COMMERCIAL BREAK
SCROLL TO CONTINUE READING

নিজস্ব প্রতিবেদন: তর্কবাগীশ, তর্কাচার্য, তর্কভূষণ ইত্যাদি নানা অভিধার ছড়াছড়ি ছিল এ বঙ্গে। সাধে কি অমর্ত্য সেন তাঁর 'The Argumentative Indian'-এ লিখেছেন, 'ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে তর্কপ্রিয় বাঙালি।' এমন এক তার্কিক জাতির কাছে তর্ক মানে শুধু উপসংহারের লক্ষ্যে ধাবমান হওয়া নয়, বরং মন্থন। 


এমন এক মন্থনই হয়েছিল 'Zee ২৪ ঘণ্টা'র 'আপনার রায় উইথ অঞ্জন' অনুষ্ঠানে। সেখানে তৃণমূল নেতা ব্রাত্য বসুর মুখোমুখি হয়েছিলেন এডিটর অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। সান্ধ্য আড্ডা নয়, বরং বাঙালির জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া তর্ক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এই দুই মহারথী। যে তর্কে উত্তরের পাল্টা প্রশ্ন আছে, পরিশেষে হাসিমুখে সমাপ্তি আছে, নেই ব্যক্তিগত ক্লেদ।


তখন করোনা নেই। বরং বাংলা উত্তপ্ত ভোট-রাজনীতিতে। তৃণমূলে ভাঙন ধরছে। বিজেপি স্বপ্ন দেখছে ২০০ আসন নিয়ে 'আসল পরিবর্তনে'র। এই প্রেক্ষিতে ৯ মার্চ 'আপনার রায় উইথ অঞ্জনে' এসেছিলেন ব্রাত্য বসু। সাংবাদিক-রাজনীতিকের বাইরে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ব্রাত্য বসু পূর্বপরিচিত। শুরুতেই তাই নিজেরা ঝালিয়ে নিলেন, বহুবছর পর আবার তাঁরা টিভিতে মুখোমুখি। সম্পর্ক প্রায় ৪০ বছরের। এডিটর অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় শুরুতেই বললেন,'আপনার রায় স্থির করার জন্য আমরা কাঠবেড়ালির ভূমিকা নিই।' 


আরও পড়ুন: সময়ের ছাই


বিয়েবাড়ির ভোজে শুরুতেই প্রথামাফিক লেবু-নুন দিতে লাগে। ঠিক তেমনই রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎকারের শুরুতেই অঞ্জনবাবুর প্রশ্ন, কতটা আত্মবিশ্বাসী? 


ব্রাত্য স্বীকার করে নিলেন একুশের লড়াই কঠিন। তবে এটাও ঠিক, এটা তৃণমূল বনাম তৃণমূল বিক্ষুব্ধ। 


এখান থেকেই ধরে নেন অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। আচ্ছা, তা হলে কি তৃণমূল ডুবন্ত জাহাজ? তাই সবাই বেরিয়ে আসছেন? 


ব্রাত্যর সোজাসাপটা জবাব,'লোকসভা ভোটে বিজেপির ফল বড় কারণ। তবে লোকসভা ও বিধানসভা এক নয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। বিজেপিতে নেতার অভাব। সেই শূন্যস্থান পূরণ হতে পারে। যদি ম্যাজিক হয়, বিজেপি ক্ষমতায় এলে বিক্ষোভ চারগুণ দেখতে পাবেন।'


'শুভেন্দু ও রাজীবের মতো নেতারা চলে যাচ্ছেন ব্রাত্য? অঞ্জনদার প্রশ্ন। 


তৃণমূল নেতার অভিমত,'রাজনীতিতে বাণিজ্যকরণ ঘটেছে। এই যেমন অন্য চ্যানেলের অফার পেয়ে আপনি চলে গেলেন। এই শিল্পীরা মুখ ফসকে বলে ফেলছেন, বিজেপির ভালো অফার ছিল। এই অফার রাজনীতিতে খাটে না। স্বতঃস্ফূর্ত তাগিদ থেকে মানুষ রাজনীতি করেন।' 


আজ এলাম, কাল জনপ্রতিনিধি! ভোটের আগে দুই দলে যেভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রীর ভিড় বাড়ছিল, তা কতটা জনতার উপকারে লাগবে? 'আপনার' মানে দর্শকদের প্রশ্ন ব্রাত্যকে সরাসরি করেছিলেন অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। জানতে চেয়েছিলেন, ব্রাত্য ও অর্পিতা অন্য জগতের লোক ঠিকই। আপনারা গণআন্দোলন থেকে রাজনীতিতে এসেছেন। ১৯৫২ সালে ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আইনস্টাইন। মানুষকে নিয়ে চলার প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছিলেন। সবেতেই তো প্রশিক্ষণ লাগে। পারবেন আমার জায়গায় বলতে? আপনি ও রাজ চক্রবর্তী একই জায়গায়? কোন গণআন্দোলন থেকে বেরিয়ে এলেন?


ব্রাত্য বলেন, 'সবাইকে গণআন্দোলন করতে হবে তার মানে নেই। আমি দুটো উদাহরণ দিচ্ছি। প্রশিক্ষণহীন অনেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা টিকিটও পাবেন। ব্রিগেডে তাঁদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারিতেও দেখা গেল না। অন্য দিকে, আজ একটা মিছিল হয়েছে টালিগঞ্জের প্রশিক্ষণহীন তারকারা হেঁটেছে। আপনার ভাষায়। এখানে অঞ্জনদার সংযোজন, 'আমার ভাষার দরকার নেই, আপনি বলে দিন,প্রশিক্ষণহীন না প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত?' সেই রেশ ধরেই ব্রাত্য বলতে থাকেন,'উত্তরটা নিন আগে। মিছিলের শেষে বক্তব্য রাখলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে জুন, সায়নী এমনকি টিকিট-না-পাওয়া সুদেষ্ণা রায়ও নিজেদের বক্তব্য রাখলেন। প্রশিক্ষণ আছে কী নেই, সেটা বড় কথা নয়! বড় কথা, কীভাবে তাঁদের ব্যবহার করা হচ্ছে?' 


আলোচনার এই জায়গায় সংবাদমাধ্যমে শিক্ষানবিশ সাংবাদিকের প্রসঙ্গ টেনে আনেন ব্রাত্য। অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বলেন,'আপনি বড় কেন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করবেন। একজন জনপ্রতিধিনি আর শিক্ষানবিশের মধ্যে ফারাক নেই!' এমন প্রত্যাঘাতের আশা হয়তো করেননি ব্রাত্য। বলেন,'আমরা আলোচনা করব। নাকি ডমিনেট করবেন।' আর পাঁচটা রাজনীতিকের চেয়ে ব্রাত্য যে আলাদা, তা স্মরণ করিয়ে দেন অঞ্জনদা। বলেন,'আলোচনা করব। আপনি বুদ্ধিজীবী। আপনার মধ্যে আত্মনিরীক্ষণ আছে। আমি যখন বলছি, হে নাগরিক আপনাদের প্রতিনিধি এনে দিচ্ছি। তখন একটা তালিকায় টিক মার্ক থাকে। কোথাও টিকমার্ক দিতে পারছি না! আপনি জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন। ভোর থেকে রাত আড়াইটে পর্যন্ত কাটান। একটা প্রস্তুতিপর্ব লাগে। আপনার মতো নাট্যব্যক্তিত্ব হব বলেই কাল থেকে হওয়া যায় না।' হতে পারেন, প্রকৃত গুরু পেলে হবেন। স্বপ্ন দেখা দোষের নাকি! অভিমত ব্রাত্যর। 
গুরু পেলে হয়ে যাব? বিস্মিত অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রাত্যর যুক্তি,'ছোটবেলা থেকে রাজনীতি করে অনেকে সফল হয়েছেন। অনেকে ব্যর্থ। সেই নজিরও তো রয়েছে।' 


আচ্ছা, মানে আপনারা পরীক্ষাগারে রেখেছেন। সাফল্য, ব্যর্থতা নিয়ে নিশ্চিত নন? 


ব্রাত্যর উত্তর,'আমি আত্মবিশ্বাসী। আপনি সন্দেহ করছেন। ১০ থেকে ১২ জনকে চিনি। যাঁরা ৮০ শতাংশ সফল জনপ্রতিনিধি হবেন। ২০ শতাংশ রাজনীতিকরাও হন না। ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হওয়া যায় না।'  


মমতা কেন 'মুকদ্দর কা সিকন্দর'? ব্রাত্যর ব্যাখ্যা,'মমতার ৪০ বছরের গণসংগ্রামের ইতিহাস আছে। লাঠির মার খাওয়া আছে। প্রশাসন থেকে বের করে দেওয়া আছে।' 


মইদুলকে পুলিসের মার অন্যায় বলেও স্বীকার করে নেন ব্রাত্য। রাজনীতিকরা ভুল মেনে নিচ্ছেন, তা বেনজিরই। কুর্নিশ করলেন অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন,'অভিনন্দন জানাই, আপনি স্বীকার করলেন, মইদুল ইসলামকে মারা অন্যায় হয়েছে।' যে কোনও মৃত্যুই অন্যায়, কিন্তু মৃতের পরিবারকে ডেকে আগে কোনও মুখ্যমন্ত্রী কথা বলেনি, দাবি ব্রাত্যর। তাঁর কথায়,'মানুষ রাষ্ট্রের থেকে সহানুভূতি চায়, সহমর্মিতা চায়।' 


আরও একবার ওঠে রাজনীতিতে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রসঙ্গ। ব্রাত্য বলেন,'আপনার চ্যানেল পরীক্ষাগার হবে। পাঁচজন ট্রেনি জার্নালিস্ট এনে বুম ধরিয়ে দিন। বাংলা জানে না।' তাঁকে শুধরে দেন অঞ্জনদা। 'Zee ২৪ ঘণ্টা'র এডিটর মনে করিয়ে দেন,'আমি শিক্ষানবিশ নিয়ে প্রশিক্ষণ দিই। আর আপনি জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করছেন। মানুষের ভালো-মন্দ নিয়ে তাঁদের কাজ করতে হয়।' 


নন্দীগ্রামে অধিকারী পরিবারের চেয়ে নেত্রীর ভূমিকাকেই এগিয়ে রাখলেন ব্রাত্য। কেন? 
তৃণমূল নেতার যুক্তি, নন্দীগ্রামে আন্দোলনে শুভেন্দু ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন শহিদের মর্যাদা আছে। তবে মহাত্মা গান্ধীর মর্যাদা একটু বেশি।' 


ভারতে গান্ধী পূজিত হন। তবে বাংলায় গান্ধী ঈষৎ সমালোচিত। নেতাজিই এখানে বেশি প্রাধান্য পান। কোন পাড়ায় গিয়ে কথা বলছি, তা নির্ণায়ক হয় না? প্রশ্ন করেন অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। 


ব্রাত্যর জবাব, '১৪ মার্চ সমস্ত টেলিভিশন লাইভ দেখিয়েছিল। কোনও নির্দিষ্ট পরিবার উপস্থিত ছিল? আমি মোটরবাইক দেখাতে পারি। তার আরোহিণীকে গালগাল করা হচ্ছে কোলাঘাটে।' 


দীর্ঘ ১০ বছর জনপ্রতিনিধি থাকার পর নাট্য়কার ব্রাত্য বসুর রাজনীতি সম্পর্কে কী ভাবনা? 
কলেজজীবন থেকেই অঞ্জনদার সঙ্গে পরিচিত ব্রাত্য বসু জানালেন, 'ব্যক্তি হিসেবে আমার টিউনিং হয়েছে। প্রগলভতা ছেঁটে দিয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে একটা জার্নি পার করেছি। শত শহস্র থিয়েটার করেও তা অর্জন করতে পারতাম না।' 


দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, দাদাগিরি ইত্যাদি প্রবণতা প্রতীয়মান হয়ে উঠছে? রাজনীতি নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন অন্বেষণের চেষ্টা করলেন অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। 


ব্রাত্য বসুর অভিমত,'এটা তৃতীয় বিশ্বের প্রবণতা। দুর্নীতিতে ভেনেজুয়েলায় এগিয়ে রয়েছে। আবার মার্কিন সংস্থাকে ঢুকতে দেয় না তারা। আমি দুর্নীতিকে সমর্থন করছি না।' 


এই তর্কের পথেই কণ্টকাকীর্ণ  প্রশ্ন,'আপনি ২০১০ ও ২০১১ তৃণমূলের মধ্যে ফারাক দেখতে পান? 


ক্ষমতায় থাকার ফলে কয়েকজন নেতার চালচলন বদলেছে বলে স্বীকার করলেও ব্রাত্য জানালেন, নেত্রী এক জায়গায় আছেন। শুরুতে সরকারি গাড়িতে পাড়া ছেড়ে বেরোতাম মাথা নীচু করে। এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। যানজটে দাঁড়ালে মনে হয় বেরিয়ে কেন যাচ্ছি না! এটা পাওয়ার সিন্ড্রোম।' 


তখন মিঠুন চক্রবর্তী সদ্য যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। স্বাভাবিকভাবে তর্কে তো তিনি আসবেনই। 'মিঠুন কলঙ্কিত নন। আপনাদের সঙ্গেও ছিলেন'। ব্রাত্যর উত্তর,''এমন একটা লোক কর দেওয়ার ক্ষেত্রে রেকর্ড করেছেন। তাঁকেও সারদা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়। তাঁর সন্তানকে ব্ল্যাকমেলিং। ভয়ের রাজনীতি হচ্ছে। আমার পতাকা না ধরলে কুৎসা করে দেব। রাজনীতিকরা গায়ে মাখেন না। উনি এত বড় অভিনেতা! নকশাল, সিপিএম থেকে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ, এখন বিজেপি হয়েছেন। তার মনে ভয়। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে। সে কারণে গোখরো সাপ হয়ে আবির্ভূত হলেন, এক ছোবলে ছবি। কাল তাহলে অনুরাগ কশ্যপকে পতাকা ধরতে হবে?'


আচ্ছা অন্য দল থেকে আপনাদের দলে এলে সত্যসন্ধানী? ব্রাত্যর 'দ্বিচারিতা' দেখিয়ে দেন অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। 


ব্রাত্য বলেন,''সুজাতা খাঁ চৌধুরী ইস্টারেস্টিং কথা বলেছেন। বিজেপিতে মহিলাদের সম্মান নেই। কাল-পরশু যোগদান করিয়ে টিকিট দিচ্ছে। তিনি নারী ও দলিত হওয়ায় বৈষম্য।'' 


মোদী ও শুভেন্দু কি চ্যালেঞ্জ নয় মমতার? অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, 'বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা না করে কৌশলে মোদীকে মমতার বিরুদ্ধে এগিয়ে দিয়েছে। আর নন্দীগ্রামে মমতা বড় নেত্রী হয়ে তাঁর সতীর্থ শুভেন্দুকে চ্যালেঞ্জ করলেন। এ জিনিস তো দেখি না।' 
ব্রাত্যর যুক্তি,'প্রধানমন্ত্রী কি মুখ্যমন্ত্রী হতে আসছেন নাকি! শুভেন্দু বিধায়ক পদ ছেড়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। মমতা মুচকি হেসেছিলেন। খারাপ কথা বলেননি।' 


'দুর্গ অটুট' শেষলগ্নেও ঠিকরে বেরোয় ব্রাত্যর আত্মবিশ্বাস। 


'বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তর্কে বহুদূর'- এমন মনোগ্রাহী তর্ক এগিয়ে যেতেই পারত। তবে বাধা দিল সময়। আপাতত থামলেন দুই তার্কিক বাঙালি। অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন,'আপনি ডবল ইঞ্জিনে--নাট্য ও রাজনীতিতে। আমরা চাইব দুটো ক্ষেত্রেই সাফল্য আসুক। আপনার সঙ্গে আবার আড্ডা মারব। সত্যি বলতে কী দারুণ লাগে! বহুদিন ধরে ভাবছিলাম, মুখোমুখি ব্রাত্য বসু কবে করব!' 


নাহ, আড্ডাটা আর ফিরবে না!


আরও পড়ুন: অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আমার স্মৃতিতে আছেন, আমার সত্তায় আছেন, আমার ভবিষ্যতেও থাকবেন