একটু অন্য ধাঁচে। চম্বলের তুলনায় এই ক্ষেত্রটা এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে। স্থানীয় অক্ষকোটি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে তা এখন এক আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থার পাকে-চক্রে জড়িয়ে পড়েছে।
ভারতে আনুমানিক ৭০ হাজার তরুণ এই 'র্যাডিক্যালাইজেশনে'র অন্তর্ভুক্ত। সারা দেশেই তাই নানা ভাবে সমস্য়াটা রয়ে গিয়েছে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের সমস্যা আছে। কাশ্মীরের সঙ্কট তো নানাবিধ। সেখানে পাকিস্তান থেকে অনুপ্রবেশের সমস্যা ছিল। ৩৭০ ধারা রদ হওয়ার পর অনুপ্রবেশ অবশ্যই কমেছে, পাল্লা দিয়ে সঙ্কট কিন্তু কমেনি, বরং বেড়েছে। কেরলের দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। কেরলে ১১,০০০ মুসলিম যুব আইএসআইএস চক্রে জড়িত বলে জানা গিয়েছে। কেরলের একটা বড় অংশ, প্রায় ৭০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ মধ্য প্রাচ্যে কাজ করতে যান। ফলে কেরলে বিপুল পরিমাণ আরবের টাকা ঢোকে। আর এই টাকার বিনিময়েই কোনও ভাবে নিজেদের আদর্শ খুইয়ে জেহাদি আদর্শকে বরণ করে নেওয়ার একটা অলিখিত বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে যান ওই কর্মীদের একটা অংশ।
আইএসআইএস-এর জেহাদি কাজকর্মের জন্য বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারত-বাংলাদেশ জুড়ে যে বিশাল খিলাফতি শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছে আইএস, শোনা গিয়েছে তার পথে ভারতই নাকি সব চেয়ে বড় বাধা। তবে ওদের পরিকল্পনাটা হল--পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তান-আফগানিস্তান এবং পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশ থেকে ভারতকে ক্রমাগত ব্যতিব্যস্ত করে তোলা। আর এই ব্যতিব্যস্ত করার কাজটা করবে বাংলায় ছড়িয়ে থাকা মুজাহিদরা।
চরমপন্থী মৌলবাদের দীক্ষার মোটামুটি কয়েকটি ধাপ। মৌলবাদের প্রতি প্রাথমিক আকর্ষণ; ক্রমশ মৌলবাদের গতিপ্রকৃতির ভিতরে নিজের সত্তার অবস্থা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা; এর পরে আসে নিজেকে ওই মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তোলার প্রক্রিয়া; এবং একেবারে শেষ ধাপে গিয়ে জেহাদে পাকাপাকি ভাবে দীক্ষা নেওয়া। যারা এই ধাপগুলির মধ্যে দিয়ে যাবে তারা বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করবে; কথাবার্তায় আলাপে-আচরণে ক্রমশ স্টিরিওটাইপড হয়ে পড়বে, অন্যদের সম্পর্কে বা অন্য ধর্ম সম্পর্কে প্রচণ্ড বিদ্বেষ পোষণ করবে এবং সার্বিক ভাবে নিজেদের সমস্ত কাজে অত্যন্ত কঠোর ভাবে এবং দৃষ্টিকটু ভাবে গোপনীয়তা রক্ষা করবে।
তা হলে এসব রোধ করতে কী করতে হবে?
সহনশীলতাই এক্ষেত্রে শেষ কথা। যুব সম্প্রদায়কে যথাযথ ভাবে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তাদের দাবি-দাওয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের বঞ্চনা ও ক্ষোভকে সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখানে খুবই দুর্বহ। তবে শুধু রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে হবে না। সমাজেরও বিপুল দায়িত্ব আছে।
নিজের কর্মজীবনের নানা অভিজ্ঞতা পরতে পরতে মেলে ধরতে গিয়ে প্রাক্তন এনএসজি কম্যান্ডো দীপাঞ্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা সমস্যাকে কাছ থেকে দেখে তার নিখুঁত বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন তাঁর স্মৃতি আলেখ্যে, ভবিষ্যতে যা এদেশের রাষ্ট্রনিয়ন্তাদের, সমাজকর্মীদের নিঃসন্দেহে নানা কাজে লাগবে।
আরও পড়ুন: Nodakhali Blast: কেন এত তীব্র বিস্ফোরণ? কী ধরনের বিস্ফোরক মজুত ছিল? তদন্তভার নিচ্ছে NIA